হোয়াটসঅ্যাপ খুললেই দেখবেন, নিচে ডানদিকে জ্বলজ্বল করছে নীল-বেগুনী-গোলাপি একটি বৃত্ত। মেটা এ-আই। যা খুশি প্রশ্ন করুন – ‘আস্ক মেটা এনিথিং’ – মেটা উত্তর নিয়ে হাজির।
তো হাতের নাগালে বিনেপয়সায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পেয়ে খুশি হয়ত সব্বাই, সন্দিগ্ধও কেউ কেউ। এই বাজারে আমার তরফেও দু’পয়সা রেখে গেলাম। এআই-এর ভালোমন্দ ইত্যাদি প্রভৃতি নিয়ে টেক-আনাড়ির কিছু অগোছালো ভাবনা। আজকের ‘এই সময়’ সংবাদপত্রের ‘এই সময় স্পেশাল’ পাতায়।
এ বিষয়ে লেখার ব্যাপারে আমি একেবারে অনুপযুক্ত এবং অযোগ্য, তবু যাঁর কথায় ফট করে লিখে বসলাম, সেই Anirban Bhattacharyya -কে এখানে ট্যাগ করে রাখলাম। পড়ে বিরক্ত হলে গালি-টা ওঁকেই দিন।.
.
.
‘জানা’ ব্যাপারটা নিয়ে জানতে গিয়ে অদ্ভুত একটা তথ্য জানতে পারলাম। একজন শিক্ষিত ইংরেজি-ভাষী মোটামুটি কুড়ি হাজার শব্দ জানেন, যার মধ্যে মাত্র একশ’টি শব্দ এমন, পৃথিবীর সব ভাষায়ই যাদের উপযুক্ত প্রতিশব্দ আছে। know শব্দটি তার অন্যতম। অর্থাৎ ‘জানা’ নামক ধারণাটির জন্য পৃথিবীর সব ভাষায়ই একটি না একটি শব্দ রয়েছে। আশ্চর্য, না?
কিন্তু দুনিয়ার তামাম ভাষায় প্রতিশব্দ থাকা মানেই ‘জানা’-টা সহজ ব্যাপার, এমন তো নয়। সেই কত বছর আগেই সোক্রাতেস বলে গেছিলেন – ‘আমি শুধু এটুকু জানি, যে, আমি কিছুই জানিনে’ – হ্যাঁ, সেই সোক্রাতেস, যাঁকে নাকি এথেন্সের দেবতা স্বয়ং বিশ্বের জ্ঞানীতম ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তাহলে?
কিন্তু সময় বদলে গেছে। ‘জানি না’ বলাটা আর কাজের কথা নয়। ক’দিন আগে একটি চমৎকার কার্টুন চোখে পড়ল। অফিসের বস, প্রায় সোক্রাতেস-এর মতো করেই বলছেন – কেউই কিস্যু জানে না। আর কর্মীদের মধ্যে কেউ ভাবছেন – ভাগ্যিশ! আর কেউ – যাক, বাঁচা গেল! কেউ বা – ওহ্, আমি একা নই তাহলে!!
তবে এসব এখন অতীত। এসে গেছে পাঁচতলা মল, পুরোটাই… থুড়ি, এসে গেছে হরেকদামে হরেক স্মার্টফোন, নামমাত্র মুল্যে ডেটাপ্যাক, আর অ্যাপের মধ্যে জুড়ে রাখা অসামান্য বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ওরফে এআই – হোক না কৃত্রিম, বুদ্ধিমত্তা তো বটে)! গত সোমবার থেকে, এদেশে, প্রতিটি ‘মেটা’ অ্যাপে বসে গিয়েছে নীল-বেগুনী-গোলাপি বৃত্ত – হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম সর্বত্র – আঙুল ছোঁয়ালেই যিনি জানান দিচ্ছেন, যা মনে চায় জিজ্ঞেস করতে পারেন – কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমাজমাধ্যমের প্রতিটি ‘অ্যাপ ইন্টারফেস’-এর কেন্দ্রে।
সোক্রাতেস, শুনেছি, এমনও বলেছিলেন – জানার আকাঙ্ক্ষা যখন শ্বাস নেওয়ার মতো জরুরি বোধ হবে, তখনই তুমি জ্ঞানার্জনে সক্ষম হবে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একটা হাল্কা মুচকি হাসি আমরা তাঁকে উপহার দিতেই পারি। কেননা, জানার আকাঙ্ক্ষা গভীর হওয়ার ঢের আগেই, প্রশ্নের সম্ভাবনাটুকু মনের কোণে ভুরভুরি কাটার প্রাকমুহূর্তে, আমরা টুক করে উত্তর পেয়ে যেতে পারি। আমাদের মতো আটপৌরে পাব্লিক, যারা চ্যাটজিপিটি নামক বস্তুটির কথা শুনেছি কিন্তু দেখিনি – এবং ওটুকু শুনেই চায়ের আড্ডায় চ্যাটজিপিটি দিয়ে প্রবন্ধ থেকে প্রেমপত্র মায় কবিতা লিখে ফেলা যাচ্ছে এমন খবর নিয়ে আলোচনা করতে আটকায়নি – এআই এখন তাদেরও, আক্ষরিক অর্থেই, হাতের মুঠোয়। আস্ক মেটা এনিথিং।
বাকিরাও পিছিয়ে নেই। সম্প্রতি অ্যাপল ঘোষণা করলেন ‘অ্যাপল ইন্টেলিজেন্স’-এর কথা – যেখানে শুধুমাত্র চ্যাট-এর মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে, এমন নয় – কম্পিউটার মোবাইল ট্যাব-এর অপারেটিং সিস্টেমের গভীরে বুনে দেওয়া হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বীজ, যা দিয়ে আপনি সহজেই সেরে ফেলতে পারবেন হাজারও কাজ। মাইক্রোসফট-এর ‘কোপাইলট’-ও তদনুরূপ। তবে ‘অ্যাপল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘কোপাইলট’, ‘মেটা এআই’-এর মতো, বিনামূল্যে হবে না। মানে, বিনামূল্যেই হবে, কিন্তু সেগুলো ঠিকভাবে চলতে গেলে শক্তিশালী প্রসেসর লাগবে, যার জন্য নতুন মডেলের ‘ডিভাইস’ কিনতে হবে – উপভোক্তাকে সে বাবদে গাঁটের কড়ি খসাতে হবে। আরেকদিকে দেখুন, আপনি না চাইতেই – এমনকি চাই কি না চাই বুঝে ওঠার আগেই – ‘মেটা এআই’ কেমন চমৎকারভাবে এসে বসে গেছে আপনার হোয়াটসঅ্যাপ-এ – বিনা ঝঞ্ঝাটে এবং বিনামূল্যে – তাই না?
সুবিধের দিকটা তো বলা-ই বাহুল্য। যা জানতে চান, মনে যখন যা খটকা জাগে, তর্কে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যখন যেমন তথ্যের প্রয়োজন হয় – সন্তানের ইশকুলে বেয়াড়া প্রোজেক্ট নিয়ে বেগতিক পরিস্থিতি যখনই তৈরি হবে – আস্ক মেটা এনিথিং – প্রশ্ন করতে না করতেই উত্তর হাজির। শ্রম এবং সময়, দুইই বাঁচছে। হয়রানিও। এবং পুরোটাই পাওয়া যাচ্ছে চব্বিশ ঘণ্টার সঙ্গী স্মার্টফোনটিতে, বিনামূল্যে।
অসুবিধের দিক বলতে অনেকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি-তে হাত পড়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মানুষের মতোই, পরিণত হয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে – সেও দেখে শেখে, ঠেকে শেখে। ‘মেটা এআই’ ট্রেনিং পাচ্ছিল উপভোক্তাদের ব্যক্তিগত কথোপকথন অনুসরণ করে, এমন অভিযোগ আগেই উঠেছিল – যদিও ‘মেটা’-কর্তৃপক্ষ সে অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন, তাঁদের বক্তব্য, ট্রেনিং-এর জন্য কেবলমাত্র ‘পাব্লিক পোস্ট’-ই ব্যবহৃত হচ্ছিল (আহ্, সমাজমাধ্যমে আমাদের যে কোনটা পাব্লিক আর কোনটা প্রাইভেট!), তবু সন্দেহ রয়েই গেছে। তদুপরি, ইউরোপের দেশগুলোতে, যেখানে ব্যক্তিগত তথ্যের প্রাইভেসি নিয়ে কিছু কড়াকড়ি আজও টিকে রয়েছে, সেখানে এখনও অ্যাপ ইন্টারফেসে ‘মেটা এআই’ জোড়া হয়নি। ‘মেটা’-কর্তৃপক্ষ যদি প্রাইভেসি-র সুরক্ষা বিষয়ে এতখানিই নিশ্চিত, তাহলে ইউরোপ-কে বঞ্চিত করছেন কেন? অবশ্য আমাদের এতশত ভাবার মানে হয় না। এক বন্ধু, সদ্য, শহর থেকে সপ্তাহান্তে ‘আনওয়াইন্ড’ করতে গ্রামে বেড়াতে গিয়ে খেয়াল করেন, তিনি বাড়তি অন্তর্বাস নিয়ে যেতে ভুলে গেছেন। বাধ্য হয়ে লাগোয়া গঞ্জ-শহরের থেকে নগদ টাকায় তাঁকে কিনতে হয়। কিন্তু তারপর গত এক সপ্তাহ ধরে তাঁর ফেসবুকের দেওয়াল জুড়ে শুধুই গেঞ্জি-জাঙিয়ার বিজ্ঞাপন। দেখেশুনে তিনি স্তম্ভিত। অতএব, প্রাইভেসি-র বিলাসিতা এদেশে মানায় না। কিন্তু দুশ্চিন্তা-ই কি আর কোনও কারণই নেই?
কথায় কথায় উদ্ধৃতি দেওয়াটা হয়ত টিভি-তে সান্ধ্য-আলোচনায় জনৈক অধ্যাপকের বক্তব্যের মতো শোনাবে, তবু আরেকবার সোক্রাতেস-এর কথা বলি। তিনি বলেছিলেন – আমি কাউকেই কিছু শিখিয়ে দিতে পারি না, আমার কাজ শুধু ভাবানো। সোক্রাতেস প্রশ্ন করতেন, উত্তরের প্রত্যুত্তরে আরও প্রশ্ন করতে করতে সামনে থাকা মানুষটির চিন্তার খামতি এবং নিশ্চিত সত্য বলে মেনে নেওয়া ভাবনাগুলোর অসঙ্গতি স্পষ্ট করে দিতেন। উত্তর নিজেকেই খুঁজে নিতে হয় – রেডিমেড উত্তর জুগিয়ে যাওয়াটা তো সোক্রাতেস-এর দায় নয়। হ্যাঁ, তথ্যভিত্তিক প্রশ্নের ক্ষেত্রে কথাটা প্রযোজ্য নয় – কেননা সেক্ষেত্রে উত্তর সুনির্দিষ্ট – কিন্তু চটজলদি উত্তর পাওয়ার অভ্যেস কি শুধু তেমন ধরনের প্রশ্নেই থেমে থাকবে? প্রশ্নের উত্তর পাওয়াটা তো পথের শেষ – সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবেই, এমনও নয় – কিন্তু উত্তর খোঁজার জার্নি-টা কি কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ? যে প্রজন্ম চ্যাটবক্সে লহমার মধ্যে উত্তর পেতে অভ্যস্ত হতে চলেছে, তার কি সেই জার্নি-র অধ্যাবসায় থাকবে?
শুরুর কথাটা দিয়েই শেষ করি। অর্থাৎ কুড়ি হাজারের মধ্যে একশ’টি শব্দ, যাদের প্রতিশব্দ দুনিয়ার সব ভাষায় রয়েছে। know-এর মতোই, সে তালিকায় think-ও রয়েছে। অর্থাৎ ‘ভাবা’ – পৃথিবীর সব ভাষায়ই এর প্রতিশব্দ আছে। অব্যবহৃত হতে হতে শব্দটা অবান্তর হয়ে যাবে না তো? সোক্রাতেস বলেছিলেন – জ্ঞানের মূলে থাকে বিস্ময়। বলেছিলেন – নিজেকে খুঁজে পেতে চাইলে নিজেনিজে ভাবার অভ্যেস করো।