এটি আমার চাকরি জীবনের প্রথম দিকের ঘটনা। প্রায় তেত্রিশ বছর আগে আমি একটি প্রত্যন্ত জায়গায় একটি ক্ষুদ্র স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মরত ছিলাম। মাত্র একঘন্টার নোটিশে একটি বড় হাসপাতাল থেকে আমায় ঐ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। একদিন বড় হাসপাতালের আউটডোর শেষ করে ঘরের পথ ধরেছি, রাস্তায় আমায় নিমন্ত্রণ পত্র ধরানো হলো। আমায় সেই দিনই, ওই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজে যোগ দিতে রওনা হতে হবে। ঘড়িতে দেখি ওখানে যাওয়ার একটি মাত্র ট্রেন ছাড়ার মোটে এক ঘন্টা বাকি। ঊর্ধশ্বাসে কোয়ার্টারে পৌঁছে, একটি থলিতে দুচারটে জামাকাপড়, টুকিটাকি ভরে, ঘরে যে সামান্য টাকা পয়সা ছিল তা পকেটে নিয়ে স্টেশনের দিকে দৌড়লাম। যাহোক করে সেদিন ট্রেনটি ধরতে পেরেছিলাম।
প্রায় রাত্রি দশটা নাগাদ স্টেশনে পৌঁছে দেখি ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। প্রায় জনপ্রাণিহীন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে দেখি প্লাটফর্মের প্রান্তে টলায়মান দুই ভদ্রলোক। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা অফিসার্স রেস্টহাউসটা কোথায় বলতে পারেন?’ একজন জবাব দিলেন, ‘ররফিসারর্ রেস্ট হাউস? উফফ্’। তারপর শূন্যে হাত ঘুরিয়ে এক অনির্দেশ্য নীহারিকার পানে তাকিয়ে আবার,’উফফ্’।ভদ্রলোকদের বিরক্ত করা আর সমীচীন হবে মনে হলো না।
এবার ওই অন্ধকারে দুচারটে ঠোক্কর খেয়ে এক পথচারীকে পেলাম যিনি আমায় স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পথ বাতলে দিলেন। সেখানে গিয়ে দেখি হ্যারিকেন জ্বালিয়ে, একজন স্বাস্থ্যকর্মী বসে বসে হাই তুলছেন। তাঁকে নিজের পরিচয় দিয়ে, ওখানকার ডাক্তারবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করলাম। ওনার জায়গাতেই আমায় দায়িত্ব নিতে হবে। ডাক্তারবাবু পাশেই কোয়ার্টারে থাকেন। ওঁর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি তো আমায় একলা দেখে অবাক। বললেন ‘রামু কোথায় গেল?’ আমি বললাম,’ সে আবার কে?’ ডাক্তারবাবু জানালেন, রামু হাসপাতালের সাফাইকর্মী, যাকে স্টেশনে পাঠানো হয়েছিল আমায় নিয়ে আসার জন্যে।
আমার তো তার সাথে সাক্ষাৎ এর সৌভাগ্য হয়নি, আমি জানালাম। যাইহোক কিছু ক্ষণ পরে আকর্ণবিস্তৃত হাসি নিয়ে রামুবাবু আবির্ভূত হলেন। উনি জানালেন যে আমায় আনতেই উনি স্টেশনে গিয়েছিলেন, ওভারব্রিজের ওপর উঠে উনি দেখেন, চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে, তাই উনি সেই মলয় সমীর উপভোগ করতে করতে, ওভার ব্রিজের ওপরেই কিঞ্চিৎ নিদ্রাভিভূত হওয়ায় আমার সাথে ওনার সাক্ষাৎ হতে পারেনি। যত্র তত্র নিদ্রামগ্ন হবার এই অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী এই ভদ্রলোককে দেখে চমৎকৃত হলাম। যাই হোক শেষ মেষ এই রামুবাবুই লন্ঠন হাতে রেললাইনের অন্য পারে রেস্টহাউসে আমায় পৌঁছে দিলেন।
পরের দিন ডাক্তারবাবু আমায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। ঐ প্রত্যন্ত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোগীর সংখ্যা বড় কম ছিলো না। সকাল ও বিকেলের আউটডোর ছাড়াও ছোট খাটো ইমার্জেন্সি লেগেই থাকতো। সপ্তাহে সাতদিন চব্বিশ ঘন্টা প্রায় নাজেহাল অবস্থা। বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো ‘হাউস কল’ ও লেগেই থাকতো। রাতবিরেতে যখন খুশি ওখানকার মানুষ আমায় ঘরে ডেকে নিয়ে যেতেন, আর ডাকটা যখন তখনই পড়তো। আর এইসব কলে কোনো সম্মান দক্ষিণার ব্যাপার ছিলো না। ফলে একজন চিকিৎসককে দিবারাত্রি যখন খুশি ডাকা যায়, তাও বিনা মূল্যে এইটেকে বোধহয়, ওখানকার অধিবাসীবৃন্দ দারুণ ভাবে উপভোগ করতেন। ফলে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল।
গোটা সময়টা জুড়ে আমার জীবনের একমাত্র রূপোলী রেখা ছিলো ওখানকার লাইব্রেরি। আমার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে মাইল খানেক দূরে একটি বেশ ভালো লাইব্রেরি ছিলো। প্রতিদিন বিকেলের আউটডোর শেষ করে ওখান থেকে বই পাল্টে আনতাম। পড়ন্ত বিকেলে ঐ লাইব্রেরিতে যাওয়া আসার সময়টুকুতে এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে যেতো। ওখানে নিকটবর্তী রাজ্য সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি বেশ দূরে থাকার জন্য, তাও নদী পার হয়ে যেতে হবে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা ছোট খাটো ইমার্জেন্সিতে আমার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতেন এবং তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা আমায় করতে হতো।
একদিন দুপুরে আউটডোর শেষ করে খেতে গিয়েছি, একজন স্বাস্থ্যকর্মী ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এলেন। ‘স্যার, ইমার্জেন্সি কেস এসেছে’ । ওঁর হাবভাব দেখেই বুঝলাম, কিঞ্চিৎ গড়বড়।
তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি, রক্তাপ্লুত এক যুবক। তার সঙ্গের সাথীরা মদিরার প্রভাবে বিশেষ উত্তেজিত। দুএকজনের দেহে পুরনো ক্ষতচিহ্ন তাদের ক্ষমতা এবং পেশার দৃষ্টান্ত বহন করছে। এই ভদ্রলোকটিকে পরীক্ষা করে দেখি, তাঁর একটি কান কোনো ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রায় ছিন্ন হয়ে গেছে, একদম প্রান্তে ঝুলছে। অবিলম্বে অপারেশন করে জোড়া লাগাতে হবে। তার জন্য বড়ো হাসপাতালে পাঠানো প্রয়োজন। সমস্যা হলো, নৌকায় করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, এসব বলে এই মদিরা প্রভাবিত বিশেষ পেশার সঙ্গী সাথীদের কতটা বোঝাতে পারব বা সে কথা বললে, যে অস্ত্র দ্বারা ওই কর্ণটি ছিন্ন হয়েছে সেটি আমার এই ক্ষুদ্র পেটে প্রোথিত হবে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম না। তাই নিজেই কিঞ্চিৎ চেষ্টা করবো বলে ভাবলাম।
মুশকিল হলো, এই ক্ষুদ্র স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এই ধরনের অপারেশন স্মরণাতীত কালের মধ্যে হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস ছিলো না। অপারেশনের যন্ত্রপাতির অবস্থাও সহযেই অনুমেয়। যাইহোক কিছু যন্ত্রপাতি বেছে নিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিলাম। কয়েকটি সেলাইয়ের সুতোও বহু খুঁজে বের হলো।
ভদ্রলোক যন্ত্রণায় খুবই ছটফট করছিলেন আর ওনার সুযোগ্য সাথীরা বেশ উতপ্ত বোধ করছিলেন। কাল বিলম্ব না করে ওনাকে ঘুমের ইনজেকশন দিলাম এবং মদিরার প্রভাব হেতু উনি দ্রুতই নিদ্রাভিভূত হলেন। লোকাল অ্যানাস্থেসিয়া দিয়ে ক্ষতস্থানটি ভালো করে পরিষ্কার করলাম। তারপর সাবধানে সেলাই শুরু করলাম। কর্তিত কর্ণ জোড়া লাগানোর অপারেশন একটু কঠিন, তার ওপর কোনো সহকারী ছাড়াই, বিশেষতঃ মদিরা প্রভাবান্বিত রোগী ও তার বিশেষ পেশার সঙ্গীসাথীদের রক্তিম চোখের সামনে।
যাইহোক শেষ মেষ অপারেশনটি ভালোয় ভালোয় শেষ করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলাম। সেদিনের মতো ওষুধও ওনার সাথীদের হাতে তুলে দিলাম। পরবর্তী ফলোআপের জন্য নদীর ওপারে রাজ্য সরকারী হাসপাতালে যেতে বললাম। আর অ্যান্টিবায়োটিকের বাকি কোর্স কিনে নিতে হবে অথবা রাজ্য সরকারী হাসপাতাল থেকে যোগাড় করতে হবে বলে দিলাম।
এইবারে কিন্তু ওনার সঙ্গীরা বেঁকে বসলেন। আমাকে ওষুধের পুরো কোর্সই দিতে হবে বলে দাবি জানালেন। আলো বাতাসহীন একটি ছোট্ট ড্রেসিং রুমে দীর্ঘক্ষণ ধরে এই অপারেশনটি করার পর ঘেমে নেয়ে আমি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম, আমি যথেষ্ট করেছি আর কিছুই আমি করতে পারবো না। বলেই আমি ওখান থেকে বেরিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি ছোট্ট ঘরে আমি থাকতাম, সেখানে চলে গেলাম।
ভদ্রলোকেরা কিঞ্চিৎ বাকবিতন্ডার পর বিদায় নিলেন। নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের পর্দা উঠলো রাত্রির মধ্য যামে। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ ঘরের দরজায় লাথির শব্দ ও তীব্রতর গালাগালিতে ঘুম ভাঙ্গলো।
ভদ্রমহোদয়েরা আমার পিতৃকুল, মাতৃকুল এবং বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের মধ্যে যে সব সঙ্কর প্রাণীকুলের জন্ম বৃত্তান্তের ফিরিস্তি শুরু করলেন, তা শুনলে গ্রেগর যোহান মেন্ডেল সাহেব কবরে পাশ ফিরতেন। অভিযোগ একটাই, কেন আমি সব ওষুধের পুরো কোর্স দিইনি।
তেত্রিশ বছর আগের কথা, তখনও আমি এখনকার মত দরকচা মেরে যাইনি। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে সমবেত ভদ্রমহোদয়দের মুখোমুখি হলাম। দেখলাম, জনাদশ পনেরো লোক, সকলেই মদিরার প্রভাবে টলায়মান। নেতৃত্বে স্থানীয় যুবনেতা। আমায় দেখে, গালাগালির ডেসিবল কিঞ্চিৎ বাড়লো। আমি ভালো মানুষের সন্তানদের একটি কথাই বললাম যে, তাঁরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, কিন্তু আমি আর কোন ওষুধ দিতে অপারগ। বলে আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম। ভদ্রমহোদয়েরা আরও কিছুক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করে বিদায় নিলেন।
তবে এর পরে আর এঁরা আমার জন্য কোনো দুঃস্বপ্ন বরাদ্দ করে রাখেননি। বেশ কিছু বছর বাদে ওই যুবনেতার ভাই পায়ের হাড় ভেঙে আমার কাছে ভর্তি হয়ে ছিলো, তখন উনি প্রায় আভূমি প্রণত হয়ে আমায় জিগ্যেস করেছিলেন, ‘আমি ওঁকে চিনতে পারছি কি না?’ আমি বললাম, ‘বিলক্ষণ’।ওঁর ভাই ভালো ভাবেই সুস্থ হয়ে উঠেছিল। একটি পরিকাঠামোহীন ক্ষুদ্র স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বিনা সহকারীতে ছিন্ন কান জোড়া দেওয়ার মতো অপারেশন করার তৃপ্তি আমি পেয়েছিলাম। মূল্য হয়তো পেয়েছি কিছু পরুষ বাক্য। কিই বা যায় আসে তাতে।
..দিনের পথিক মনে রেখ, আমি চলেছিলেম রাতে, সন্ধ্যা প্রদীপ নিয়ে হাতে।
🌹অনেক দিন তোমার লেখা পড়ার অপেক্ষায় ছিলাম l ভালো লাগলো l❤️
অনেক ধন্যবাদ।
এক জীবনে বেঁচে থাকে লক্ষ জীবন সাথে নিয়ে …
🙏🙏, সে তো অসাধারণের জীবন, আটপৌরের জীবন তো নয়।
খুব ভালো লাগলো। আরও অনেক লিখুন।
অনেক ধন্যবাদ।🙏🙏
খুব ভাল লাগল। এই অভিজ্ঞতার কথা পড়তে যত ভল বাস্তবে ততই ভয়ানক।
অনেক ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।