লেখালিখি বহুদিন যাবৎ বন্ধ হয়ে গেছে, বেসুরো গানের সভাও স্তব্ধ হয়েছে, গিটার উঠেছে আলমারির ছাদে। বাড়ি ও তার সদস্যদের দেখাশোনা করা হয়না, দেখাসাক্ষাৎ হয় যৎকিঞ্চিৎ। কারণ বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে কার্ডিওলজি-তে ডি.এম. পড়ার। কেন হয়েছে জানি না। তবে অঙ্ক ছেড়ে জীববিদ্যায় যখন মনোনিবেশ করলাম, সেই পরিবর্তনটা হয়েছিল এই অঙ্গের হাত ধরেই। তাই হয়তো সেই আবেশ থেকে এখনো বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। যাই হোক সেই গল্প আলাদা।
জীবন এখন ঘটনাবহুল, তবে সেই ঘটনার ‘সাহিত্যিকরণের’ অবসর বিশেষ নেই। গত তিন মাসে বেশ বুড়িয়ে গেছি অভিজ্ঞতার নিরিখে, সে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা বলে শেষ করা যায়না।
মানুষের মধ্যেই যে ঈশ্বরের বাস, সেটা আগে মানতাম, এখন আরো দৃঢ়ভাবে মানি। তবে সেই ঈশ্বর কখনো রাম/ কৃষ্ণ অবতারে বিরাজ করেন, কখনো বরাহ অবতারে। দেখি কৃষ্ণভক্ত বুড়ো রক্ত টানার সময় কৃষ্ণনাম করতে করতে হাত চেপে ধরছে পাশের বেডের মুসলিম ছেলেটার, সেও তড়িঘড়ি ভায়ালটা এগিয়ে দিচ্ছে। হাসপাতালে বসে ভাবতেই অবাক লাগে বাইরের দুনিয়াটায় ধর্ম বেচে বরাহ অবতারেরা কীভাবে দেশটাকে লুটছে।
সেই বরাহ অবতারই আবার হাসপাতালে এসে ‘বাওয়াল’ করে, আজকাল তো দেখছি কিছু কিছু বরাহ গলায় স্টেথোস্কোপ নিয়েও ঘোরে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ঢালাও রাজনীতিকরণের এটা অবধারিত ফল। অবশ্য এদের নিয়ে কিছু বলা বারণ, শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে। গোটা রাজ্যের লোক যখন ভেন্টিলেশনে উঠে রাইলস টিউবে খাচ্ছে আর ডায়াপারে হাগছে, তখন তাকে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ানোর বাণী শোনানো এক প্রকার উলুবনে মুক্ত ছড়ানোর শামিল।
রাগ ছিল, গিলে ফেললাম, এবার ভালো কথায় আসি।
আমার আশ্চর্য এটাই লাগে পরমেশ্বর এই কৃষ্ণ অবতার এবং বরাহ অবতারে বিশেষ ফারাক করেন না। কিছু কিছু কৃষ্ণ অবতার অসুস্থ হচ্ছেন, এমনকি অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও তাঁদের বাঁচানো যাচ্ছে না। আবার অনেক বরাহ অবতারও অসুস্থ হচ্ছেন, তাঁদের সেরা চিকিৎসা দিয়েও প্রাণ বাঁচিয়েও খুশি করা যাচ্ছে না, ফেসবুকে গালমন্দ করছে। এসব তো গেল অভিমানের কথা। কিন্তু সত্যি সত্যিই প্রেসার, সুগার নিয়ে বিড়ি ফুঁকেও হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, আবার আমার বয়সী ছেলে, বিড়ি সিগারেট ছোঁয়নি, তারও হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে! ভগবানের দাবিটা কী? সে কী চায়? নারী চরিত্রের থেকেও জটিল ঈশ্বরের চরিত্র- এই শিক্ষাও পেলাম।
তিনমাসে নতুন বন্ধু হয়েছে প্রচুর। তার মধ্যে সব চেয়ে বেশি বন্ধুত্ব হয়েছে রোগীদের সাথে। তারা ভালোবেসে আমার ছয় কেজি চর্বি গিলে খেয়েছে, এখন বেশ হালকা লাগে। সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠে যাই মাস্ক পরেও, একটুও শ্বাসকষ্ট হয় না- ক’দিন আগেও হতো। এর জন্য আমি সকল রোগীদের কাছে কৃতজ্ঞ।
এদের মধ্যেই এক কৃষ্ণ অবতার রোগী ছিল, এক বুড়িমা- এখন সে আর নেই। তার হার্টে ব্লক ছিল, এনজিওপ্লাষ্টির জন্যে ভর্তি হয়েছিল। তাকে দেখার বিশেষ কেউ ছিল না, একজন মহিলা বেলার দিকে আসতো শুধু, বাদবাকি সময় ওয়ার্ডের মাসীদের ভরসায় থাকতো। ওটির দিন সকালে গিয়ে দেখি আগের রাত্রে বাথরুমে গিয়ে দিদা চিৎপটাং হয়েছে আর কব্জি ভেঙেছে!
তিনমাসে আমার এই বিশ্বাসও হয়েছে সকল বাথরুমে ভূত থাকে এবং তারা হার্ট অ্যাটাকের রুগী পেলেই ঘাড়ে চাপে। তাই আমি সব রোগীদের বলি বাথরুম যাবে না, বেড প্যান ব্যবহার করবে- কিন্তু তারা শোনে না। তারা যায় আর এরকমই বিভিন্ন অঘটন ঘটায়।
যাই হোক দিদা এমনিতেই খুব মায়াময় ছিল, হাত ভাঙার পর দিদার প্রতি মায়াটা একটু বেশিই হয়ে গেছিল। দিদার গাল টিপে বলতাম, বারণ করেছিলাম তাও গেলে তো, বেশ হয়েছে হাত ভেঙেছে! দিদার সেই আত্মীয়াও হাসতো। কিন্তু ঈশ্বরের এই মায়াও সহ্য হয়নি।
বুড়ির এনজিওপ্লাষ্টি তো লাটে উঠেছিলই, কিন্তু দিদার হঠাৎই লাল টকটকে প্রস্রাব শুরু হলো এবং কিছু বোঝার আগেই কিডনি জবাব দিলো। দিদাকে আইসিসিইউ-তে নামালাম। ওষুধপত্র দিলাম, ফ্লুইড দিলাম। মাঝে দেখলাম ক্রিয়েটিনিন কমলো, দিদার কথাবার্তা ভালো হলো। দিদা আমাকে বললো, “আমি আর বাঁচবো না”।
কোভিডে সিসিইউ ডিউটি করে আমি শিখেছি বয়স্ক লোকেরা এইকথা বললে সেটাই আল্টিমেট ধরে নেওয়া যায়। ওরা নির্ঘাত কিছু টের পায়। তাই বুড়ির রিপোর্ট ভালো হলেও প্রমাদ গুনেছিলাম দিদা বুঝি আর থাকবে না। পরদিন গিয়ে দেখি বুড়ি আবার খারাপ হয়ে গেছে, হাই ফ্লো মাস্কে অক্সিজেন দিলাম, এবিজি করলাম, ডায়ালিসিসের জন্য ফোন করলাম। আইসিসিইউ-র অভিজ্ঞ মেডিক্যাল অফিসার বললেন, এর জন্য এত কিছু করছো বটে, বেশি আশা রেখো না।
আমার তখন অনেক উদ্যম। বুড়িকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম, যাকে কিছুদিন আগেও হেসে কথা বলতে দেখেছি, তার এই পরিণতি মানতে পারিনি। কিন্তু কার্ডিওলজি জিনিসটাই তো তাই। ওষুধ খেয়ে পাঁচ বছর বাঁচতো, অপারেশন করে দশ বছর বাঁচতে গিয়ে কোনো কমপ্লিকেশনে রোগী পাঁচ মিনিটে শেষ হয়ে যেতে পারে- বাড়ির লোককে কী বলে সান্ত্বনা দেব তার ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। এত সব জেনেই তো কোর্সে আসা- তাও মন মানতে চায় না।
যাই হোক সেদিনই বুড়ির কষ্টের সমাপ্তি ঘটলো, আইসিসিইউ থেকে খবর নিয়ে আর ওই পানে যাইনি। জন্ম-মৃত্যু নিয়ে খেলার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কিছু মৃত্যু সমস্ত সত্ত্বাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়, এই মৃত্যুটাও সেরকমই। জাস্ট ভুলে যেতে চেয়েছিলাম একটা একদমই নিরীহ বুড়ির মৃত্যু, তার বাড়ির সেই মহিলাও খুবই ভদ্র ছিলেন, এসব রোগীর জন্য সত্যিই মন খারাপ হয়, আর মনে হয় সত্যিই কি ঈশ্বর আছেন? ন্যায় বলে কি সত্যিই কিছু আছে?
বাড়ি ফিরে জামা থেকে পেন বের করতে গিয়ে দেখি কি একটা কড়কড় করছে, হাতড়ে দেখি বুড়ির সকালের এবিজি রিপোর্টটা- বুড়ির শেষ স্মৃতি…