করোনার আবহেও এ রাজ্যের বাজারগুলোতে চরম ভিড়ের ছবি ধরা পড়েছে সবারই চোখে। কলকাতা থেকে দেড়শো কিমি দূরের এই মফঃস্বল শহরও তার ব্যতিক্রম না। শারীরিক দূরত্বের তোয়াক্কা না করেই এর ওর গায়ের ওপর গিয়ে পড়ছে অনেকেই। আর মাস্কের কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল…বেশির ভাগ লোক তো রুমাল বা গামছা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিচ্ছে, আর যাদের মাস্ক আছে তাদের খুব কম সংখ্যকই ঠিকমত নাক মুখ ঢেকে রাখছে। কিন্তু না খেয়ে তো আর থাকা যায় না, তাই এক সপ্তাহের বাজার একসাথেই করে নেন মনোজবাবু। আজ মাছের বাজারে একটু যেন বেশি ভিড়ই মনে হচ্ছে। কিন্তু চারিদিকে থরে থরে সাজানো রূপালী মাছগুলোর দিকে নজর পড়তেই আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। ভিড় ঠেলেই একজন মাছবিক্রেতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ইলিশ কত?”
–“এই গুলো সাতশো..এই পাশের গুলো আটশো..ওপাশের গুলো বারোশো…আর ঐ বড়গুলো..”
–“স্টোরের নয় তো?”
–“না বাবু! একদম কাঁচা ইলিশ… হাত দিয়েই দেখেন না!”
মনোজবাবু টিভির খবরেও শুনেছেন এবার প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছে, তাই আর দেরি না করে মাঝারি সাইজের গোলগাল একটা ইলিশ বেছে ওজন করতে বললেন। দাম মিটিয়ে মাছ নিয়ে বাজার থেকে বেরোতে যাবেন, এমন সময় পাশের ফ্ল্যাটের মুখার্জ্জী বাবুর সাথে দেখা। চোখাচোখি হতেই অবাক হয়ে বলে উঠলেন, “আরে দাদা আপনি! আপনার না সুগার আছে! এই ভিড়ে…সত্যি আপনারাই পারেন!”
মনোজবাবুর মাস্কটাও নাক থেকে সরে গেছে…দুহাতে দুটো ভারী ঝোলা থাকায় মাস্কটা তুলতেও পারছেন না। আমতা আমতা করে বলে উঠলেন, “না মানে ঐ ইলিশ কিনতে…”
কথা শেষ করার আগেই মুখার্জ্জী বাবু বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, “তা নাকটা বের করে কি ইলিশের গন্ধ শুঁকছিলেন?”
–“না…নেমে গেছে…হাত খালি নেই তাই…”
–“এত বাজার করেছেন, রান্না কি আপনি করবেন?”
–“না..না..আমি ওসব পারি না।”
একমাত্র মেয়ের বছর পাঁচেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। তাই ফ্ল্যাটে এখন থাকেন বলতে… মনোজবাবু আর ওনার স্ত্রী। করোনার জন্য অ্যাপার্টমেন্টের সব কাজের লোকেরই আসা বারণ। তাই মুখার্জ্জীবাবু বলে উঠলেন, “তাহলে সব বৌদির ঘাড়েই…! কিন্তু ওনার তো কোমরে-পায়ে খুব ব্যথা হয় শুনেছিলাম…কোনো কিছু করতেই পারেন না..”
–“না..এখন অনেক সুস্থ আছেন।”
–“ও…তা দেখালেন কোথায়?”
–“কলকাতায়।”
–“টাকা নিশ্চয় ভালোই খসেছে?”
–“আরে…সরকারী জায়গায় আবার খরচ কি!”
–“মানে…আপনি সরকারী হাসপাতালে গিয়েছিলেন!”
–“হ্যাঁ…টিভি-খবরের কাগজে তো ওটাকেই রাজ্যের সেরা সরকারী প্রতিষ্ঠান বলে।”
–“ওখানে তো শুনেছি এত ভিড়…সুস্থ মানুষই নাকি অসুস্থ হয়ে পড়ে!”
–“চিকিৎসা ভাল হলে তো লোকে ভিড় করবেই!” কথাটা বলেই আর দাঁড়ালেন না মনোজ বাবু। ইলিশ কিনে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছিল, কিন্তু মুখার্জ্জীবাবুর জন্য মেজাজটাই খিচড়ে গেল। ইনিই একদিন বলেছিলেন, “এরাজ্যে চিকিৎসা হয় না! সব ব্যবসা করতে এসেছে…এক একটা রক্ত চোষা পিশাচ! আপনি সাউথে যান…ওখানেই একমাত্র চিকিৎসা হয়।”
মনোজবাবু প্রথমে মনস্থির করেও ফেলেছিলেন, কিন্তু এত লম্বা জার্নির কথা শুনে পিছিয়ে আসেন ওনার স্ত্রী। ঠিক ঐ সময়েই একজনের কাছে জানতে পারেন কলকাতার এই মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালের কথা।
মেয়ের বিয়ের পর থেকেই মনোজবাবুর স্ত্রী এই রোগে ভুগছেন। কোমর থেকে শুরু করে পায়ের দিকে কনকনে ব্যথা। উঠতে বসতে পারেন না ঠিক মত, তবে হাঁটতে গেলেই সব থেকে বেশি ব্যথা হয়। শহরের সব নামি দামি ডাক্তারকে দেখিয়েছেন। এম.আর.আই, রক্ত পরীক্ষা সব হয়েছে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওষুধও ডাক্তারবাবুরা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দিকে একটু কমলেও, কিছুদিন পর ব্যথা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেত। দিন দিন ব্যথা যেন বেড়েই চলেছিল। শেষ তিন বছর তো ঠিক করে ঘুমাতে অব্দি পারতেন না। সেই দুশ্চিন্তায় মনোজবাবুর শরীরও ভেঙে গেল, ডায়াবেটিস ধরা পড়ল।
এরকম সময় খবরটা পেয়ে ঠিক করলেন কলকাতাতেই দেখাতে যাবেন। টিভি, খবরের কাগজ থেকেও তিনি আগে ওই হাসপাতালে ব্যথার আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির কথা জেনেছিলেন, তাই সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হল না। কিন্তু খুব ভিড় হয় ওখানে, তাই চেনা কেউ থাকলে সুবিধা হতে পারে বলে শুনেছেন। তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্র ওখানে আছেন, তবে সে কোন ডিপার্টমেন্টে থাকে তা তিনি জানেন না। ফোন নাম্বারও জোগাড় করে উঠতে পারলেন না। অগত্যা ওনার দূর সম্পর্কের এক ভাইকে কোনরকমে রাজি করিয়ে তিনজনে রওনা দেবেন ঠিক করলেন। আউটডোর টিকিট টা অনলাইনে করে নেবেন ঠিক ছিল। তাই সাইবার ক্যাফেতে প্রিন্ট করাতে গেলেন, কিন্তু ফর্ম ফিল আপ করতে গিয়ে আটকালেন ডিপার্টমেন্টের নামে। তাই যার কাছে খবর পেয়েছিলেন তাকে ফোন করে জানতে চাইলেন কোনটা ক্লিক করবেন…নিউরোমেডিসিন, নিউরো সার্জারী না অর্থোপেডিক্স?
স্ত্রী সবসময়ই বলেন শিরার ব্যথা…শিরার টান। আসলে এই ‘শিরা’ ব্যাপার টা ঠিক বোঝেন না মনোজবাবু। সায়েন্সে শিরা মানে অন্য জিনিস বোঝায়, অথচ তিন চার জন আলাদা স্পেশালিস্টের বাংলা নেমপ্লেটে শব্দটা দেখেছেন। যদিও ইংরেজী নেমপ্লেটে স্পেশালিটির নামই লেখা থাকে। ফোনে সেদিনই প্রথম তিনি “ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন” বা সংক্ষেপে “পি.এম.আর” নামটা শুনলেন।
ডিপার্টমেন্টের নাম লেখা হোর্ডিং দেখে গেট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতেই, সবাই রে-রে করে উঠল। পরে মনোজ বাবু বুঝলেন এন্ট্রি লাইনটা এর মধ্যেই গেটের বাইরে চলে গেছে। প্রায় ঘন্টা খানেক পর একটা বেঞ্চে বসার সুযোগ হল তাঁর। পাশে অল্প বয়সী একটা ছেলেকে দেখতে পেলেন, শরীরটা অনেকটা ঝুঁকে বসে আছে। মনোজ বাবু আলাপ করার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, “কি সমস্যা ভাই তোমার?”
–“কোমরে পিঠে অসহ্য ব্যথা।”
–“তোমার মতোই আমার স্ত্রীরও অবস্থা” বলে পাশে বসা স্ত্রী কে দেখালেন।
ছেলেটা এক ঝলক দেখে নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করল, “ধূর মশাই! আমার এই রোগ অল্প বয়সেই হয়। বয়স্কদের রোগ আলাদা!”
কথাটা শুনে মনোজ বাবু কি বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। ছেলেটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো, “আরে এটা আমার কথা নয়! ডাক্তার বাবুরাই বলেছেন, আমি তো অনেক দিন ধরেই দেখাচ্ছি। এখানে আরও আগে আসতে পারলে শিরদাঁড়াটা অন্তত বেঁকে যেত না!” একটু থেমে যোগ করল,”আজ ভর্তি করার জন্য ডাক্তারবাবুরা ফোন করেছেন, একটা ইনজেকশন দিতে হবে বলেছেন। কিন্তু…”
–“ডাক্তারবাবুরা ফোনও করেন?” অবাক হয়ে মনোজবাবু প্রশ্নটা করেই ফেললেন।
–“হ্যাঁ, ফোন নাম্বার নেন তো!”
মনোজবাবু কিছু বলার আগেই ছেলেটা উঠে চলে গেল। এরমধ্যেই গলায় স্টেথস্কোপ ঝুলিয়ে একজন ডাক্তার আউটডোরে ঢুকলেন। মনোজবাবু দেখেই ওনার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, “দেবল না!”
–“কি জানি! তুমিই তো ভালো করে চিনবে।”
মনোজবাবু দেবলকে শেষ দেখেছেন পনেরো বছর আগে। এতদিন পর চিনতে না পারাটা অস্বাভাবিক কিছু না। পাশের ফাঁকা জায়গাটায় এখন একজন স্থূলকায় মহিলা এসে বসেছেন। বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাটের ঘরে। মনোজ বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কোথা থেকে আসছেন?”
–“সে অনেক দূর..বাংলাদেশ থেকে!”
–“সেকি! বাংলাদেশে ডাক্তার পেলেন না!”
–“ডাক্তার কেনো পাবো না! কিন্তু রোগ না সারলে কি করব? এখানে ভালো চিকিৎসা হয় শুনে এসেছি।”
–“আজ কি প্রথম এলেন?”
–“আরে না। আমি তো আগেও তিনবার এসেছি। ওষুধ ব্যায়াম করেও কোমরে ব্যথা কমলো না বলে ডাক্তারবাবুরা ভর্তি করে ইনজেকশন দিলেন। এখন আল্লাহর রহমতে ব্যথা একেবারেই নেই, তাও ফলো আপে র জন্য আসতে বলেছিলেন তাই আসা।”
–“আপনি তাহলে পুরোপুরি সুস্থ!”
–“হ্যাঁ! কিন্তু ব্যায়াম আর নিয়ম কানুন মেনে চলতে বলেছেন কঠোর ভাবে। সবই হল শুধু শরীরটাই ঝরাতে পারছি না!”
চারিদিকের ভিড় দেখে মনোজবাবুর স্ত্রী একরকম সিঁটিয়ে ছিলেন। কথাগুলো কানে যেতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো, চোখগুলো যেন একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এর মধ্যেই মনোজবাবু শুনতে পেলেন তাঁর স্ত্রীর সিরিয়াল নাম্বার ধরে ডাকছে।
প্রতিদিনকার মতো সেদিনও আউটডোরে বসেছিলেন ইন্টারভেনশনাল ফিজিয়াট্রিস্ট ডা. দেবল ঘোষ। হঠাৎ পরিচিত মুখ দেখে চেয়ার থেকে উঠে পড়েন। হ্যাঁ তিনি ঠিকই দেখেছেন…ওনার স্কুলের শিক্ষক সেই মনোজবাবুই। মাথার চুল সাদা ও পাতলা হয়েছে, শরীরটা আগের থেকে ভেঙে গেছে। কিন্তু মুখের সেই হাসিটা লেগেই আছে। পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে দেখে মনোজবাবু অস্ফুটে স্ত্রীকে বলে ওঠেন, “দেখেছো! ছাত্র ঠিক তার গুরুকে মনে রেখেছে।”
সব শোনার পর দেবল মনোজবাবুর স্ত্রীর কাছ থেকে পুঙ্খানপুঙ্খভাবে হিস্ট্রি নিলেন। ওভার ওয়েট হলেও ওনাকে প্রেসার, সুগার বা থাইরয়েডের ওষুধ কখন খেতে হয়নি। অতিরিক্ত ওজন কমা, ঘুমের মধ্যে অত্যধিক ব্যথার মত কোনো কনস্টিটিউশনাল সিম্পটম নেই। মাংসপেশি দুর্বল হওয়া বা অসাড় হয়ে যাওয়া, মল মূত্র ত্যাগের অসঙ্গতি… এসব কিছু ছিল না। শারীরিক পরীক্ষা করেও খুব খারাপ কিছু মিললো না। কিন্তু হাঁটতে গেলেই বেশি দূর যেতে পারেন না, বসে পড়তে হয়…
এটা নিউরোজেনিক ক্লোডিকেশনের লক্ষণ। প্রলাপসড ডিস্ক বা স্লিপড ডিস্কের ক্ষেত্রে এটা দেখা যায়, যদি বেরিয়ে আসা ডিস্কের অংশ সুষুম্না কাণ্ডের মধ্যবর্তী অংশে চাপ সৃষ্টি করে, যেটাকে স্পাইনাল ক্যানাল স্টেনোসিস বলে। ভাসকুলার ক্লোডিকেশনের ক্ষেত্রেও কাফ মাসলে ব্যথা হতে পারে কিন্তু হাঁটা থামালেই সেটা কমে যায়, না বসলেও চলে। তাও পায়ের ধমনীগুলোর পালস্ ঠিকঠাক আছে নাকি দেখে নিতে হয়।
এম.আর.আই. রিপোর্টও বলছে সামান্য ক্যানাল স্টেনোসিস আছে। সবকিছু দেখে ডা. দেবল মনোজবাবুকে বললেন,”এখন ওষুধ ও থেরাপি লিখে দিচ্ছি। সব মেনে চলতে হবে, তারপরেও না কমলে ইনজেকশন নিতে হবে।”
–“ওই ইনজেকশন কি যেকোন দোকানেই নিতে পারবো?” জিজ্ঞেস করলেন মনোজবাবু।
–“না.. এটা তো একধরনের স্পাইনাল ইন্টারভেনশন, ভর্তি করে ও.টি.তে ফ্লুওরোস্কপির সাহায্যে ইনজেকশন দেওয়া হয়।”
–“কিন্তু সে তো সাময়িক…শুনেছি একবার নিলে বারবার নিতে হয়!”
–“না ওটা একদম ভুল ধারণা। ইনজেকশন দেওয়া হয় অসহ্য ব্যথা কমানোর জন্য, কিন্তু তারপর আপনি যদি ব্যায়াম বা অন্য নিয়ম কানুন মেনে না চলেন তাহলে আবার ব্যথা ফিরে আসবে। যাঁরা সবকিছু নিযমকানুন সঠিকভাবে মেনে চলবেন তাঁদের হয়ত দেখবেন সারাজীবনে আর ইনজেকশন নিতেই হল না।”
–“তাহলে অপারেশন করতে হবে না.. তাইতো!”
–“দেখুন সেটা এখনই জোর দিয়ে বলা যায় না। যদি কোনো পেশীর দুর্বলতা বা মল মূত্র ধরে রাখতে অসুবিধা হয় কিংবা তিনবার ইনজেকশন দেওয়ার পরও ব্যথা বা ক্লোডিকেশন সিম্পটম না কমে তখন অপারেশনের কথা ভাবতে হবে।”
–“কিন্তু অপারেশন না করলে তো রোগটা বেড়ে আরও খারাপ জায়গায় চলে যেতে পারে!”
–“না সেরকম ব্যাপার নয়। আমরা যা চিকিৎসা করি সব একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইন মেনেই, যেটা গোটা পৃথিবীতেই চলে। বিভিন্ন রিসার্চ করেই এই গাইডলাইন তৈরী হয়েছে। কখন কি করতে হবে সব লেখা থাকে সেখানে। আপনার কোনো চিন্তা নেই…আর আমার ফোন নাম্বার নিয়ে রাখুন, অসুবিধা হলেই ফোন করবেন।”
ফোনটা এল প্রায় একমাস পরে। মনোজবাবুর কাতর কণ্ঠ শোনা গেল ওপাশ থেকে, “আর পারছি না রে! ব্যথা বা কিছু কষ্ট হলে আমি সহ্য করে নিই, কিন্তু তোর কাকিমা একেবারেই পারে না! এরকম যন্ত্রণাদায়ক জীবন যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততই মঙ্গল…কত জন্মের পাপের সাজা যে ঈশ্বর আমাকে দিচ্ছেন!”
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে মনোজবাবু আর কান্না চেপে রাখতে পারলেন না।
এদিকে মর্মাহত ডা. দেবল জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যথা কি একেবারেই কমেনি?”
–“ওষুধ খেয়ে প্রথম দুই সপ্তাহ ভালোই ছিল, ঘুমটাও বেশ হচ্ছিল। কিন্তু তারপর থেকে আবার আগের মতোই অবস্থা। কাজের লোক আছে সেই যাবতীয় কাজ করে। ওকে কিছুই করতে হয় না, তাও একটু পাশের ঘরে বা বাথরুম যেতে গেলেই যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। শেষ কয়েকদিন তো বিছানা ছেড়ে উঠতেই ভয় পাচ্ছে। কিছু একটা কর বাবা!”
–“ব্যায়ামটা ঠিক মত করছেন?”
–“না…ব্যথা না থাকলে তো ভুলেই যায়। এখন আবার বলছে ব্যায়াম করতে গেলেই ব্যথা বাড়ছে।”
–“আচ্ছা, ব্যথাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে বলুন তো?”
–“তোর কাকিমার সাথেই কথা বল, ভালো বলতে পারবে।”
মনোজবাবুর স্ত্রীর সাথে কথা বলে দেবল বুঝতে পারলেন ব্যথাটা পায়ের দিকেই বেশি হচ্ছে, কোমরে তেমন নেই। তাও একটা খটকা লেগেই থাকছে…কিছুতেই মেলাতে পারছেন না!
“তুই তো শুধু হিস্ট্রি নিচ্ছিস আর রিপোর্ট দেখছিস!…এক্সামিনেশন কে করবে?”
পিজিটি-শিপের প্রথম দিনের আউটডোরে তাঁর গাইড স্যারের বলা কথাগুলো মনে পড়ছিল দেবলের, “ইউ আর এ ক্লিনিশিয়ান! ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন ইজ দ্য মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট পার্ট ফর ডায়াগনোসিস… অ্যাটলিস্ট ইনস্পেক্ট পেশেন্ট’স ফেস! সিভিয়ার পেইন…অথচ কোনো ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন থাকবে না, এরকম হয়?”
কিন্তু ডা. দেবল তো সব ক্লিনিক্যাল টেস্টই নিজে করে দেখেছেন। শুধু নিউরোজেনিক ক্লোডিকেশনের দূরত্বটাই দেখা হয়নি ভিড়ের কারণে।
ওদিক থেকে মনোজবাবুর কথায় সম্বিৎ ফিরলো দেবলের, “কি ভাবছিস? ইনজেকশন দিতে হলে বল, কবে যেতে হবে…”
দেবল একটু ভেবে বললেন,”যদি আরেকবার কষ্ট করে আসেন তাহলে খুব ভালো হয়…আউটডোরের দিন গুলো বাদ দিয়ে।”
ডা. দেবলের কথা মত মনোজবাবু স্ত্রীকে নিয়ে এসে দেখা করলেন। দেবল বললেন,”আপনাদের যদি খুব তাড়া না থাকে তাহলে আধ ঘন্টা একটু অপেক্ষা করবেন? আমার একটা কাজ একটু বাকি আছে সেরে নিতাম!”
মনোজবাবু বললেন,”আরে না না.. আমাদের কোনো তাড়া নেই।”
–“তাহলে পাশের রুমে মিউজিক থেরাপি হচ্ছে ওখানে একটু বসতে পারেন।”
মিউজিক থেরাপি নিয়ে কোনো ধারণা মনোজবাবু বা ওনার স্ত্রীর ছিল না, যদিও ওনার স্ত্রী একসময় খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন, কিন্তু এই রোগের পর থেকে সেসব অতীত। ঘরে ঢুকে ওনারা তো তাজ্জব বনে গেলেন, হাসপাতালের ভিতর এরকম আয়োজন! কতরকমের বাদ্যযন্ত্র, তার বেশির ভাগই ওনারা আগে কখনও দেখেন নি। রোগীরা কেউ বাজাচ্ছে, কেউ গাইছে, আর তাদের গাইড করছে মিউজিক থেরাপিস্টরা। এরকম পরিবেশে থাকলে সবারই মন ভালো হয়ে যাবে, রোগীও যেন ভুলে যাবে তার রোগ, ইচ্ছে করবে নতুন করে বাঁচতে।
ওনাদের নজরে এলো এক অদ্ভুত চেহারার মহিলা…মুখটা পুরো চাঁদের মত গোল, গালটা কেমন লালচে, ঘাড় আর পিঠের মাঝটা কুঁজের মত উচু, হাত পায়ের থেকে বুক পেটে যেন অতিরিক্ত মেদ জমেছে। মনোজবাবুর স্ত্রী জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, “আপনার কি হয়েছে?”
কথায় মুর্শিদাবাদের টান,”আর বলেন না! গরীবের সংসার…কাজ না করলে খাব কি? দোকান থেকে যন্ত্রণা কমার তিন রকমের ওষুধ দিত, ওই খেলে তবে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতাম…”
–“ওতে ব্যথা কমত?”
–“ওষুধের অ্যাকশন যতক্ষণকার ততক্ষণ…ওই খেয়েই মুখ চোখ সব ফুলে গেল, প্রেসার সুগারে ধরল। ডাক্তারবাবুরা বললেন স্টেরয়েড ওষুধ খেয়ে নাকি এই হয়েছে!”
মনোজবাবুর মনে পড়ল ওনার এক বন্ধুর কথা, তার ব্যথা হাঁপানি দুই ছিল। কোথাও রোগ কমেনি দেখে মুর্শিদাবাদের কোথাও গিয়ে প্রতিমাসে ওষুধ নিয়ে আসত, আগে পুরিয়া করে দিত, পরে তিন রকমের ওষুধ দিত। ওতে নাকি ব্যথা শ্বাসকষ্ট উভয়ই ভাল থাকত, চেহারাও বেশ হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন শুনলেন মারা গেছে। ওতেও কি তাহলে এই মারাত্মক ওষুধ থাকত!
গানের গলাটা চেনা লাগছে না! তাকিয়ে দেখেন স্ত্রী কখন ওদের সাথে গলা মিলিয়েছে, “…এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে……ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে উর্ধ্ব-পানে।”
চমৎকার গানের গলা, কতদিন পর শুনলেন! একদিন এই গলার প্রেমেই পড়েছিলেন।
“… একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে..আনন্দ বসন্ত সমাগমে…”, সত্যি আজ যে তাঁর বড় আনন্দের দিন, সেই প্রাণের স্পন্দন, সেই আলোর বিচ্ছুরণ! আশঙ্কার কালো রাত কেটে যেন প্রভাতের নবারুণ…দাবদাহে জ্বলতে থাকা জীবনে যেন একটু বৃষ্টিস্নান!
“সত্যি জীবন কত সুন্দর!” স্ত্রীর কথায় সম্বিৎ ফিরল মনোজবাবুর, “আর কিছুক্ষণ কাটিয়ে গেলে হতো না!” সায় দিলেন মনোজবাবুও।
মনোজবাবু যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না! একটা লম্বা বারান্দায় হেঁটেই চলেছেন তাঁর স্ত্রী, আর তাঁর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দেবল। ব্যথা অনুভূত হলেই জানাতে বলেছেন, কিন্তু কতপাক যে হয়ে গেল! দেবলের কপালের ভ্রূকুটি যেন যাচ্ছেই না!
“দেবল, হাতে বন্দুক আছে মানেই লোক দেখলেই গুলি করতে হবে এমন না!” ইন্টারভেনশন শেখার প্রথম দিনে স্যারের বলা কথা গুলো স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, “কোন বল টা খেলব আর কোন বলটা ছাড়ব, সেটা বুঝতে পারাটাই একজন ইন্টারভেনশাল ফিজিয়াট্রিস্টের ক্লিনিক্যাল আই।”
ডা. দেবল হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠলেন, “কোনো ইনজেকশনের দরকার নেই। শুধু একটা ওষুধই চলবে সকালে খাবার পর আর কিছু রিলাক্সেশন টেকনিক শিখিয়ে দেওয়া হবে। আশা করি আপনাদের এখন আর না আসলেও চলবে।”
বাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে মনোজবাবু ফ্ল্যাটের কাছাকাছি চলে এসেছেন। ভাগ্যিস তখন করোনা ছিল না, তাই কলকাতা যেতে পেরেছিলেন। নাহলে যে কি হত! প্রতিবেশীরা তো শুধু লেকচার দিতেই ওস্তাদ, সাহায্যের হাত কেউ বাড়াবে না! কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে যায়…হাসিমুখে স্ত্রী বলে ওঠেন, “বাবুমশাই, জিন্দেগী বড়ি হোনি চাহিয়ে, লম্বি নেহি!”
উপরিউক্ত কাহিনীটি এক বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের, যেখানে মনোজ বাবুর স্ত্রী শেষ অব্দি চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু অনেকেরই ব্যথার বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে, দেখা যায় অর্থ থাকলেও কোথায় গেলে আসল চাবিকাঠিটি মিলবে সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। মেডিক্যাল প্রফেশনের সাথে যুক্ত বা রোগীদের অনেকেরই কাছে এগুলো পরিচিত ঘটনা। কিন্তু যাদের চোখে এসব একান্তই অচেনা, তাদের জন্য ডাক্তারির পরিভাষায় পোস্টমর্টেম করা যাক ওপরের ঘটনাটিকে।
লো ব্যাক পেইন বা কোমরে ব্যথার কারণ বিভিন্ন… ডিস্কের সমস্যা, ফ্যাসেট জয়েন্টের সমস্যা, মাংসপেশির চোট, ট্রিগার পয়েন্ট, বার্সাইটিস, পাইরিফর্মিস সিনড্রোম থেকে শুরু করে টিউমার, ইনফেকশন, মেটাবলিক, ইনফ্লামেটরি, রেফার্ড পেইন…এমনকি নন অরগানিক কারণও হতে পারে। একজন ফিজিয়াট্রিস্ট বা পেইন ফিজিশিয়ানের প্রথম কাজ হল ব্যথার আসল কারণ নির্ণয় করা। তার জন্যে তাঁকে বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল টেস্টের পাশাপাশি ‘মগজাস্ত্র’র ব্যবহারও করতে হয়। তারপর বিভিন্নরকম ছবি ও রক্ত পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু দেখা যায় কোমরে ব্যথা হলেই অনেক রোগী প্রথমেই একটা এম.আর. আই. করতে ছোটেন বা লেখার জন্য ডাক্তারবাবুদের জোরাজুরি করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় তার কোনো প্রয়োজনই নেই, এতে একদিকে যেমন অর্থ যায়, অন্যদিকে সরকারী হাসপাতালে এত অপ্রয়োজনীয় এম.আর.আই এর চাপে অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রে সুযোগ পেতে দেরি হয়। কখন এম.আর.আই করতে হবে তার নির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে, ডাক্তারবাবুরা সেসব মেনেই প্রেস্ক্রাইব করেন।
যে অল্প বয়সি শিরদাঁড়া বেঁকে যাওয়া ছেলেটির সাথে মনোজ বাবুর দেখা হয়েছিল প্রথমে, তার রোগটির নাম অ্যাঙ্কাইলজিং স্পনডাইলাইটিস। এই রোগ পঁয়তাল্লিশের আগে দেখা যায়, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বা রেস্ট নিলে ব্যথা বাড়ে এবং হাঁটলে বা ব্যায়াম করলে ব্যথা কমে এক্ষেত্রে। ঠিক উল্টো জিনিসটাই হত স্থূলকায় যে মহিলাকে দেখা গিয়েছিল তাঁর ক্ষেত্রে। ওনার ছিল প্রলাপ্সড ডিস্কের সমস্যা, ডিস্ক যখন কোনো স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে তখন ব্যথা পায়ের দিকে নামে, একে রাডিকুলার পেইন বলে এবং যখন কোনো মাংসপেশি দুর্বল হয় বা কোনো অংশে অনুভূতি কম পাওয়া যায়, তখন তাকে রাডিকুলোপ্যাথি বলে।
সঠিক রোগ নির্ণয় করার পর ওষুধ, ব্যায়াম বা অন্যান্য থেরাপি দেওয়া হয়। তারপরও ব্যথা না কমলে বিভিন্ন ইন্টারভেনশন করা হয়। ফিজিয়াট্রিস্টরা এখন এপিডুরাল ও ফ্যাসেট ব্লক, স্যাক্রো-ইলিয়াক জয়েন্টে ইনজেকশন থেকে শুরু করে ওজোন নিউক্লিওলিসিস, রেডিওফ্রিকুয়েন্সি অ্যাব্লেশন, পারকিউটেনিয়াস এন্ডোস্কোপিক ডিস্কেকটমি… এরকম আধুনিক চিকিৎসা করে থাকেন। যদিও এরাজ্যে সর্বত্র চিত্রটা সমান না। তবে একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে সঠিক নিয়ম মেনে ব্যায়াম এবং লাইফস্টাইল পরিবর্তন করলে তবেই ব্যথাহীন দিনের সংখ্যা বাড়বে। এবার আসি একদম শেষের অদ্ভুত চেহারার মহিলার কথায়, যার মুখ চাঁদের মত গোল ছিল, শরীরের মধ্যভাগে মেদ ছিল বেশি। উনি ভুগছেন কুশিং সিনড্রোম রোগে, যেটার কারণ একটানা দীর্ঘদিন স্টেরয়েড ওষুধ খাওয়া। স্টেরয়েড হল ‘পারমাণবিক শক্তি’র মত, যেটা কখন, কোথায়, কিভাবে ব্যবহার করবেন তার ওপর নির্ভর করবে ওটা আপনার শরীরে “আশীর্বাদ না অভিশাপ”! তবে অযথা ভয় না পেয়ে সঠিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মত চললেই আপনি সুস্থ থাকবেন।
সবশেষে মনোজ বাবুর স্ত্রীর কথাতে আসা যাক। ওনার স্লিপড ডিস্কের পাশাপাশি নন অর্গানিক ব্যথার উৎসও ছিল, সেটার চিকিৎসা না হলে উনি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারতেন না। এক্ষেত্রে মিউজিক থেরাপি, রিলাক্সেশন টেকনিকের গুরুত্বও কম না। সুতরাং, আপনার ব্যথার বাণী সঠিক ভাবে পড়তেও সমাধান করতে আপনাকেই সর্বাগ্রে সচেতন হতে হবে।
Nice.informative.
অনবদ্য। এর আগেও আপনার লেখা পড়েছি, দারুন। শুধু তথ্য নয়, সাথে লেখার গুন। আমি নিয়মিত পাঠক। আবার লিখবেন। ভালো থাকবেন।
Kub kub sundor sir…. “স্টেরয়েড হল ‘পারমাণবিক শক্তি’র মত, যেটা কখন, কোথায়, কিভাবে ব্যবহার করবেন তার ওপর নির্ভর করবে ওটা আপনার শরীরে “আশীর্বাদ না অভিশাপ”! Ei kathata kub vlo lege6e.