চেম্বারে বসে আছে বিশ্ববন্ধু শাস্ত্রী।
বটকেষ্ট ভটচাজ… উঠতি জ্যোতিষী। চেনা সবাই ডাকে বটো।
ভেক নেবার আগে সে নাম পাল্টেছে। এখন তার নাম গ্রহাচার্য বিশ্ববন্ধু শাস্ত্রী। হালে একটা টিভির চ্যানেলেও বসে। একটাই। টিভিতে মুখ দেখালে টিভি কোম্পানি পয়সা দেয় এই রকমের ভাবে সবাই। ব্যাপার তা না। উলটে তাকেই পয়সা দিতে হয়। টিভিতে বসা মানে প্রচুর ইনভেস্টমেন্টের ব্যাপার। আস্তে আস্তে বাড়াবে। খবরের কাগজেও বিজ্ঞাপন বাড়াবে।
তার এই জ্যোতিষীর কাজে প্রচার লাগে। সত্যি বলতে কী সব স্বাধীন ব্যবসায়ই লাগে। ডাক্তারবাবুরা অবধি নিজেদের গুণপনা দিয়ে অ্যাড দেয়। প্যাডে আর সাইনবোর্ডে ডিগ্রি তো লেখেই তার সঙ্গে লেখে অনার্স, গোল্ডমেডালিস্ট আরও কত কী কী।
সে খুব ভয়ে ভয়ে গভঃ রেজিস্টার্ড আর স্বর্ণপদক কথাদুটো লেখা শুরু করেছে ইদানিং। যদিও কোথায় জ্যোতিষীদের নাম রেজিস্ট্রি করতে হয়, আদৌ তা করা যায় কী না, সে অতসব জানে না। আর স্বর্ণপদক ব্যাপারটা একটা কথার কথা।
তার গুরুর নির্দেশে বটো বিয়ে করেনি। আর্থিক অবস্থাও বিয়ে করার পক্ষে অনুকূল না। বউ থাকলে মুশকিল হত। গোল্ড মেডেলের ব্যাপারটায় সমস্যা হত। দেখতে চাইত। দাবী করত হয় তো, মেডেল ভাঙিয়ে দুগাছা চুড়ি বানিয়ে দাও।
তখন তাকে বুঝিয়ে বলতে হত, – আরে পাগলি, সোনা কী অত সস্তা যে কেউ আমাকে দেবে? সোনা পেলে তো তো তোমাকেই দিতুম, না কি?
কোনও ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি জিনিসটা ভাল না। এমন কী প্রচারেও। ঠিক ততটুকুই বলতে হবে যতটুকুতে লোকে অবাক হবে। তার ওস্তাদ তাকে শিখিয়ে গেছে। বটকেষ্ট শুনেছে এক মক্কেল নাকি বিজ্ঞাপনে লিখেছে, আকাশে রকেট পাঠিয়ে গ্রহদের শায়েস্তা করে। এই সব প্রচার বাড়াবাড়ি রকমের মিথ্যে। লোকে শুনলে হাসাহাসি করে।
আসলেই এই ভাগ্যগণনার শাস্ত্রটা তাকে খেতে পড়তে দেয় বটে কিন্তু এটা তত সত্যি কিনা বটকেষ্ট জানে না। সে মানুষের গ্রহের ফের রিপেয়ার করে। তার এই বিদ্যা গুরুমুখী।
সে নিজে এই বিদ্যা শিখেছে তার গুরু এক ফকিরের কাছ থেকে। ফকির শুনলে হেলাফেলা করার কিছু নেই। এই সব প্রাচীন বিদ্যা কার কাছে কোথায় কোথায় থাকে কেউই জানে না।
সে সেই ফকিরের কাছে জুটেছিল বেশ কবছর আগে। অনেকই বিদ্যা জানত সেই নয়নচাঁদ শাহ্ ফকির। লোকটা ফকির হলেও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল বেশ।
বটকেষ্ট ফকিরের বাড়িতেই থাকত তখন।
এই ফকির লেখাপড়া জানা গুনিন। কথার মাঝে মাঝে দুএকটা ইংরেজি ফোড়নও দিত। তার নাম আসলে আসানুল্লা। ওস্তাদ বলত সেটা ওর পূর্বজন্মের নাম। নিজেকে বলত হাইব্রিড ফকির।
সব লাইনেই আগে দেখনদারি পরে গুণ বিচারি। কাজেই সেই নয়নচাঁদ চুল রেখেছিল ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া। কাজের সময় পরনের পোষাক পরত রঙ বাহারি। আর চোখ ছিল ভাঁটার মত। এত সব করার পরও কিন্তু তার কাছে শেষের দিকে লোকে আসত কম।
– আসলেই এই দেশে প্রকৃত শিক্ষার দাম নাই। দীর্ঘশ্বাস চেপে শিষ্য বটকেষ্টকে বলত দরিদ্র নয়নচাঁদ।
তুক তাক মন্ত্র আচার এই সমস্তকে, ফকির কাজ না বলে বলত ক্রিয়া।
বটকেষ্ট তাকে বলত, — এত কিছু ক্রিয়া জানেন ওস্তাদ, এই দেশের লোকেদের একটা শাস্তি দেওয়া যায় না? ধরেন মারী-মন্ত্র কী ওই ধরণের কিছু। দেশের এক পাশ থেকে রোগ শুরু হয়ে মরতে শুরু করুক। তখন মুরুব্বিরা এসে পায়ে ধরবে। আপনি না হয় কাটান মন্ত্র দিয়ে দেবেন তখন।
— না রে পাগলা। লোক মরলে কাস্টমার পাব কোথায়?
আজকাল ইংরেজি মিডিয়ামের খুব দাম। তাই কথাবার্তার মধ্যে টুকটাক ইংরেজি ঢোকাত নয়নচাঁদ। বটকেষ্টকেও যত্ন করে শেখাত। এই যেমন, যে লোক প্রথম দিন আসবে সে হল কাস্টমার। আর সে যখন প্রতিকারের নিয়ম আর খরচাপাতি মেনে নিয়মিত ক্রিয়া করাতে রাজি হবে, সেই লোক তখন হল গিয়ে ক্লায়েন্ট।
এ দেশের নানান জায়গায় অনেক গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে গুনিনের গুহ্য বিদ্যার হাল হকিকত জোগাড় করেছিল ওস্তাদ নয়নচাঁদ। তার শখ নয়, বলতে গেলে একরকম দুরাশাই ছিল আফ্রিকা আর ইউরোপ যাবার।
আফ্রিকায় গিয়ে শিখবে ভুডু আরও কী সব যেন। আর বিলেতে গিয়ে ডাকিনীবিদ্যা, ব্ল্যাক ম্যাজিক।
তবে ফকিরের খুব আগ্রহ ছিল ক্রিস্টাল গেজিং নামের বিলিতি বিদ্যাটি শেখার ব্যাপারে। খাঁটি ক্রিস্টাল জোগাড় করা বহুত মুসিবতের ব্যাপার। বিলাতে গেলে পাওয়া যেতে পারে এই রকমের খবর ছিল তার কাছে।
– বুঝলি রে বটো, আমার সব বিদ্যে তোকেই দেব, যদি লেগে থাকিস। তবে উন্নতি করতে যদি চাস এই লাইনে বিয়ে করিসনে। আমায় দেখে শেখ। সাধনসঙ্গিনী থাকলে সাধনার পথে বিরাট বাধা। তোর গুরুমা এই রোকেয়াবানু ফকিরনির তাড়নায় আমার বিদেশ গমন হল না। অথচ হাতের রেখায় স্পষ্ট লেখা ছিল। এই দ্যাখ্, এই বলে শিষ্যের দিকে হাত ছড়িয়ে দিত নয়নচাঁদ। ঝুঁকে পড়ে দেখত বটকেষ্ট। বিদেশগমনের লাইনটা মুখস্থ করে নিত। যদিও সাধনসঙ্গিনীর রেখাটা কোথায় আর সেটা কীভাবেই বা বিদেশ যাবার টিকিট কাটতে বাধা দিয়েছে বুঝতে পারেনি বটকেষ্ট।
– অবশ্য বিলিতি বিদ্যার মত আমাদের এই দেশে সমান তেজি দেশি বিদ্যাও আছে।
যেমন ওই ক্রিস্টাল গেজিংএর মতনই এক দেশি বিদ্যা হল নখদর্পণ।
সেই নখদর্পণের এক ধাপ ওপরের বিদ্যা আয়নাবিদ্যা। সেইটি শিখতে পারলে নাকি আয়নার ভিতরে ঢুকে যাওয়া যায়। আয়নার সেই জগতে থাকে আয়নামতি। আয়নামতিরা একজন না অনেকজন। তাদের মধ্যে একজন যদি তোমাকে পছন্দ করল… আর চিন্তা নাই। সে তোমার ভার নিয়ে নেবে।শুধু আজকের ভার না। ভবিষ্যতেরও। সাত দিন পরে… কী সত্তর বছর পরে… কী ঘটবে সব তোমাকে দেখিয়ে দেবে। বলে দেবে প্রতিকারও।
তবে নিজের লাভের জন্য কিছু করা যাবে না। সেই রকম হলে তো সাত দিন পরের লটারির প্রাইজ পাওয়া নম্বর জেনে এসে আলিশান অট্টালিকায় থাকা যেত। বউ রোকেয়াকে মুড়ে দেওয়া যেত সোনার গয়নায়।
নয়নচাঁদ ফকিরের শেখার ইচ্ছা ব্যাপারটি খুব ছিল। এই আয়নার জগতে ঢোকার বিদ্যাটিও সে নাকি শিখেছিল যত্ন করে।
— তবে আর একটা কথা। আয়নার মধ্যে একবার ঢুকে গেলে কিন্তু বার হওয়া মুশকিল। সেই জন্যেই সাহস পাই না। বেশিবার ঢুকি না ওই আয়না জগতে।
নয়নচাঁদ নয় নয় করেও বিদ্যা জানত অনেক।
কিন্তু সেইসব বিদ্যাপ্রয়োগের সুযোগ পেত কম। শেষের দিকে ডাকই পেত না প্রায়। কিছু লোক খোঁজ খবর করে আসত বটে। বানমারা, জাদুটোনা, মারণ, উচাটন, বশীকরণের তত রমরমা নেই আর এ যুগে। সাধারণ মানুষের ভয় ভক্তি আকর্ষণের জন্য যে রকম চেহারা লাগে, নয়নচাঁদ চেষ্টা চরিত্র করে সেই রকমের চেহারা বানিয়েছিল বটে। তাতে লাভ হয়নি তেমন।
কাউকে টাইট দিতে হলে আজকাল লোকে গুনিন খোঁজে না। নেতা খুঁজে নেয়। এমনকি কাউকে বশীকরণের দরকার হলেও। হাতে টাকা গুঁজে দিতে পারলেই বশ হয়ে যাবে। নইলে সুপারি দেয়। চারিদিকে নাকি অর্থবিজ্ঞানের জয়জয়কার।
কিছু মানুষ অবশ্যি ভাগ্য, গ্রহশান্তি, পাথর দিয়ে গ্রহদের শায়েস্তা করা এই সবে বিশ্বাস এখনও বজায় রেখেছে। তাদের মত লোকেরাই আসে। অতি অল্প যদিও। যারা আসে খুবই দরিদ্র। কাজেই তাদের গুনিনও দরিদ্রই রয়ে যায়।
মজার ব্যাপার বিজ্ঞান যাদের বেশি জানার কথা, তারাও বেশ পাথর তাবিজ পরে। নামকরা ডাক্তার উকিলদের আঙুলে দশবিশখানা গ্রহ আংটি হরবখত। কিন্তু তারা যায় নাম করা গ্রহরত্নের দোকানে। নয়নচাঁদের ঠিকানা তারা জানে না। জানতে চায়ও না।
বউ রোকেয়াবানু নয়নচাঁদের এই এত সব বিদ্যা মোটে মানতেই চাইত না। একরকম অবিশ্বাসই করত। নানান বিদ্যায় এত শক্তিশালী যে নয়নচাঁদ তাকে মোটে ভয় পেত না বটকেষ্টর সেই গুরুমা।
গুরুমার শরীর ছিল রোগাভোগা। বটকেষ্ট যদ্দিন থেকে তাকে দেখেছে… বিছানায় শোয়া। শরীর নড়ত না বটে, খরশান জিভ কিন্তু নড়ত খুব। – কপাল আমার, এত বিদ্যের ভুজুং দিয়ে বে করলে আমায়। তার ছিঁটেফোঁটাও দেকাতে পাল্লে না ককনো। এর চে ঘরামি কী রিস্কাওলা হলেও তো পাত্তে! দুবেলা পেট পুরে খেতে পেতুম তাইলে!
প্রথমে আড়ালে বলত। পরে বটকেষ্টর সামনেই বলত। হয় তো এক আধটা কাস্টমারের সামনেও। গরিব ফকিরের বাড়িতে পর্দা ছিল না তেমন।
নয়নচাঁদ অপ্রতিভের মত হাসত।
কখনও রেগেও যেত অতিষ্ঠ হয়ে। ধমকে বলত, —- নেহাত মায়ায় পড়ে গেছি, তাই। নইলে একমুঠো সরষে মন্তর পড়ে ছুঁড়ে দিতুম গায়ে। যেখানে যেখানে লাগত, পুড়ে এক ইঞ্চি গত্ত হয়ে যেত মাগীর।
—- ওঃ, বান মারবে? মারো না। দেকি কত সাদ্দ্যি তোমার। সাদ্দ্যি থাকলে খানকতক জ্বিন পেরেত ডেকে রোগ সারিয়ে দাও আমার, নইলে খেয়ে নিতে বলো আমাকে।
একদম শেষের দিকে জ্যান্ত কঙ্কালের মত গুরুমাকে দেখে শিউরে উঠত বটকেষ্ট। প্রবল সন্দেহে ভয়ে ভয়ে গুরুকে জিজ্ঞেস করল একদিন, —- ফকিরসাব কি শেষমেশ গুরুমাকে বানই মেরেচেন?
— নাঃ বান মারিনি। জ্বিনচালনা করিচি। কী করা? জ্বিনেরে ডেকে বললাম সারিয়ে দাও ওরে। পারল না। তখন ওই জ্বিনটাই বলল, মানুষটার রোগ যখন সারাতে পাচ্চি না, ওরে খেয়ে ফেলি। এই সব বদরাগী জ্বিনের নিয়ম এইরকমই বুঝলি বটো! হয় পারবে নয় মারবে! একবার জ্বিন চালনা হয়ে গেলে আর তাকে ফিরত আনা যায় না।
বটকেষ্টর এই সব কথা ভালো লাগেনি। সে নিজেই তার গুরুমাকে নিয়ে এলাকার সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। তিনদিন সেখানে থেকে মরে গেল গুরুমা। মারা যাবার আগে গলার আওয়াজ ফিসফিসে। বটকেষ্টকে পই পই করে বলেছিল,
— ওই ফকিরি বিদ্যেটিদ্যে কিচ্চু শেকার দরকার নেই তোর। সব মিথ্যে কথা। যদি পারিস তোর ওস্তাদকে দেখে রাখিস। আহারে, মানুষটা সারা জীবন ভুল বিদ্যার পিছনে দৌড়াল। না পেল টাকা পয়সার খোঁজ, না পেল তার আয়নামতিকে।
আয়নামতিকে বোধহয় আসলে হিংসে করত রোকেয়াবানু।
কে জানে সেই চালনা করা জ্বিনের খিদে গুরুমাকে খেয়েও মেটেনি বোধহয়।
নয়নচাঁদ ফকিরও কী কপাল… বটকেষ্টকে সব বিদ্যে ঠিক ঠিক শেখানোর আগেই মরে গেল। জ্বিনটাই তাকে খেল নাকি? বলেছিল, কিছু না শেখাই, আয়না বিদ্যাটা শেখাব তোকে।
বটকেষ্ট তারপর থেকেই ঝাড়া হাত পা মানুষ। আদৌ কাজ হয় কী না হয় সে জানে না। তবে তার ওই ওস্তাদ নয়নচাঁদ ফকিরের শেখানো খুদকুঁড়ো বিদ্যে সম্বল করেই চলেছে সে।
বটকেষ্ট কিন্তু ফকির বা গুনিন হয়নি। সে ভেক ধরেছে গ্রহাচার্যের। গ্রহ শান্তি করে। বলতে নেই টুকটাক ব্যবসাও হচ্ছে মন্দ না। কেউ চাইলে বানমারা বশীকরণ এই সবও করে। পুরোনো একটা কমপিউটার কিনেছে। কাস্টমারকে দেখিয়ে কিবোর্ড টেপাটিপি করে। লোকে ওই টুকটাক ইংরেজি বলা র মত কমপিউটার ব্যাপারটাও খায় খুব।
গুরু বলত নিজের বিদ্যের ওপর বিশ্বাস রাখবি। তাই কাজ হোক না হোক, নিজের বিদ্যেকে বিশ্বাস করতেই হয় গুরুর আজ্ঞা মেনে।
গুরুদেব খুব বলত আর একটা ব্যাপার। যোগাসন দুএকটা করলে গ্রহশান্তি হোক না হোক শরীরের শান্তি তো হবেই।
নয়নচাঁদের সেই আইডিয়া জুড়ে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে ছোটোমোটো কয়েকটা নতুন আইটেম তৈরি করেছে বটকেষ্ট। রামদেবের দু একটা যোগের কায়দা কসরতের সঙ্গে গ্রহমুক্তির বক্তৃতা জুড়েছে। বক্তৃতাটা নিজেই দেয়। নাম দিয়েছে গালভারি। যৌগিক গ্রহরোগমুক্তি।
রাহু কুপিত হলে এই আসন। বৃহস্পতি কী শনিকে তুষ্ট করতে আর এক আসন। এবার বক্তৃতা আর আসন দুটোকে পাঞ্চ করে সাইবার কাফের এক ছেলেকে দিয়ে ভিডিও ক্লিপিং বানিয়ে নিয়ে পেন ড্রাইভে করে সাপ্লাই করে ক্লায়েন্টকে। দেখে দেখে প্র্যাকটিশ করতে হবে। এই সব আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাপারস্যাপার পেলে ইউটিউব গুগল ঘাঁটা ভাগ্যসন্ধানীরা খুশি হয়।
গুরুর কথা মেনেই বটো বিয়ে করেনি আজও। এ ব্যাপারে মনে মনে গোপন একটি বাসনা আছে তার। ওস্তাদ তো শেখানোর আগেই চলে গেল। যদি ওই আয়নাবিদ্যাটি শিখতে পারে… কোনওরকমে একবার, আয়নামতির সঙ্গে যদি দেখা হয়, তাকেই প্রস্তাব দিয়ে দেখবে। মানে, ইয়ে, ওই সংসার পাতার।
ইদানিং বোধ হচ্চে একটা সাকরেদ পেলে মন্দ হয় না। হেল্পার গোছের। ওরই মত ঝাড়া হাত পা। একটা পিছুটান না থাকা ছেলে।
তা পেয়েও গেল। ভুবনহাটিতে ভাতের হোটেলে নিজের চাহিদার মাপসই বলতে গেলে ঠিক খাপে খাপ নবকুমারকে পেয়ে গেল বটকেষ্ট ওরফে বিশ্ববন্ধু শাস্ত্রী।
আগেকার দিনে বলত গুনিনের আখড়া। এখন তাকেই বলে চেম্বার। সেই চেম্বারে নিজস্ব হেল্পার দরকার।
এমনিতে ভাগ্যগণনার লাইনের নিয়ম কাউকে চেম্বারের ঠিকানা বলতে গেলে রটাতে হয় বড় বড় শহরের নাম। আসানসোল, দুর্গাপুর, রামপুরহাট, শিলিগুড়ি। আসলে কিন্তু আমাদের এই গুনিনটি ব্যবসাটি হয় একটু ভেতরপানে… গাঁয়ে গঞ্জে।
এই এখানেই যেমন। বাসে ভুবনহাটি নেমে সেখান থেকে ভ্যানে করে রাইডাঙায় চেম্বার। ভোলা স্যাকরার সোনার দোকানের একটেরে। মাসে একদিন। ফিজ দুশো এক টাকা। বিফলে মূল্য ফেরত। ভোলা কমিশন নেয় প্রতি কেসে। তা নিক। কেস তো ভোলাই জোগাড় করে!
বটকেষ্ট রাইডাঙা থেকে ফেরার পথে ভুবনহাটির এই হোটেলে খেয়ে বাড়ি ফেরার বাস ধরে। সেখানেই নবকুমারের সঙ্গে আলাপ হল।
দিব্যি ডাঁটো ছেলে। নবকুমার সরকার। বাড়ির লোক বলতে কেউ নেই। পরপর কয়েকমাসে একটু জেঁকে আলাপ হতেই টোপ ফেলল। – অ্যাই নব, আমার সঙ্গে থাকবি? আমার চেম্বারে কাজ করবি? হেল্পারের কাজ। কাজ কত্তে কত্তে একটু আধটু শিখেও যাবি!
নব প্রস্তাব শুনেই লাফিয়ে উঠেছিল। এই ভাগ্য গোনা লোকটাকে তার বেশ পছন্দ। আর হেল্পার কথাটা তার খুবই চেনা।
আসলে এই নবদের ফ্যামিলি হল হেল্পার ফ্যামিলি। নবর বাবা ছিল কলমিস্তিরির হেল্পার। সত্যিকারের কলমিস্তিরি হয়ে উঠতে পারেনি। মিস্তিরির কাজের সময় এটা ওটা ধরত, এগিয়ে দিত। খোঁড়াখুঁড়ি করত। জলের ট্যাঙ্কে নেমে আয়রন ময়লা পরিষ্কার করত।
বাবার বাবা ঠাকুদ্দা ছিল একটু ওপরের দরের। মোটর গাড়ির হেল্পার। তার ঠাকুদ্দা বলত সে আমলে খুব পেস্টিজ ছিল গাড়ির হেল্পারির সেই কাজের। তখনকার দিনে চাবি ঘুরুলেই গাড়ি এস্টাট, এই রকমের ছিল না।
গাড়ির সামনে একটা ফুটো থাকত। সেইখান দিয়ে একখান লোহার ডাণ্ডা ঢুকিয়ে হেঁইয়ো বলে সেই ডাণ্ডা বার কতক ঘুরোলে তবে গোঁ গোঁ করে তখনকার মোটোর এস্টাট নিত। ঠাকুদ্দা চোখ বড়বড় করে বলত। নবও চোখ বড়। কতই বা বয়স তখন নবর। পাঁচ কী ছয়। নাকের শিকনি জামায় মুছে নিয়ে ঠাকুদ্দার সেই ব্যাখ্যান শুনত। – পুরো সিনেমা, বুইলি দাদু! সিনটা জম্পেশ। দেকলে মনে হত ডেরাইভারের সিটে উত্তম কুমার। পিঠ টানটান। আমি রবি ঘোষ। হেঁইয়ো জোয়ান বলে রড ঢুকিয়ে পাক দিচ্চি!
– হ্যাঁ দাদু, তোমার ওই উত্তমকুমার না কী যেন, ওই ডেরাইভার হতে সাধ হত না?
– দূর পাগল! সে কালে অনেকে হেল্পারি কত্তে কত্তে ডেরাইভার হয়ে যেত বটে। কিন্তু সে কপাল কি সবার হয় রে চাঁদু? আমি তা সেই হেল্পারই রয়ে গেলাম। শেষমেশ বাসের হেল্পারি। সেই বাসেই অ্যাকসিটেনের পর ধরা পড়ে মার খেয়ে মত্তে মত্তে বাঁচলুম। খোঁড়া হয়ে গেল ডান পাটা। তোর বাপ তাই দেকে আর ও লাইনে গেল না। তা কল মিস্তিরির হেল্পারিও খারাপ না। রাজমিস্তিরির ইট বওয়া হেল্পারির চেয়ে ভালো।
– আমিও কি তবে ওই হেল্পারিই করব? হ্যাঁ দাদু?
– তোর বাপের তো ইচ্ছে তোরে লেখাপড়া শিকিয়ে অন্য কী সব বানাবে।
এই সব কথা সেই বুড়োর সঙ্গে হত। যদ্দিন বেঁচে ছিল।
বুড়ো মরে যাবার আগে কয়েকটা জিনিস দিয়ে গেছিল ওকে। ভারি যত্নের ওই কটা জিনিসই মাত্তর ছিল বুড়োর। বলত নাকি জাদুঘরে দেবে। মোটোর গাড়ি স্টার্ট করার ডান্ডা এক খানা আর একটা ইয়াব্বড় লুকিং গ্লাস। দাদু বলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের। তাকে নাকি কোন ড্রাইভার দিয়েছে। ঠাকুদ্দা বলে গেছিল, যত্ন করে রাখিস।
ঠাকুদ্দা বুড়ো মরার পরপরই মরল মা আর বাবা। গ্রাম সম্পর্কে এক কাকা কদিন রাখল বটে। তখনও নব ইশকুলে পড়ছিল। কিন্তু কাকিমার জ্বালায় টেকা অসহ্য হয়ে উঠল। বিনিপয়সায় মিনি মাগনা চাকর পেয়েছে। তাতেও আপত্তি।
আর তাছাড়া কেলাস এইটের পর নব বুঝে গেল লেখা পড়ার লাইনটা তার না। অ্যাদ্দিন যে পড়ল তাও একটা যুক্তি ছিল। মিড ডে মিল। কেলাস নাইন থেকে সেটাও বন্ধ। নরকে গেলেও ওই হেল্পারিই কত্তে হবে তাকে। কাকার বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে ঢুকল পরিতোষের ভাতের হোটেলে। ভুবনহাটি বাজারে।
এই হল একলা ছেলে নবকুমারের বিবরণ।
ভাতের হোটেল ছেড়ে সে এখন থাকে গ্রহাচার্য বিশ্ববন্ধুর কাছে।
বটকেষ্টকে হোটেলে কাজ করার সময় দাদা বলে ডাকত বটে, এখন এই হেল্পারের নয়া অবতারে তার ওপর কড়া নির্দেশ ওই দাদাটাদা ডাকা চলবে না। স্যার বলতে হবে। তাইই বলে। কত্তার ইচ্ছেয় কম্মো।
★
কয়েকদিন ধরে বটকেষ্টর মন ভারি আনচান। ওস্তাদের ওই ক্রিস্ট্যাল গেজিংএর ব্যাপারটা সে কমপিউটারে নেটটেট ঘেঁটে হদিশ পেয়েছে। বিলেত নয় বাড়িতে বসেই অ্যামাজনে ফরচুন টেলার ক্রিস্টাল বল নাকি পাওয়া যাবে।
ব্যাপার বিশাল গোলমেলে। চারশ টাকা থেকে চব্বিশ হাজার টাকা দর। বোঝো ব্যাপার। আসল নকল কে বলবে? দরকার নেই ও সব ঠকবাজির কারবারে। তার চেয়ে দেশি আয়নাবিদ্যাই ভালো।
ওই আয়না বিদ্যার একটা হিল্লে হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। ওস্তাদের পুরোনো একটা ছেঁড়া খাতা ঘেঁটে কিছু মন্ত্র আর ক্রিয়ার হদিশ পেয়েছে। মুশকিল এই যে প্রবেশ মন্ত্র আছে। বেরোবার মন্ত্রের জায়গাটা পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ছেঁড়া।
আয়নাবিদ্যার ব্যাপার তেমন বড় কিছু না। বলতে গেলে একরকম নিখরচায় ব্যবস্থা। দরকার শুধু একটা অন্তত পঞ্চাশ একশ বছরের পুরোনো আয়না। আর সামান্য কিছু কম দামের ক্রিয়া উপাচার। বাকিটা মন্ত্র।
পুরো ব্যাপারটা সে নবকুমারকে বলেছে। আর তো বলবার মত কাছের কেউ নেই!
নব ছেলেটা বড় হয়েছে। কৌতূহলীও খুব। আয়নাটা সেই জোগাড় করে দিল। ওর সেই হেল্পার দাদুর রেখে যাওয়া পুরোনো আয়না।
এই বার ওই মন্ত্রের ক্রিয়াটিয়া সেরে টুক করে আয়নার ভেতরে ঢুকে পড়া শুধু বাকি। ওই বেরিয়ে আসার কায়দাটা জানতে পারলেই ব্যাস। মন্ত্র ইত্যাদি পড়ে আয়নাটা রেডি করে গুছিয়ে রেখেছে বটকেষ্ট।
★
এর কদিন পরেই নব উধাও।
একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে। বেশ গুছিয়ে লিখেছে চিঠিটা।
শ্রীচরণেষু স্যার,
আয়নামতির খোঁজে চললাম। আয়নার থেকে বেরিয়ে আসার কায়দা শেখা হল না।
আয়নামতিকে পেয়ে গেলে ওখান থেকে ফেরার ইচ্ছেও আমার নেই।
সত্যি বলতে কী, আয়নাটা তো আমারই। ওর ভেতরের জগতটাও কাজেই আমারই ।
আপনি আমার প্রণাম নেবেন।
ইতি
আপনার নবকুমার।
★
চিঠিটা পাবার পর বটকেষ্ট পাগলের মত সেই আয়না মানে সেই লুকিং গ্লাসটার ভেতরে উঁকিঝুঁকি মেরে নবকুমারকে খুঁজল খুব।
সেই সময়েই ঘটনা ঘটল। হাত ফস্কে মেঝেতে পড়ে সেই ঝাপসা আয়না শত টুকরো।
নব আছে কোনও একটা টুকরোয়। কোন টুকরোটায় আছে… কে জানে।