মদন পাকড়াশি। নামেই “মদ” অন। আবার গোত্রে মদগেল্য (মধুকূল্য)। এই যুক্তি দিয়েই দূরান্তের জানগুরু মদ ছাড়ানোর অপারগতা জানিয়ে হাত তুলে নিয়েছেন। তাই অগত্যা আপনার শরণাপন্ন হয়েছি ডাক্তারবাবু। না খেলে নাকি ঘুম হয় না। এই যুক্তিতে প্রতিদিনই খায়। বউমার বকুনিতে গত দু’দিন যা খায়নি। আজ সকাল থেকেই দেখছি, হাত পা কাঁপছে, ঘামে চপচপে, মাঝে মাঝে দমকা দিয়ে খিঁচিয়ে উঠছে সারা শরীর। আমার একটাই ছেলে ডাক্তারবাবু। বাপমরা ছেলে। বিয়ে করিয়ে ভেবেছিলাম, এবার অন্তত ভুলে থাকবে। কিন্তু এখন বৌমার মুখের দিকেই তাকানো দায়। কিছু একটা করুন ডাক্তারবাবু। এতগুলো কথা প্রায় একটানে বলে আঁচলে মুখ গুঁজলেন প্রৌঢ়া।
অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর তখনও মাঝে মধ্যেই দমকা দিয়ে খিঁচিয়ে উঠছে শরীরটা। মাতাল স্বামীর জ্ঞানহীন মাথা কোলে নিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী।
জিজ্ঞেস করলাম, কি মদ খায়? দেশি না বিলাতী?
আমার এহেন প্রশ্নে রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিস্টার দিদিমনি। আমার দিকে ভ্রূ কুঁচকে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই প্রাথমিক চিকিৎসায় উদ্যত হলেন তিনি।
সুগারের মাত্রা খানিক কম। ডেক্সট্রোজ সহযোগে থিয়ামিন ইঞ্জেকশন দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হলো।
পটাশিয়ামের মাত্রাও খানিক কমেছে। সেইমত পটাশিয়ামের ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করা হলো। ঘন্টা খানেক পর পালসের গতি ও শ্বাসহার আগের থেকে খানিক কমলেও এখনও সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত নয়। লোরাজেপামের প্রয়োগে খিঁচুনিও কমেছে খানিক। চোখের পাতা খোলার চেষ্টা করলেও স্বল্প চেষ্টার পরেই চক্ষু মুদছেন সজোরে। চোখের মণিতে হঠাৎ জোরালো আলো পড়লে যেমনটা হয়।
প্রাথমিক চিকিৎসা মোটামুটি ভাবে সম্পূর্ণ হবার পরেও রোগীর অবস্থা খুব আশাপ্রদ নয়। রোজ দিন মদ খায়। কিন্তু দুদিন খায়নি। অর্থাৎ কিনা, অ্যালকোহল উইথড্রয়াল সিনড্রোম। কিন্তু চিকিৎসার ক্ষেত্রে ফলাফল কেমন যেন আশানুরূপ নয়।
বৌমাকে আবডালে জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি করে বলতো মা, এই দু দিন কি সত্যিই মদ খায়নি?
আমার কথা শুনে জমে থাকা ক্ষোভ উগরে এলো বৌমার গলায়। শাশুড়ী মায়ের পুত্র স্নেহকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চিৎকার বলে উঠলো- খায়নি আবার? বিলাতী না পেয়ে কাল রাত্রে ওর এক স্যাঙাত জানলা গলে এক বোতল দিশি দিয়ে গেছিলো। পাছে কেড়ে নিই সেই ভয়ে এক টানে সবটা খেয়েছে। তারপর কথা কাটাকাটি। বমি করলো। তারপর থেকেই এই অবস্থা।
স্যাঙাতটিও এসেছিলো অ্যাম্বুলেন্সের হেল্পার সেজে। বেগতিক দেখে পালাতে যেতেই বৌমার চিৎকারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কাঁচুমাচু মুখে হাতজোড় করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কানে কানে জিজ্ঞেস করলাম- কি এনেছিলি ভাই? শুদ্ধ দেশি? না ইয়ে দেশি?
মদ অঙ্কে আমার প্রগাঢ় জ্ঞান দেখে ভীত মুখে চিলতে হাসির রেখা ঝুলিয়ে বললো – ওর কষ্ট দেখে থাকতে পারিনি স্যার। নিজেই বানানোর চেষ্টা করেছিলুম বাড়িতে। অ্যাসিডটা একটু বেশি পড়ে গেছিলো এই যা। তবে এক্কেবারে অরিজিনাল লাগছিলো স্যার।
এবার আর বুঝতে বাকি রইলো না আমার। কাঁচা হাতে মদ বানাতে গিয়ে অ্যাসিড বেশি পড়ে ইথাইল অ্যালকোহলের জায়গায় খানিক মিথাইল অ্যালকোহলও পেটে গিয়ে এই বিপত্তি। অর্থাৎ কিনা মিথানল টক্সিসিটি। প্রাণঘাতী।
অবিলম্বে ফোমেপিজোল চাই। ফার্মেসীতে ছুটলেন সিষ্টার দিদিমনি। নিয়েও এলেন চটজলদি। কম ব্যবহৃত ইঞ্জেকশন। তাই পড়ে থেকে থেকে মলিন হয়েছে গায়ে লেগে থাকা স্টিকার। যদিও ডেট ফেল হতে তখনও ঢের দেরি। নিয়ম মেনে প্রয়োগ হলো অনতিবিলম্বেই।
হাঁ করে তাকিয়ে থাকা স্যাঙাত ভায়াকে ডেকে বললাম, একটু রাম জোগাড় করতে পারবে এক্ষুনি? হঠাৎ এহেন পরিবেশে রাম চাইছি দেখে গোঁফের নিচে মুচকি হেসে আমার দিকে ব্যাঁকা চাহনিতে চেয়ে বললো- স্যার কি আর আমাদের মত কমদামি রাম খাবেন?
ফাজিল দৃষ্টিতে ঈষৎ বকুনি দিয়ে বললাম, চটজলদি জোগাড় করতে পারো কিনা বলো? না হলে অন্য কাউকে বলে আনিয়ে নিচ্ছি।
বকা খেয়ে আবার কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত ভাবে ডান হাত খানা পকেটের গভীরে চালান করে একখান বিলাতি রামের পাউচ বের করলো স্যাঙাত ভায়া।
প্রায় ছিনিয়ে নিলাম আপাত নিষিদ্ধ পাউচখানা। গ্লাসে খানিক জলে পাউচের হলুদ তরলখানি মিশিয়ে দিয়ে এগিয়ে দিলাম মদন পাকড়াশির মুখের দিকে। ফোমেপিজোল পেয়ে ততক্ষণে চোখ খুলেছেন পাকড়াশি। আমার কাছ থেকে এরকম অনভিপ্রেত উপহার পেয়েও থমকে গেলেন তিনি।
কান্ড দেখে বৌমার চোখ বিস্ফারিত। শাশুড়ী মায়ের চোখে স্নেহাশ্রু। সিষ্টার দিদির চোখ রাগে রক্তবর্ণ।
সবাইকে উপেক্ষা করেই পাকড়াশির গলায় ঢেলে দিলাম হলুদ তরল। গদগদ চোখে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়লো তাঁর।
বাকিদের যৌক্তিক প্রশ্নে জর্জরিত হবার আগেই খানিক গলা চড়িয়ে বললাম – চিন্তা নেই। মিথানলের অ্যান্টিডোট ইথানল। তাই-ই প্রয়োগ করেছি মাত্র।
সকলের উদবেগের অবসান ঘটিয়ে ঘন্টা তিনেক পর সুস্থ হলেন পাকড়াশি। কানে কানে কথা দিয়ে গেলেন – আপনার দেওয়া সব ওষুধ খাবো স্যার। আর ও জিনিসের মুখোমুখি হবো না।
ডিসচার্জের পথে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম – কারণসুধার অমৃতত্বে প্রতিশ্রুতি নেহাতই গরলময়।