যে সময়টার কথা বলছি সেটা খুব পুরনো নয়।
বিংশ শতাব্দী সে বছরই পা দিতে চলেছে একবিংশতে। Y2K নিয়ে আলোচনা তখন চরমে। নতুন ক্যালেন্ডার কেমন দেখতে হবে,আর নতুন কম্পিউটারই বা কিভাবে সামলে নেবে তাদের সফটওয়্যারের তারিখ বদলানোর সমস্যা তা নিয়েই উত্তাল তখন গোটা পৃথিবী।
কিন্তু পরিশেষে দেখা গেল মিলেনিয়াম বদলে গেলেও পালটানো না কিছুই। যেমন জীবনে হয় আর কি! সব কিছুই চলতে থাকে আগের মতোই।
কম্পিউটার সামলে নিল সব অসুবিধে আর আমরাও উত্তেজনা প্রশমন করে চালিয়ে যেতে লাগলাম নিজেদের রুটিনমাফিক জীবনচর্চা।
সেই সময়টা আসলে আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যার সুবাদে এই সাতকাহনের অবতারণা।
ঠিক কিছুদিন আগেই ধীরে ধীরে আমার পেশাদার জীবন শুরু হয়েছে। দিনের বেলা হাসপাতালের চাকরির সাথে সাথে সন্ধ্যাবেলায় পাড়ার একটি ছোট ওষুধের দোকানে বসতে শুরু করেছি আমি।
আজ থেকে বছর কুড়ি আগের ঘটনা হলেও মনে হয় যেন সেদিনের। তার অন্যতম কারণ আমাদের এই এলাকা শেষ দুই দশকে চালচিত্র বিশেষ পাল্টাতে পারেনি। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, দোকানপাট সব রয়ে গেছে প্রায় একইরকম।
শুধুমাত্র অঞ্চলের গা দিয়ে লম্বা রাস্তা হয়ে বেরিয়ে গিয়েছে রাসবিহারী কানেক্টর। তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে শপিং মল, দামী হোটেল, বহুতল অথবা বাজার দোকান।
কিন্তু কসবার অভ্যন্তর রয়ে গিয়েছে পুরনো কসবাতেই। সেই আশি বা নব্বইয়ের দশকেই যেন পড়ে রয়েছে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
আমার প্রথম চেম্বারের কথায় ফিরে আসি আবার।
ছোট দোকান ঘর। ততধিক ছোট্ট তার ডাক্তারের বসবার জায়গা; এক পলকা পার্টিশন দিয়ে দোকান ঘর থেকে আলাদা করা। সে ঘরের আশি ভাগ স্থান দখল করে আছে একটা পুরনো আমকাঠের একজামিনেশন টেবিল যার তলায় ঠাসা বিভিন্ন কাগজপত্র এবং অব্যবহৃত ওষুধ। এতই জিনিসপত্রের ভীড় সেখানে যে অসাবধানে
রোগীর পকেট থেকে খুচরো পয়সা টেবিলের তলায় পড়ে গেলে তা খুঁজে পাওয়া শুধু কঠিন নয়,অসম্ভব। টেবিলটি আবার অবসর সময়ে মালিকের নিরিবিলি ঘুমের বন্দোবস্ত করে দেয়।
এককোনে ঠেসাঠেসি করে বসে আছে কাঠের টেবিল চেয়ার। ডাক্তার বসলে নড়ার জায়গা নেই। পাশের এক ছোট কাঠের টুলে রোগীর বসার জায়গা। বাড়ির লোক এলে তার জায়গা হয় দরজার পাশে, নয়তো বাইরের কাঠের বেঞ্চিতে।
দরজায় একটা জ্যালজেলে ফিকে হয়ে যাওয়া সবুজ পর্দা তার খেয়ালখুশি মতো সম্ভ্রম রক্ষা করছে অন্দরমহলের। একজামিনেশন টেবিলে রোগী উঠলে ডাক্তারকে কোনমতে সেই পলকা পার্টিশন বাঁচিয়ে দাঁড়াতে হবে পরীক্ষা করার জন্য, এতটাই কম জায়গা সেখানে।
টেবিলের এক পাশে নোনাধরা দেওয়াল উঠে গেছে।সেখানে সাঁটানো ক্যালেন্ডারে জ্বলজ্বল করছেন মহামায়া, দোকানের নামের সাথে সাযুজ্য বজায় রেখে। তার একটুখানি উপরে লাগানো রয়েছে একটা ছোট্ট ফ্যান, যা আওয়াজ করে বেশী আর হাওয়া দেয় কম।
রোগীর মধ্যে বেশিরভাগ এলাকার গরীব বস্তিবাসী জনগণ আর তার সাথে ডাক্তারের নিজস্ব পরিচিত কিছু মানুষ। দোকানের মালিক বেশিরভাগ সময় ডাক্তার না থাকায় নিজেই চিকিৎসা করতে উৎসাহী। কিছুটা নিজের ব্যবসা চালানোর বাধ্যবাধকতায় আর কিছুটা ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষায়।
আমি পেশায় নতুন। আমার এসব ভাবলে চলবে কেমন করে। তাই যতটুকু সময় পাই চেষ্টা করি সঠিক চিকিৎসা করার। আমার বসবার সময় রাত ৮ টার পর। মাঝে মাঝে রাতের দিকে চেম্বার শেষে ‘কলে’ যেতে হয় অসুস্থ রোগীর বাড়িতে। অনেক সময় চেম্বার লাগোয়া বস্তিতে কিম্বা পুকুর পেরিয়ে গোরুর খাটালের ভিতর দিয়ে গোবর টপকে পৌঁছোতে হয় পেসেন্টের ঘরে।
সেই সময় টুকটাক লোডশেডিং হত প্রায়ই। মোমবাতি জ্বালিয়ে রোগীও দেখতে হতো মাঝেমধ্যে। বেশিক্ষণ গরমের চোটে ভিতরে বসা না গেলে, বাইরে সিগারেট খুঁজতে বেরিয়ে পড়তাম।
এরকমই এক রাতের কথা বলি। প্রায় রাত দশটা বাজতে চলেছে তখন। আমিও শেষ রোগী দেখে বাড়ি ফেরার কথা ভাবছি।
আচমকাই খুব কাছাকাছি দু তিনটি বোমার শব্দে সচকিত হলাম। কসবা বরাবরই উপদ্রুত অঞ্চল। সেই সত্তরের দশক থেকেই এখানে দেখে আসছি সমাজবিরোধীদের রমরমা। তবু্ও সাতাত্তরে রাজনৈতিক পালাবদলের পর তুলনামূলক ভাবে শান্ত থাকলেও মাঝেমাঝেই বখরা নিয়ে গোলমাল বাঁধলে, মাস্তানরা নেমে পড়ে রাস্তায়। শুরু হয়ে যায় বোমাবাজি আর এলাকা দখলের লড়াই। একটা সময় তো এখানে দিনেদুপুরে ট্যাক্সি চালকেরা পর্যন্ত ঢুকতে অস্বীকার করতেন।
যাক সে কথা, ফিরে আসা যাক আজকের ঘটনায়।
বোমার শব্দে আমি চেম্বারের দরজায় ঝুলতে থাকা লজ্জানিবারণী পর্দাটা সরিয়ে, দোকানের মালিককে জিজ্ঞাসা করলাম- কি ব্যাপার? কোথায় বোম পড়ছে?
মালিক উত্তর দেওয়ার আগেই তড়িৎ গতিতে দোকানে প্রবেশ করলো এক আগন্তুক। উঠতি যুবক, শ্যামলা রঙ,হাত চেপে রেখেছে মাথায়। সাদা টি শার্ট রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। মাথার ক্ষতে চেপে রাখা হাত ছাপিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে দু কানের পাশ দিয়ে।
“ডাক্তারবাবু আমাকে বাঁচান। চপার মেরেছে আমার মাথায়। আপনি না বাঁচালে আমি বাঁচবো না।” সে সটান শুয়ে পড়লো দোকানের ভিতরে রাখা কাঠের বেঞ্চিতে।
আমি আর দোকানদার দুজনেই কিংকর্তব্যবিমুঢ়।
এদিকে বোমের আওয়াজে মূহুর্তের মধ্যে এলাকা শুনশান।
শুধু আমার মনে পড়লো চেম্বারের ভিতরের টেবিলের ভাঙা ড্রয়ারে আমি সূঁচ সুতো দেখেছিলাম একদিন। দোকানের মালিক যে মাঝে মাঝে কম্পাউন্ডারি করেন তার সাক্ষী দিচ্ছে সেদিন থেকেই।
এদিকে ছেলেটির প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে মাথা থেকে।
দেখেই বোঝা যাচ্ছে চপার দিয়ে আঘাত করা হয়েছে একদম ব্রম্মতালুতে। আর দেরী করলে জীবন সংশয় হবে। এদিকে দোকানের আশেপাশে কোন জনগণের দেখা নেই। দু একটা সিগারেটের দোকান যদিও বা খোলা ছিল তাও বন্ধ হয়ে গেছে রক্তাক্ত ছেলেটিকে ওষুধের দোকানে প্রবেশ করতে দেখে।
কোন অ্যাম্বুলেন্সের বন্দোবস্ত করে হাসপাতালে পাঠানোর মতো সময় নেই হাতে।
তাছাড়া আমার ট্রেনিং যেহেতু সার্জারিতে, তাই এই যুবকটির ইঞ্জুরি দেখবার পর থেকেই আমার ভিতরকার সার্জেনটা আমাকে খোঁচাতে শুরু করেছিল ভীষণ ভাবে। আমি মালিকের দিকে একবার তাকিয়ে বললাম, “আমি করে দিচ্ছি।”
মালিক কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন হয়তো। হয়তো ভাবছিলেন কিছু হয়ে গেলে পরবর্তী বিপদের কথা।
কিন্তু আমার কথা বলার ধরণে আর কিছু বলতে পারেন নি।
এখনকার মতো এতটা খারাপ না হলেও তখনও দিনকাল ডাক্তারদের জন্য খারাপই ছিল। অনভিজ্ঞ ডাক্তারদের জন্য তো বটেই।
কিন্তু ছেলেটিকে টেবিলে তুলে আমি বুঝতে পারলাম কাজের অসুবিধার কথা। একে তো সেলাই করার যন্ত্রপাতি মোটামুটি মান্ধাতার আমলের। তার সাথে ভিতরে যে ঝিমিয়ে পড়া টিউব লাইটের আলো আছে, তাতে এই গভীর ক্ষতস্থানে সেলাই করা খুবই দুষ্কর ব্যাপার।
কিন্তু কিছু করার নেই এখন। চ্যালেঞ্জটা না বুঝেই যখন নিয়ে ফেলেছি, বাধা অতিক্রম করতে হবে যেভাবেই হোক।এদিকে ছেলেটা ক্রমাগত বলে চলেছে অন্য আর এক মাস্তানের নাম। সম্ভবত সেই লোকটিই এই আঘাতের জন্য দায়ী। আর সে এটাও জানাচ্ছে যে আমি ওর ক্ষতস্থান সেলাই করে দিলেই সে বেরিয়ে পড়বে বদলা নিতে।
এর মধ্যে খুঁজে দেখলাম দোকানে কোন লোকাল অ্যানেসথেশিয়ার বন্দোবস্ত নেই। অতএব আমার এই অপারেশনটি চলাকালীন যাবতীয় যন্ত্রনা সহ্য করতে হবে যুবকটিকে।
কিন্তু এখন এইসব আলোচনার সময় নয়। প্রতিমুহূর্তে বেড়ে যাচ্ছে রক্তক্ষরণ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সমস্যা।রোগীর সাথে ডাক্তারেরও। এর কিছু হয়ে গেলে আমার বিপদও কম নয়।
আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। মালিকের হাতে একটা বড় টর্চ ধরিয়ে শুরু করে দিলাম আমার সূচিকর্ম। প্রায় আট ইঞ্চি লম্বা কাট ইঞ্জুরি, স্ক্যাল্পের সব লেয়ারগুলি কেটে একদম খুলির হাড় অবধি পৌঁছে গেছে। কিন্তু হাড় ভাঙতে পারেনি সেই আঘাত। তাহলে সেই অবস্থায় ছুটে আসতে পারতো বলে মনে হয় না। সেলাই করতে করতে লক্ষ্য করলাম জমে থাকা রক্তের তলায় তখন ও জেগে আছে রক্ত ধমনী, রক্তপাত হয়ে চলেছে সেখান থেকেও।তবে আজ আর কিছু করার নেই; ঠিক করলাম, সবাইকেই বন্দী করে দেব সেলাইয়ের বেষ্টনীতে।
আশ্চর্যের কথা সূঁচে এফোঁড়ওফোঁড় হয়েও ছেলেটি যন্ত্রণায় এতটুকুও আওয়াজ করছে না।
প্রচন্ড গরম আর আলোআঁধারিতে কাজ করতে করতে আমি লক্ষ্য করলাম যে ছেলেটির বাঁ কানে একটা দুল রয়েছে। এই দুর্বল আলোর মধ্যেও মাঝে মাঝে ঝিলিক দিচ্ছে সেটা।
এদিকে বাইরে মানুষের পায়ের আওয়াজ বাড়ছে ধীরে ধীরে। মালিক এক ফাঁকে বাইরে ঘুরে এসে বললো,”তুমি বেরিয়ো না এখন। বাইরের লোকগুলো ভালো নয়। পুলিশ এখনো আসেনি।”
সেলাই শেষে আমি ছেলেটির ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করে দিলাম। হাতের গ্লাভস দুটো খুলে আমি যখন প্রেসক্রিপশন লিখছি, ছেলেটি উঠে বসলো। টেবিল থেকেই আমায় বলল, “ডাক্তার বাবু আপনি ওষুধ লিখে দিন। আমি পরে এসে নিয়ে যাব।”
আমি কিছু বলার আগেই সে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। আর দোকানের বাইরে উপস্থিত সেই
রহস্যময় জনতাও তার সাথে সাথে নিষ্ক্রান্ত হলো।
ব্রিফকেসটা তুলে নিয়ে যখন চেম্বার থেকে বের হতে যাচ্ছি তখন অদূরেই কোথাও আবার পরপর বোমের আওয়াজ।
আমি এবার একটু দ্রুত গতিতে বাড়ির পথ ধরলাম।দোকানও বন্ধ হয়ে গেল।
এক রাত্তিরে দুবার এই দুঃসহ সেলাই করার অভিজ্ঞতায় পড়তে আর রাজি নই। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে দেখলাম পুলিশের জীপ এলাকায় টহল দিতে শুরু করেছে।
ছেলেটি তারপর আর আমার কাছে আসেনি। তার কি হয়েছিল সে খবরও আমার জানা ছিল না। ঠিক বছর তিনেক বাদে আমি পিকনিক গার্ডেন মিনি বাসে করে বাড়ি ফিরছি, কোথা থেকে ঠিক মনে নেই এখন।
মাথায় টুপি পরা সেই বাসের কন্ডাকটর আমার দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। আমি পকেট থেকে পয়সা বার করে টিকিটের দাম দিতে গেলাম। সে বললে, “লাগবে না স্যার”। আমি অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। সে হাসলো কিন্তু কোন জবাব দিল না।
আমি সারা রাস্তা ভাবতে ভাবতে চললাম কি হতে পারে।
বাস থেকে নামার সময় চোখচোখি হতেই ছেলেটি আবার হাসলো। আচমকাই লক্ষ্য করলাম ওর বাঁ কানের ঝকঝকে দুলটা। এই দিনের বেলাতেও ঝিলিক দিচ্ছে।