অস্ত গেছে চাঁদ আর সপ্তর্ষিমন্ডল, এখন অর্ধেক রাত্রি, কাল বয়ে যায়, তবুও নিঃসঙ্গ আমি আমার শয্যায়।
(গ্রীক কবি সাপফো, বাণী রায়ের অনুবাদ)
অর্ধেক রাত পেরিয়ে গেছে। ঘুম আসে না। অর্থাভাবে মদ্যপানে ক্ষণিক বিরতি, করোনায় মানদাসুন্দরীর চুল্লুর ঠেক বন্ধ। চোখ জুড়ে স্মৃতি ভীড় করে’ আসে। মনে পড়ে সেই কিশোরের কথা।তখন আমি ওষুধের দোকানে-চারফুট বাই ছ’ফুট একটা খুপরিতে বসি। দেওয়ালে একটা ফ্যান প্রিয়ার চুলের মৃদু গন্ধের মতো মৃদু হাওয়া ছড়াচ্ছে। মাঝে মাঝেই আমাকে বেরিয়ে এসে বাতাস টানতে হতো। একবার বেরিয়ে এসে’ দেখি- এক দম্পতি বসে আছেন, মাঝে তাঁদের বাচ্চা। মাথায় একটা চুল নেই। হনু উঠে আছে, চোখ কোটরে। মাথাটা এলিয়ে আছে বাবার কোলে। মনে হচ্ছে আমার কাছে অন্তিম সাক্ষাৎকারের জন্য এসেছে। অনেক শেষে নাম। নির্দ্বিধায় আমি ওঁদের ডেকে নিলাম। ক্যানসার রোগী। ওখান থেকেই সোজা হাসপাতাল। পরদিন সকালে বাবা আমাকে জানিয়ে গেলেন ওঁদের সন্তানের মৃতদেহ সকালেই বাড়ি নিয়ে এসেছেন। অথচ অতোগুলো সুস্থ, স্বাভাবিক, রাজনীতি সচেতন নাগরিক কেউ বলে নি আগে দেখিয়ে নিতে। বাচ্চাটার মৃত্যু অবধারিত ছিলো। তবু….সবাই কি দার্শনিক, না স্বার্থপর?মাথা ছাড়িয়ে ঘুম চলে যায় সিলিং ফ্যানের কাছাকাছি। ন্নাহ্ এসব আর ভাববো না। বরং মিষ্টি কথা ভাবি।
একদিন চৈত্রের খরসান দুপুর। রোগীপত্র শেষ করে’ দরজা ঠেলে দেখি একটা মিষ্টি তরুণী, ছোটো ছোটো চুল, চশমা চোখে সেই মেয়ে,ভাবভঙ্গিতে একটা চাঞ্চল্য আছে। ভেতরে ডাকলাম তাকে। নাম সুমা বন্দ্যোপাধ্যায় (সুমাদেবীর অনুমতিক্রমে)। ই-টিভিতে কাজ করে। আলোয় ফেরা বলে একটা চিকিৎসা সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে আমি যাবো কিনা জানতে এসেছে। অর্থাৎ খুব খারাপ রোগীর জীবনে ফেরার গল্প। (অহঙ্কার করতে গুরুর বারণ আছে) তবু জানি না কেন, এই ক্ষুদ্র, দীন জীবনটা এই সব স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
একজন রোগী দীর্ঘদিন আমাকে দেখাতো। হঠাৎ তার জ্বর আর প্রবল শ্বাসকষ্ট, বুকের ছবি টবি দেখে তাকে বাইপাস সংলগ্ন একটা হাসপাতালে পাঠালাম। তখন ঐতিহাসিক পুরাকাল।বাইপাস সতশ্চলচ্ছকটহীন ফাঁকা থাকতো। একটা দুটো হাসপাতাল খুলেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রোগীর ছেলে, ছেলের বৌ এসে রোগীর খবর দিয়ে যায়। অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে।অবশেষে হলো অর্থাভাব। ওরা নিয়ে এলো কাছের একটা নার্সিং হোমে। আমার দায়িত্বে। রোগীর বুকের ছবি দেখে, হ্রীয়মান নাড়ি আর অক্সিজেনের মাত্রা দেখে আমারই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো তরুণ হাতুড়ে হিসেবে ঝুঁকিটা বেশী নিয়েছি। ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসলাম। ঐ বড়ো হাসপাতাল সব পরীক্ষা করেছে। কিছুই পায়নি।
তার মানে ব্যতিক্রমী কোনও অসুখ। প্রচুর প্রশ্নে জানা গেলো রোগীর বাড়িতে জ্যান্ত গরু আছে। দুধও পাওয়া যায়। আরও কিছু জন্তু জানোয়ার বাড়িতে থাকে। তাহলে কি এটাই কারণ?
ব্রুসেলা বলে একটা রোগ আছে। এটার পরীক্ষা করতে দিলাম।যদি মিলে যায় তাহলে বাজিমাৎ। নাহলে হাত তুলে দেবো। হার মানবো। পুরু যেমন আলেকজান্ডারের কাছে হার মেনেছিলেন সেই রকম।
কিন্তু সেদিনটা আমার জন্য বরাদ্দ ছিলো। ব্রুসেলা পজিটিভ বেরোলো। মূলতঃ গরু থেকে বা গরুর কাঁচা দুধ থেকে হয়।চিকিৎসা পদ্ধতি হাতুড়ের পক্ষেও বেশ সহজ। তিনদিন পরে রোগী বাড়ি গেল।
টিভির সাক্ষাৎকারে রোগীর বাড়ির লোক আর হাতুড়ে দুজনেই উপস্থিত ছিলো।
এই মহতী করোনাকালে করোনাঘটিত নিউমোনিয়া নিয়ে কিছু তো লিখতেই হয়। লিখতে গিয়ে হঠাৎ আরেকটা সুখের অসুখ-স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। সেটা লিখেই চলে যাবো করোনা-নিউমোনিয়া-স্মৃতিচারণে।
সেই রামগড়ের খুপচি খুপরি। একটা বাচ্চা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী চোখে সব কিছু দেখতে পাচ্ছে না। চোখের নামকরা সব বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন। কিচ্ছু পাননি। বলেছেন পরীক্ষা ভীতি।এখন, সব ছেড়ে যেমন শেষকালে ওঝা, কবচ, তাবিজ, তেমনই সব আশা ছেড়ে রোগীর বাড়ির লোক নগণ্য ক্ষুদ্রবুদ্ধি, আধাপাগল, খুপরিজীবী হাতুড়ের কাছে হাজির। হাতুড়ে চোখের সামনে হাত, আঙ্গুল সব নাড়িয়ে চাড়িয়ে, আধাভৌতিক প্রক্রিয়ায় দেখলো- সত্যিই রোগী (অবশ্যই নাম মনে আছে, বুড়ো বয়সে পুরোনো স্মৃতি প্রবল হয়) চোখের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না। অপটিক কায়জমা টিউমার। মধ্যবিত্ত রোগী।বাবা কার্যতঃ বেকার। চাঁদা তুলে অপারেশন হলো। স্টেটসম্যান লিখলো “কলকাতায় বিরল ব্রেইন টিউমার অপারেশন। স্থানীয় হাতুড়ে শ্রীমান দীপঙ্কর এই রোগটি ধরে’ ফেলেন। অপারেশন করেন ডাক্তার…..ঘোষ” (হুঁ হুঁ বাওয়া খবরের কাগজ।এটাকেও আত্মনামে হুহুঙ্কার বলা যায়। দক্ষিণা তো সব সময় টঙ্কা দিয়ে হিসেব হয় না। কখনও আত্মতৃপ্তিটাই দক্ষিণা হয়ে দেখা দেয়)।
এবার আসি করোনা নিউমোনিয়ায়। একজন বৃদ্ধ ডায়াবেটিক এলেন জ্বর, আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে। করোনা পজিটিভ। আইএল সিক্স, ডি-ডাইমার আর এলডিএইচ খুব বেশী। বুকের সিটি গ্রাউন্ড গ্লাস ওপাসিটি। হাসপাতাল। আইসিইউ। তারপর আবার কন্যার আগমন মাস দেড়েক পরে। ওনার পিতাশ্রী এখনও সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী। উঠলেই হাঁফাচ্ছেন। সব সময় অক্সিজেন লাগছে। এবারের বুকের সিটি দেখালো পোস্ট কোভিড পালমোনারি ফাইব্রোসিস। কিছু গতের ওষুধ পত্তর, কিছু অপরিচিত নতুন ওষুধ। আশ্চর্যের ব্যাপার আবার ছ’মাস পরে বুড়ো আজকের বুড়ো হাতুড়ের খুপরিতে এসে হাজির। আমার কয়েক শো কোভিডের ভীড়ে কয়েকজন মাত্র মারা গেছেন। প্রথমেই চিকিৎসা করান। সঠিক বাস্তব চিকিৎসা। মনে হয় চিকিৎসকদের একটা নির্দিষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসায় চলে যাওয়া উচিত। এবং এবার বেশীরভাগ কোভিড রোগীর নাকের বা গলার পরীক্ষায় কিছু না’ও পাওয়া যেতে পারে। মুখোশ পরুন। ভালো থাকুন।
যখন ভাবি মুর্শিদাবাদে চাষী ষাঠ কেজি মিনিকিট চাল দালালের কাছে ন’শো টাকায় বিক্রি করে আর আমরা সেই চাল বাজারে পঁয়তাল্লিশ টাকা কিলো করে কিনি তখন দেশী বোতল ছাড়া অন্য কিছুতেই মাথার জ্বালা আর কমে না। তখন ধর্মকর্ম সব চুলোয় যায়। পড়ে থাকে শুধু ভৃঙ্গার আর শিরাজী।
মসজিদ আর নামাজ রোজার থামাও থামাও গুণ গাওয়া,
যাও গিয়ে খুব শারাব পিও, যেমন করেই যাক পাওয়া!
খৈয়াম, তুই পান করে যা, তোর ধূলিতে কোন একদিন
তৈরি হবে পেয়ালা, কুঁজো, গাগরি গেলাস মদ-খাওয়া।
[ওমর খৈয়াম (নজরুলকৃত অনুবাদ), খৈয়াম কোনোদিন মদ পান করেন নি।]
অসামান্য।
ধন্যবাদ দাদা