যতদূর মনে পড়ে সালটা উনিশশ’ পঁচাত্তর। তখন মেডিকেল কলেজে পড়ি।
আমার মায়ের শরীর খুব খারাপ। ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড। প্রভাতদা’ কে ধরলাম। প্রভাত ঘোষ। গাইনির হাউসস্টাফ। তাঁর স্যারের আন্ডারেই অপারেশনের ব্যবস্থা হল।
এখন আন্দাজ করা যাবে না। তখনকার দিনে কিন্তু মেডিকেল কলেজের ছাত্র চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই নিজেদের পরিজনদের চিকিৎসার ব্যাপারে নির্ভর করতেন মেডিকেল কলেজগুলোর ওপরই। এখন ক্ষেত্র বদলেছে। বেসরকারি ব্যবস্থার কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে পুরনো আস্থাটা।
নানান পরীক্ষা নীরিক্ষার পরে ইতিমধ্যে এক দিন মায়ের অপারেশনের ডেট চলে এল। ইডেন হাসপাতালের ওটির সামনে, প্রশস্ত বারান্দায়, অপারেশনের রোগীর বাড়ির লোকেরা অপেক্ষা করতেন। আমরা মানে আমি বাবা আর গুটি কতক আত্মীয় স্বজন সমবেত হয়েছি। মাকে ওয়ার্ড থেকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
মূল দরজায় ঢোকবার আগে উৎকণ্ঠিত প্রত্যেকের কাছ থেকে মা বিদায় নিচ্ছেন। মেজর অপারেশনের আগে মধ্যবিত্ত আবহে তখন ওইটিই ছিল দস্তুর। অপারেশন থিয়েটার থেকে ফেরা যেন বা ভারি অনিশ্চিত। না ও হতে পারে।
একে একে সবার হাত ধরে একমাত্র পুত্র আমাকে দেখিয়ে মা বলছেন, ছেলেটা রইল, ওকে দেখো।
অন্যরা কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে, চিন্তা কোরো না। আমরা তো আছি।
দু একজন, বলছেন, কোনও ভয় নেই। অপারেশনের পর সেরে উঠবে ঠিকই।
বাবা এই জটলার মধ্যে নেই। পত্নীবিয়োগের আসন্ন আশঙ্কায় মুখ কালো করে দূরে একপাশে।
এ’বার মাকে ভেতরে ঢোকানো হবে। আমি উৎকণ্ঠিত। বাবার সঙ্গে বিদায়পর্বটা হল না ভেবে।
বাবা দৌড়ে উঠে এসে অনুযোগের সুরে মাকে বললেন, আমার সোয়েটারটা কিন্তু বোনা শেষ হয়নি এখনও। ও’টার কী হবে?
সেই বাবা এখন নব্বই। মা প্রবল ভালোবাসায় এখনও শাসন করে চলেছেন, ঘিরে রয়েছেন আমার অসহায় বাবাকে।
★
ছয় বছর আগের এই লেখা। বাবা চলে গেছেন। নব্বই পার মা অধুনা স্মৃতিলুপ্ত।
আমরা বুনছি। বুনেই চলেছি ভালোবাসার ওম মাখানো চির-অসমাপ্ত সেই শীতবস্ত্রখানি।