একেকটা বয়সের একেক রকম সঙ্কট আছে। মাঝ বয়সের সঙ্কটটা কেমন তা এখন আমি মাঝে মাঝে বুঝতে পারছি।
এই চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ পার হলেই শরীরের নানারকম সিগন্যাল আমরা আর উপেক্ষা করতে পারি না। তখন আমাদের একবার হলেও ডাক্তারবাবুর কাছে দৌড়তে হয়। ডাক্তারবাবু মানেই চেয়ারের ওপারে বসে থাকা গুরুগম্ভীর একজন মানুষ যিনি খালি জলদমন্দ্র কন্ঠে একটি শব্দই উচ্চারণ করেন, তা হল ‘হুম্’। এটি ‘ওম্’ শব্দের আধুনিক বিকার। ওই কাজটি করে তিনি কিছু টেস্ট লেখেন।
ডাক্তারবাবুর পেনের খসখস শব্দ যত বাড়ে তত রুগির বুকে ধড়ফড়ানি বাড়ে। কিছুটা তার নিজের শরীরের ভয়ে কিছুটা পকেটের ভয়ে।
‘বুঝলেন। চল্লিশ তো পার হলো। একবার এগুলো করিয়ে নিন। যা পেট বেড়েছে ফ্যাটি লিভার তো আছেই। নেশটেশা করেন?’
‘ও ডাক্তারবাবু কালেভদ্রে। পার্টি-সার্টি হলে। বন্ধুরা খুব জোর করলে’।
এই একটি ব্যাপারে কোনো পেশেন্ট কখনো সত্যি কথা বলে না।
ডাক্তারবাবু বিচক্ষণ মানুষ। তিনি এসব জানেন।
‘দেখুন টেস্ট করলেই ধরা পড়বে কোলেস্টেরল বেড়ে গেছে। ট্রাই গ্লিসারাইড হাই। গ্রেড ট্যু ফ্যাটি লিভার’।
‘আচ্ছা ফ্যাটি লিভার মানেই তো সিরোসিস। মানে পেটে জল’?
বুঝে দেখুন এতদূর ভাবা হয়ে গেছে অথচ বলছেন কালেভদ্রে, বন্ধুরা খুব জোর করলে। ডাক্তারবাবু বিচক্ষণ মানুষ। তিনি সব জানেন।
‘আরে না না। সিরোসিস শেষ অবস্থা। ফ্যাটি লিভার হলে খাবার-দাবার, লাইফ-স্টাইল বদলাতে হবে’।
গল্পটা এভাবে চালানো যেতে পারে কিন্তু বেশিদূর চালানো যায় না।
রিপোর্ট যখন আসে তখন কারো ধরা পড়ে হাই কোলেস্টেরল, কারো হাই সুগার, কারো ঘাড়ে স্পন্ডাইলোসিস, ফ্যাটি লিভার, কারো থাইরয়েড। তার সাথে ধেয়ে আসে সবজান্তা ডাক্তারবাবুর সাবধানবাণী। খবর্দার! এটা খাবেন না। ওটা খাবেন না। এটা করবেন না। ওটা করবেন না।
রুগি ভীত হয়। সে বুঝতে পারে সে এক অন্য জগতে প্রবেশ করছে। তার শরীর একটু একটু করে জানিয়ে দিচ্ছে সে জীবনের পথে বেশ কিছুদূর চলে এসেছে। এবার তাকে রাস্তা পার হতে হলে চারপাশ দেখে পার হতে হবে। সে এক মৃদু বিষণ্ণতার শিকার হয়।
সারাজীবন ধরে সুগারের ওষুধ খেতে হবে? প্রেসারের ওষুধ খেতে হবে? মিষ্টি খাওয়া বারণ? ভারি কিছু তুলতে পারব না? জিমে যেতে পারব তো? আমাকে যে বাইকটা প্রতিদিন উঁচু বারান্দায় তুলতেই হয়। জানেন তো রবীন্দ্রপল্লীতে বর্ষায় কত জল জমে।
এই যে সারাজীবনব্যাপি কোনো কিছুর একটা ছাপ ডাক্তারবাবু মনের ওপর রেখে দিলেন সেই ছাপটা তাকে পীড়িত করে। তার বাড়ির লোককে উৎকন্ঠিত করে। সে শান্তিতে বাইক চালাতে পারে না। বিড়ি খেতে পারে না। কবজি ডুবিয়ে পাঁঠার মাংস খেতে পারে না। বারাসাতের অশেষের দই, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, কৃষ্ণনগরের সরভাজা, এই আবগারি আবহাওয়ায় শনিবারের রাম- সবকিছুতেই তার কেমন বাঁধো বাঁধো লাগে।
জীবনটা আগে এমন ছিল না। মাঝ বয়স তাকে নানাদিক থেকে একটা অদৃশ্য শেকলে বেঁধে ফেলে।
আর এই বয়সে নানারকম ছোটখাট নেশা হয়। কারো নতুন করে মদের নেশা। যার লক্ষ্মীভাগ্য পালাবদলের পরে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। কারো গাছের নেশা। সারা বাড়িতে হঠাৎ নতুন করে গাছ। নার্সারি খালি করে বাড়িভর্তি গাছ। একদম হঠাৎ করে। কারো পরকীয়ার নেশা হয়। হালকা চ্যাটিং। হালকা ফিসফিস।
আমার চেম্বার যাওয়ার পথে একটি চন্দ্রানী পার্লসের দোকান আছে। সেখানে একটি সুসজ্জিত মেয়ে ফাঁকা দোকানে কম্পিউটারের পাশে বসে মোবাইল করে। আমি যাওয়ার পথে প্রতিদিন একবার তার পরনের শাড়িটা দেখে চেম্বারে ঢুকি। সেদিন দেখি মেয়েটি একজন কাস্টমারের বিল করছে, আর ভদ্রলোক পাশে বউ থাকা সত্ত্বেও বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় মেয়েটিকে দেখছে। এই মানুষটিও মাঝ বয়সের সঙ্কটের কাঁটায় আহত। একমাত্র তার স্ত্রীই সম্ভবত তাকে বাঁচাতে পারেন।
এ তো গেল রুগিদের অবস্থা। ডাক্তারবাবুর হাল কেমন?
বালি পাস ট্রেক করে আসার পর থেকেই কোমরে ব্যথাটা জোর বেড়েছে। মাঝে মাঝেই কমে আবার বাড়ে। এবার ট্রেকে যাবার আগেই কোভিড হল। তাই প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে শরীর কাহিল ছিল। বেশি প্রস্তুতি নিয়ে যেতে পারি নি। নামার দিন কোমরে খুব চাপ পড়েছিল। হপ্তা দুই আগে আবার জ্বর আসায় ব্যথা গেল খুব বেড়ে। বাঁদিকের পায়েও শিরশির করছে।
মাঝেমাঝেই ঝড়বৃষ্টি আসছে। টব প্যারাপেট থেকে নামাতে গিয়ে ব্যথা গেল খুব বেড়ে। আমার এক বন্ধুকে দিয়ে ফিজিওথেরাপি করছি। কমেছে কিন্তু পুরোপুরি কমছে না। এদিকে বাড়ির ‘অ্যান্টি-ট্রেকিং লবি’ অতি সক্রিও হয়ে উঠেছে প্রবলভাবে। এ সি তে থাকব না বলে নিচের ঘরে একা শুচ্ছি কিছুদিন। বউ তাতে খুব বিরক্ত। এই বয়সেই কি তবে কি আমি সন্ন্যাস নিলাম?
এদিকে নিজের মনের ভয়ও বাড়ছে। মেরুদন্ডের কথা ভেবে নয়। ট্রেকিংটা কি সত্যিই গেল? আর কি পাহাড়ে যাওয়া যাবে না? বাড়ির লোকেরা একদিকে খুব শান্তি পেয়েছে। যাক এর ঠেলায় আর যাই হোক বছর-বছর ট্রেকিং-এ যাওয়ার সাহস করবে না।
ভাবলাম এম আর আই টা করিয়েই নিই। ছ হাজার টাকা খরচা। গা টা কচকচ করছে। সামনে পুজো। বেড়াতে যাওয়ার খরচ। কেনাকাটার খরচ। কাজের মাসি মাইনে বাড়াতে বলেছে। ধার চেয়েছে। চেম্বার ফাঁকা। রুগিপত্র নেই। এই বাজারে ছ হাজার! রুগিদের পরীক্ষা, ওষুধ খসখস করে লিখে দেই। নিজের বেলা টনটন করে।
যা হোক এম আর আই করিয়ে দেখলাম ডিস্ক বালজিং। অনেকটাই নার্ভে চাপ পড়ছে। তাই বাঁ পাটা শিরশির ব্যথা। এস ওয়ান র্যাডিকুলোপ্যাথি। ডিজেনারেটিভ বোন ডিজিস। আমার এক জুনিওর ভাইকে হোয়াতে রিপোর্ট পাঠালাম। ও অর্থোপেডিক ডাক্তার। সে টাইপিল,
প্লেটগুলো পাঠাও। এমনিতে তো কিছু দেখছি না। বয়স হলে এমন সব হয়। ও থাকবেই।
বাঁচালি।
(হাসির ইমোজি)
ট্রেকিং করতে পারব রে?
অবশ্যই।
জিও।
(অট্টহাসির ইমোজি)
তবে তুই বয়স্ক বলায় দুঃখ পেলাম। (দুখু ইমোজি)
না না তুমি যথেষ্ট ইয়ং।
(রক্তলাল হার্ট ইমোজি)
এভাবেই কখনো আপনার কখনো আমার মাঝ বয়সে এসে নিজের জীবনের গাঢ়তর অনুভব হয়। এ অনুভবে কখনও থাকে আরোগ্যের উচ্ছ্বাস আবার কখনও জীবনকে হারিয়ে ফেলার চিঠি।
সাগরিকাদি টুপ করে চলে গেল। অথচ অপারেশনের পরেও কত খুশি হয়ে বলেছিল ডাক্তারবাবু বলেছেন ‘অপারেটিভ ফিল্ড একদম ক্লিয়ার’। ফুসফুসে মেটাস্টেসিস হল। কয়েক মাসের মধ্যেই চলে গেল।
আমার চেম্বারের পাশেই ক্যাটারিঙ-এর দোকানে কাজ করে ছেলেটা। আমার চেয়ে বছর কয়েকের বড়। ছোটবেলায় একসাথে ক্রিকেট খেলতাম। জ্বর আর কমে না। ধরা পড়ল প্রাইমারি মায়েলোফাইব্রোসিস। বোন ম্যারো অ্যাস্পিরেট করার সময় বোন ম্যারোই নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। স্প্লিন বড় হয়ে গেছে। পেটে জল।
মাঝ বয়সের সঙ্কট আমাদের মনে করিয়ে দ্যায় এ জীবন কত মূল্যবান। আমরা যে আর খোকাটি নই সেটা বোঝার সময় এসে যায়। হাফ প্যান্ট পরে বর্ষায় পনেরোই অগস্টে মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্টে নেমে এ সি এল টিয়ার। পরকীয়ার চ্যাট বউয়ের আগেই পড়ে ফেলে ক্লাস এইটের মেয়ে।
সুতরাং দাঁড়াও পথিকবর। জন্ম যদি তব বঙ্গে তবে একটু দেখে রাস্তা পার হও। বাংলার এখন টালমাটাল অবস্থা। মিডল ওভারে একটু সিঙ্গলসের ওপর খেলো। তারপর স্লগ ওভার অব্দি টিঁকে থাকলে তখন নাহয় চালিয়ে খেলবে।
সঙ্গের ছবিটি শিল্পী শেখরদার ওয়াল থেকে নেওয়া। তার অনুমতি ছাড়াই।