চুম্বক
তিন বন্ধু ফিরে গেছে তাদেরই একজনের গ্রামের বাড়িতে, যেখানে অনেক বছর আগে, স্কুলে পড়ার সময় ওরা একবার ছুটি কাটিয়েছিল। সেবারে ওদের একজন বন্ধুদের চ্যালেঞ্জ করে রাতে যাচ্ছিল অ্যাডভেঞ্চার করতে শ্মশানে। সেখানে বছরে এক রাত দেখা যায় এক অতৃপ্ত আত্না। পথে ভূতের আক্রমণ। দেখা যায় ওদেরই একজনের বোন। বড়ো হয়ে ফিরে গিয়ে জানতে পারে সেই বোন আর নেই। মারা গেছে এ কয় বছরের মধ্যে। তারপর…
____________________
আমি যে শেষ অবধি শ্মশান পর্যন্ত গিয়ে গাছের গায়ে ফিতে বেঁধে আসিনি, সেটা তারপর প্রায়ই শুনতে হয়েছে সুমোহনের কাছে। যে কোনও তর্কে হারতে শুরু করলেই বলে, তুই আর কথা বলিস না, একটা মেয়ে ভয় দেখাল বলে দুদ্দাড়িয়ে পালিয়ে এলি। ভাগ্যিস এখন আর মারামারির বয়েস নেই, না হলে ঘুঁষোঘুঁষি হয়েছে ক্লাস ইলেভেনেও!
আজও হঠাৎ বলল, তুই যে শ্মশানে গেছিলি, সেটা কবে ছিল মনে আছে?
মনে ছিল। বললাম, ডিসেম্বরের আঠাশ।
একটু অবাক হয়ে অঙ্কন বলল, এতদিন পরে তোর এত এক্স্যাক্ট ডেট কী করে মনে থাকে?
আমি বললাম, সব ডেট মনে থাকে কই? তোদের জন্মদিনও মোবাইলে লিখে রিমাইন্ডার দিয়ে রাখি। তবে এটা মনে আছে কারণ কাকাবাবু একটা অঙ্ক বলেছিলেন। পঁচিশে ডিসেম্বর প্লাস তিন, একত্রিশে ডিসেম্বর মাইনাস তিন। আঠাশ।
সুমোহন বলল, বাবা! কোথায় লাগে হাতির স্মৃতিশক্তি!
আমি হেসে বললাম, বিশ্বাস না হয়, তপোধন স্মৃতিরক্ষা কমিটিকে জিজ্ঞেস করে দেখ?
অঙ্কন বলল, আরে, দূর তপোধন স্মৃতি… তো কেবল কাকাবাবুরই স্মৃতি। কাকাবাবু যাবার পরে বছর দুয়েক টানাটানি করে চলেছিল, তারপর বন্ধ হয়ে গেছে সে কবে!
সুমোহন বলল, তাহলে তপোধনের আত্মা…?
অঙ্কন বলল, সেটাও কতটা কাকাবাবুর সৃষ্টি সে নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
আমার সেটাই সন্দেহ হয়েছিল সেই তখন। তখনও কিছু বলিনি, এখনও বললাম না।
সুমোহন বলল, তাহলে তো আর আপত্তির কারণ থাকতে পারে না?
আমি আর অঙ্কন অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। অঙ্কন বলল, কিসের আপত্তি?
সুমোহন বলল, এখনও চার দিন বাকি, কোয়েস্টটা খতম করে আসতে পারিস…
আমি বললাম, শালা মহা ইয়ে তো তুই! এখনও ওই একই ফাটা রেকর্ড বাজাচ্ছিস?
সুমোহন বলল, তাহলে স্বীকার করে নে, তুই ভয় পাস।
অঙ্কন বলল, আচ্ছা হ্যাপা যা হোক! এখন কী সেই বাচ্চা বয়স আছে?
সুমোহন বলল, ভয় পাবার আবার বাচ্চা বুড়ো কী রে?
অঙ্কন বলল, সেটা তোর ক্ষেত্রে। আমাদের কাছে আর ওই থ্রিল নেই।
সুমোহন তেড়িয়া হয়ে বলল, তুই ভয় পাস। আগের বারও ভয় পেয়ে যাসনি।
অঙ্কন মাথা নেড়ে বলল, মোটেই তা নয়। আমি বোকা বোকা ছেলেমানুষী পছন্দ করি না।
আমি বললাম, আমি বুঝি বোকা বোকা ছেলেমানুষী করি?
এবারে অঙ্কন আর আমার ঝগড়া লাগার আগেই সুমোহন বলল, তাহলে যা, ঘুরে আয় শ্মশানে।
রেগে বললাম, তোর সব পাজামার দড়ি খুলে নিয়ে যাব। দু’হাতে পাজামা ধরে ঘুরে বেড়াবি।
মাথা নেড়ে সুমোহন বলল, না। এবারের চ্যালেঞ্জ অন্য। সারারাত থাকতে হবে।
আমি অস্ফূটে একটা গালি দিয়ে বললাম, ইয়ারকি!
তখনকার মতো আলোচনাটা থেমে গেল, কিন্তু আমার মাথায় কথাটা রয়েই গেল। শ্মশানে বলে নয়, বিছানা বালিশ তাকিয়ার আরাম ছেড়ে সারারাত শীতের আকাশের নিচে বসে থাকা, ফ্লাস্ক থেকে চুমুকে চুমুকে কফি খাওয়া — আর জীবন সম্বন্ধে, পৃথিবী সম্বন্ধে, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আকাশ-পাতাল চিন্তা করার এরকম সুযোগ খুব বেশি আসে না। নিশ্চিন্ত যৌবন আর বেশিদিন নেই। বাড়িতে এর মধ্যেই মেয়ে দেখা শুরু হয়েছে। সংসারজালে জড়ালে আর এমন নির্ঝঞ্ঝাট একাকীত্ব উপভোগ করতে পারব না। কবে শেষ এমন পাগলামি করেছি? কবেই বা আবার করব?
একই সঙ্গে সুমোহনের ওসকানিও চলতে থাকল — নিশীথ, দেখ, আজীবনের ‘ভীতু’ বদনামের হাত থেকে নিজেকে মুক্তি দেবার এই এক সুযোগ। এই চান্স ছেড়ে দিবি?
বড়োদিনের দিন কাউকে কিছু না-বলে দুপুরে বেড়িয়ে এলাম শ্মশান থেকে। জায়গাটা বিশেষ বদলায়নি মনে হলো। রাস্তার দু’ধারে আমন ধান পেকেছে, আর কয়েক দিনের মধ্যেই কাটা শুরু হবে। শ্মশানে সেই বিশাল ঝাঁকড়া গাছটা এখনও রয়েছে, তার নিচে শ্মশানযাত্রীদের জন্য আস্তানাটা বোধহয় আগে পাকা বাড়ি ছিল না, বা হয়ত ছিল — অধুনা মেরামত হয়ে উজ্জ্বল সাদা-নীল ডোরাকাটা হয়েছে বলে চোখে পড়ছে। খোলা মাঠে হিমের হাত থেকে বাঁচতে এ-ই যথেষ্ট।
মনে মনে একটা উত্তেজনা নিয়ে ফিরলাম। বিকেলের চায়ের আয়োজন করছে লতা আর তিসি, অঙ্কনের দুই ভাইয়ের বউ, আমার প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে মুখ তাকাতাকি করল।— ফ্লাস্ক তো আছে, কিন্তু সে নিয়ে কী করবেন, নিশীথদা?
এখন আমাদের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, কেন কখন কবে কী করব, সে কৈফিয়ৎ না দিলেও চলে, কিন্তু সৌজন্যের খাতিরে বলতেই হয় কিছু একটা। আসল কারণটা বললাম না। অঙ্কণের কাকুসোনা এখনও আছেন। তিন কাকিমার মধ্যে দুজন বর্তমান। অতিথি শ্মশানে রাত্রি যাপন করবে শুনলে কী ধরনের ব্যাগড়া দেবেন, জানি না। আমার আগের বারের দুঃসাহসিক অভিযান ওঁরা কতটা মনে রেখেছেন, বা সে সম্বন্ধে ওঁদের কী ধারণা, তা-ও জানি না। তাই বললাম, সঙ্গে কফি নিয়ে গ্রাম পেরিয়ে ওদিকটায় নদীতীর অবধি ঘুরে আসব একদিন।
অঙ্কনদের বাড়িতে কফির চল নেই, ধান রোয়া বা ধান কাটার সময় যে ফ্লাস্কে চা নিয়ে অঙ্কনের ভাইয়েরা কাজে যায়, সেগুলো কোথায় রয়েছে দেখিয়ে তিসি বলল, কবে যাবেন? আপনার ছুটি তো প্রায় শেষ। বলবেন, চা বানিয়ে দেব।
তা বটে, ছুটি ফুরিয়ে এসেছে। পাহাড়ি স্কুলের লম্বা শীতের ছুটি আর ফিরে আসবে না এ জীবনে। তিনতলায় গিয়ে দেখি অঙ্কন আর সুমোহন চা খেতে নামার উদ্যোগ করছে। বলল, কোথায় গেছিলি?
অঙ্কনকে বললাম, দু-ফ্লাস্ক কফি তোকে অর্গানাইজ করতে হবে। ফ্লাস্ক কোথায় রাখা থাকে দেখে এসেছি, কফি পাওয়া যায় সামনের মুদির দোকানে, কিন্তু তাতে গরম জল, দুধ, চিনি ফেলার দায়িত্ব তোর। আমার প্ল্যান শুনে অঙ্কন প্রথমে অত্যন্ত বিরক্ত হলো। ছেলেমানুষ, পাগলা… এসব নানা বিশেষণেও আমার বিশেষ হেলদোল হলো না দেখে শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, যা খুশি কর। মুদির দোকান থেকেই কফি, চিনি আর গুঁড়ো দুধও নিয়ে এলাম আমি, নির্দিষ্ট দিনে ঠিক সময়মতো রান্নাঘর থেকে ডেকচি নিয়ে এসে ওর বোনের হিটারে কফির জল গরম করার দায়িত্ব নিল অঙ্কন।
এবারে অত লুকোচুরি না করলেও, তপোধনের মৃত্যুদিনে রাত এগারোটায় বেরিয়ে অঙ্কনের এক ভাইয়ের সাইকেলটা ‘ধার করে’ রওয়ানা দিলাম কাউকে কিছু না-বলেই। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার কল্যাণে গ্রামের রাস্তা এখন কংক্রিটের, এবং গ্রামের চৌহদ্দি অবধি কিছু দূরে দূরে সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্প জ্বলে — ফলে দশ মিনিটেরও কম সময়ে হাজির হলাম অকুস্থলে। পথে আগের বার যেখানে শান্তি আমার যাত্রা ভঙ্গ করেছিল, সেখানে এক মুহূর্ত থেমে ওর আত্মার শান্তি চাইতেও ভুলিনি।
গ্রামের শ্মশান অন্ধকার, জনশূন্য। এখানে শহরের মতো হাজারো পুরোহিত, ডোম, সরকারি কর্মচারীদের হইচই, আনাগোনা নেই। একজনই কর্মচারী রয়েছেন, তাঁকে গ্রাম থেকে ডেকে আনতে হয় সরকারি বিধি অনুযায়ী মৃত্যু নথিভুক্ত করতে। আজ কেউ নেই। মনে মনে অঙ্ক কষলাম। ১৯৬০ বা ৭০-এর দশকের কোনও সময় — কাকাবাবু সাল-টা আমাদের বলেননি, আমরাও জিজ্ঞেস করিনি, আজকের রাতে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার মুহূর্তে তরুণ তপোধন এই রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিল পুলিশের গুলি খেয়ে। জানি না কেন তপোধন নকশাল আন্দোলন করেছিল। জানি না অত হাজার হাজার তরুণ যুবককে কেন মরতে হয়েছিল। নকশাল আন্দোলন সম্বন্ধে কিছুই জানি না। সে কথা আমাদের স্কুলের ইতিহাস সিলেবাসে পড়তেও হয়নি, আর তপোধন সরকারের মতো কারও কথা আমাদের বাবা মায়ের মুখে না শুনলে কেউ নকশাল শব্দটাই হয়ত জানত না। কিছু কি পাওয়া গেছিল সেই আন্দোলনের ফলে? তা-ও জানি না। ঐতিহাসিকরা জানবেন হয়ত, আমরা হয়ত কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম। উত্তর পেতাম কি না জানি না।
শীতের রাত ঝিমঝিম। আমি তৈরি হয়েই এসেছিলাম। সঙ্গে ব্যাকপ্যাকে দুটো কম্বল, পরনে উলিকটের গেঞ্জি, প্যান্ট, মোটা সোয়েটার, দস্তানা, মাঙ্কি ক্যাপ। শ্মশান যাত্রীদের বিশ্রামের ঘরে একটা কম্বল বিছিয়ে, আর একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে পায়চারি করলাম কিছুক্ষণ। তারপর বিশ্রামকক্ষে মশা-তাড়ানোর ধূপ জ্বেলে বসলাম। চারিদিক অন্ধকার। এরকম অন্ধকারে, বিশাল উন্মুক্ত আকাশের নিচে, মনুষ্যজাতির একাকীত্ব আর ক্ষুদ্রতা বড়ো প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
একা একা রাত জাগা সহজ নয়। কম্বল মুড়ি দিয়ে ঝিমোচ্ছিলাম। জেগে উঠলাম চমকে… একটা শব্দ শুনেছি কি? চাপাস্বরে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ? তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। শ্মশানে আলো নেই। গ্রামের সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পগুলো দূরের আকাশে লালচে হলদেটা আভা ছড়িয়ে রেখেছে। কিন্তু কাছাকাছি সব অন্ধকার। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে বাইরের দিকে এদিক ওদিক ফেললাম। কিছু দেখতে পেলাম না। আলো অল্প, কিন্তু তার ছোট্ট বৃত্তে কিছু নেই। ভুল শুনেছি। আবার বসলাম যেখানে ছিলাম, সেখানেই।
জেগে থাকার জন্যও, সময় কাটানোর জন্যও কফি খাচ্ছিলাম ঘন ঘন। একটা ফ্লাস্ক উপুড় করে খালি করলাম। ঘড়ির কাঁটা রাত একটা পার করেছে কিছুক্ষণ হলো। এইভাবেই চালালে ভোর চারটে অবধি চলবে না…
কফি খাচ্ছেন?
ধড়ফড় করে উঠেছিল বুকটা। হাত স্লিপ করে ফ্লাস্কটা প্রায় পড়েছিল আর কী! কোনও রকমে খপ করে ধরে সামলালাম। মোবাইলের আলো জ্বালালাম। আমার ঠিক পেছনেই, বিশ্রামাগারের বাইরে, কোমর-সমান দেওয়ালের ওপর কনুই ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমারই মতন কম্বলমুড়ি দেওয়া এক মূর্তি। তবে এঁর মাথা খালি, ঝাঁকড়া, না-আঁচড়ানো, নোংরা চুল, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, বড়ো বড়ো চোখ, প্রায় উদ্ভ্রান্ত চেহারা। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে বয়স আমার চেয়ে বেশি। অনেকটাই বেশি। তিরিশের কোঠায়। চেনা চেনা? একটু ভাবার চেষ্টা করলাম, বহু বছর আগে দেখা তপোধনের ছবির সঙ্গে কোনও মিল আছে কি না।
ভাবতে গিয়ে খেয়াল করিনি যে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়নি। মূর্তি বললেন, রাস্তা থেকে কফির গন্ধ পেলাম। বেশ জব্বর গন্ধ। বিদেশি?
আমি বললাম, না না, গ্রামের দোকান থেকে কেনা কফির স্যাশে দিয়ে বানানো। ভেতরে আসুন না, খাবেন কফি?
উনি হাতে ভর দিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে দেওয়ালের ওপার থেকে এপারে এসে পড়লেন। বললেন, কফি খাওয়া হয় না মোটেই।
আমি দ্বিতীয় ফ্লাস্কটা খুলে আধ ঢাকনা কফি ঢেলে দিলাম, উনি বললেন, অত না, অত না… ঘুম হবে না নইলে।
রাত্তির প্রায় দুটোর সময় কে ঘুম না হওয়া নিয়ে মাথা ঘামায়? তা-ও একটু কমিয়ে নিয়ে কাপটা বাড়িয়ে দিলাম। বললাম, এইটুকু খেতে পারবেন।
উনি কাপ নিয়ে বললেন, আপনি ওই চৌধুরীবাড়িতে এসেছেন না? অঙ্কন চৌধুরীর বন্ধু?
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। বললাম, আপনি? গ্রামেই থাকেন?
উনি উত্তর দিলেন না। বললেন, অনেক বছর আগে অঙ্কন চৌধুরীর দু’জন ইশকুলের বন্ধু এসেছিল, তারা…
আমি বললাম, আমরাই। তখনও আমরাই এসেছিলাম।
উনি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে সেবারেও কি আপনিই এসেছিলেন রাতের বেলা শ্মশানে ঘুরতে?
চমকে উঠলাম। বললাম, আপনি কী করে জানেন সে কথা?
উনি হেসে বললেন, আমি দেখেছিলাম। ওই ওখান থেকে। শান্তি আপনাকে ভয় দেখাতে এসেছিল। আপনি তাড়া করে ধরলেন। তারপর ওকে নিয়ে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে চলে গেলেন।
আমি অত্যন্ত অবাক হয়ে বললাম, আমি তো আপনাকে দেখিনি…
উনি মাথা নেড়ে বললেন, আপনি যখন সাইকেল ফেলে তাড়া করে গেলেন, তখন আমি অনেকটা দূরে, দেখা যেত না হয়ত। আর পরে যখন আপনি ওকে ধরে ধরে নিয়ে গেলেন, তখন এদিক ওদিক তাকানোর অবসর কোথায় আপনার?
আবার বললাম, আপনি…
উনি বললেন, আমার নাম গোরাচাঁদ। গোরাচাঁদ বিশ্বাস। গ্রামের পরিচিত পাগল। সবাই জানে। আমি রাতে না ঘুমিয়ে পথে পথে পায়চারি করি। সারা গ্রাম চষে ফেলি রোজ।
বললাম, কী করেন?
— বললাম তো… হেঁটে বেড়াই।
আমি বললাম, না, না। দিনের বেলা।
— ঘুমোই। ভোরবেলা বাড়ি ফিরে।
— কাজ করেন না?
দাঁত বের করে হাসলেন। বললেন, গাঁয়ের পাগল হবার সুখ এই। ভাত-কাপড়ের অভাব থাকে না।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, কিন্তু পাগল আপনি নন।
উনি উদাসীনভাবে বললেন, লোকে বলে।
— আপনিও মেনে নেন। কেন?
— তা নয়ত কি গাঁ-সুদ্ধ লোকের সঙ্গে ঝগড়া করব নাকি? আমি নিজের মতো থাকি।
হঠাৎ মনে হলো, জিজ্ঞেস করলাম, তপোধন সরকারের ব্যাপারটা সত্যি কি না আপনি জানেন?
— তপোধন সরকার? ওই নকশাল যাকে এনকাউন্টারে পুলিশ মেরেছিল? জানি না। তখন আমার জন্মই হয়নি…
আমি বললাম, না, না। এনকাউন্টার হোক, যা-ই হোক, পুলিশ মারুক আর যে-ই মারুক, মৃত্যুটা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে এই যে শুনেছি ওনার প্রেতাত্মা এখানে দেখা যায়, সেটার কথা বলছি।
এবার গোরাচাঁদ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললেন, এবার বুঝলাম। আপনি ভূতের খোঁজে এসেছেন। হ্যাঁ। ওনাকে এখানে দেখা যায়। অনেকেই দেখেছে।
— আপনি?
এবারে মাথা নাড়লেন পাশাপাশি। নাঃ, আমি দেখিনি।
আমি খুব হতাশ হয়ে বললাম, সে কী! রোজ রাতে আসেন, অথচ কখনও দেখেননি?
উনি আবার মাথা নেড়ে বললেন, রোজ রাতে তো দেখা যায় না। বছরে একদিন, ওনার মৃত্যু দিনে…
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, আজই তো মৃত্যুদিন। আঠাশে ডিসেম্বর।
উনি একটু ভেবে বললেন, ও, তাই তো। তারপর বললেন দেখতে চাইলেই দেখা যায় না। উনি ইচ্ছে করলে তবেই দেখা দেন।
— কাউকে জানেন, যিনি দেখেছেন?
— সে-ও সব অনেক বছরের কথা। হয়ত আমার জন্মেরও আগে, বা আমি হয়ত খুব ছোটো।
আমি বললাম, এমন হতে পারে, যে ঘটনাটা যখন সদ্য ঘটেছে তখন ভীতু লোকেরা দেখেছে, কিন্তু পরে স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার পরে…
উনি কেমন কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভুল দেখেছে? যাঁরা দেখেছেন তাঁরা সব নমস্য ব্যক্তি, জানো?
এক ধাক্কায় আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসার ভঙ্গিটা কানে লাগল। ভদ্রলোক হাতের কাপ-টা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আর একটু কফি হবে? সামান্য। আমি কাপে একটু ঢেলে দিতে না দিতেই বললেন, ব্যাস, ব্যাস। এক চুমুক। তোমার কম পড়বে।
আমি ফ্লাস্কটা আবার বন্ধ করতে করতে বললাম, আপনি তাহলে বিশ্বাস করেন, তপোধন সরকার মৃত্যুর পর এখানেই অশরীরী হয়ে ঘুরছেন?
উনি কাপটা মাটিতে নামিয়ে রেখে জোরের সঙ্গে বললেন, আলবাত। এবং কেউ দেখুক, চাই না-দেখুক, এখনও উনি এখানে ঘোরাফেরা করছেন।
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। ফ্লাস্কটা নামিয়ে রেখে অন্ধকারেই পায়চারি করলাম। এখন রাত অনেক। অন্ধকার গাঢ়। গোরাচাঁদবাবুকে প্রায় দেখা যায় না। হঠাৎ ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে এল একটা প্রবল হাই। গোরাচাঁদবাবু শুনেছিলেন। বললেন, ঘুম পাচ্ছে? তাহলে হাঁটাহাঁটি করছ কেন? একটু বসো।
বিশ্রামাগারের দেওয়াল ধরে চওড়া তাক, অপেক্ষমান শ্মশান যাত্রীদের বসার জন্য। তার ওপরেই কম্বল পেতেছিলাম শোয়ার জন্য। কম্বলের ওপর বসলাম, আবার প্রবল এক হাই উঠল। আবছা শুনলাম গোরাচাঁদবাবুর গলা। এই সময়েই ঘুম ধরে। আমারও। আমিও এরকম সময়েই বাড়ির দিকে রওয়ানা দিই রোজ। গোরাচাঁদবাবুর গলাটা কেমন মিহি হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি চোখদুটো কুঁচকে অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম মোবাইলটা বের করে টর্চটা জ্বালাব…
হঠাৎ কাক ডাকার শব্দে চোখ খুলল। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? গোরাচাঁদবাবুর সামনেই? ছি ছি। বললাম, গোরাচাঁদবাবু? কোনও সাড়াশব্দ নেই। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, যেন আগের মতো অন্ধকার নেই, যদিও ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে না। চলে গেছেন? প্রথমেই মনে হলো, আমার মোবাইল? পকেটে হাত দিয়ে পেলাম। সময়টা ফুটে উঠেছে হাতের ছোঁয়া লেগে। তিনটে উনচল্লিশ। সাইকেল? ওই তো, বাইরেই রয়েছে, মোবাইলের টর্চের আলোয় হ্যান্ডেলটা চকচক করে উঠল। হাত বাড়িয়ে ফ্লাস্কটা নিয়ে একটু ভুরু কোঁচকালাম। খালি? এটাই দু’নম্বর ফ্লাস্কটা না? অন্যটাও হাতে নিয়ে বুঝলাম ঠিক, এটাও খালি। দুটো থেকেই কয়েক ফোঁটা করে মাত্র কফি পড়ল। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি? ঘণ্টা দুয়েক? তার মধ্যে ভদ্রলোক প্রায় একটা গোটা ফ্লাস্কের কফি সবটা খেয়ে লম্বা দিয়েছেন।
বিশ্রামকক্ষের ওপরের গাছে কাকের ডাক বাড়ছে। তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ছোটোবেলায় ঠাকুমার বলা ছড়াটা মনে পড়ল। ডাকে কাক, না ছাড়ে বাসা, খনা বলে সেই সে ঊষা। পুবের আকাশ হালকা হচ্ছে? বোধহয়।
আসেননি তপোধন। বা আসলেও, ঘুমন্ত লোককে জাগিয়ে দেখা দেননি। আস্তে আস্তে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। একটু হতাশ লাগছিল। কেন জানি না — কী যেন একটা না-পাওয়ার মতো, আশা পূর্ণ না-হওয়ার মতো। শুধুই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে? কিছু বিশেষ করব বলে তো আসিনি। কোনও প্রেতাত্মার দেখা পাইনি বলে? আমি তো ভাবিনি প্রেতাত্মার দেখা পাব, আমি তো প্রেতাত্মায় বিশ্বাসই করি না। গোরাচাঁদ আমার কফি খেয়ে পালিয়ে গেল বলে? হাসি পেল। মন খারাপের আর কারণ পেলাম না?
আস্তে আস্তে সাইকেল চালিয়ে গেলাম উলটো দিকে। ভোরের আলো বাড়ল, আমি পৌঁছলাম হাইওয়ের ধারে। এখানে মনকাড়া কিছু নেই, তাই ফিরলাম গ্রামের দিকে।
বাড়ি পৌঁছলাম চারটের পরে। চৌধুরী বাড়ির অনেকেই খুব ভোরে ওঠে। রামখেলাওন আমাকে আসতে দেখে দু চোখ বিস্তারিত করে বলল, আপনি রাত কো কোথায় গৈসলেন, বাবু? দূর থেকে দেখলাম লতা বাগানের গাছ থেকে পুজোর ফুল পাড়ছে। আমাকে দেখে ওরও চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। আমি হাত নেড়ে, গুড মর্নিং বলে গাড়ি বারান্দার নিচে সাইকেল রেখে সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে গেলাম।
তিনতলায় মাঝের মহলের চারটে ঘর অঙ্কনদের। একটা বৈঠকখানা, একটা অঙ্কনের মা-বাবার ঘর ছিল, একটা অঙ্কনের, আর একটা ওর বোনের। এখন অঙ্কন ওর মা-বাবার ঘরে, ওর পুরোনো ঘরে আমি আর সুমোহন। সেই ঘরে ঢুকতে হলে অঙ্কনের বাবা-মায়ের ঘরের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
অঙ্কন খাটে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি সাবধানে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আবার দরজাটা বন্ধ করছিলাম, খট করে একটা শব্দ হলো, আর অঙ্কনের ঘুম গেল ভেঙে। আমি সরি-টরি বলতে যাচ্ছি, অঙ্কন অবাক হয়ে বলল, তুই এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস?
আমিও অবাক, বললাম, এই তো এলাম। চারটে বেজে গেছে।
অঙ্কনের পরের প্রশ্ন আরও আশ্চর্য। — কোথায় গেছিলি?
বললাম, তোর মাথা-ফাথা গেছে, না কী? শ্মশানে গেলাম না?
— শ্মশান থেকে তো তুই রাত একটার পরেই ফিরলি…
— ফ্যাট্! রাত একটায় আমি শ্মশানে গোরাচাঁদ বিশ্বাসের সঙ্গে বসে কফি খেতে খেতে গল্প করছিলাম। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এই উঠে আসছি।
অঙ্কনের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কাঁপা হাতে ভেতরের ঘরের দিকে আঙুল তুলে বলল, তাহলে ওঘরে সুমোহনের সঙ্গে কে?
দু’জনে একই সঙ্গে ভেতরের ঘরের দরজায় পৌঁছে দরজা ঠেলছি, দরজার ওধারে শুনতে পাচ্ছি কারা কথা বলছে! অঙ্কন অবাক চোখে আমার দিকে চাইল, আমি অবাক চোখে অঙ্কনের দিকে, তারপরে দু’জনেই সজোরে দরজা ঠেলে পাশের ঘরে ঢুকলাম।
ঘরে দুটো বিছানা। একটা অঙ্কনের ছোটোবেলার খাটে — সেটা সুমোহনের, অন্যটা মাটিতে — তাতে গত ক’দিন আমি শুচ্ছিলাম।
খাটের ওপর সুমোহন বাবু হয়ে বসে আঙুল তুলে উত্তেজিত হয়ে কী বলছে, আর তার সামনে, মাটিতে, বিছানায় হাঁটু মুড়ে, দু-হাত দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে ধরে হাসি হাসি মুখে — আমি!
সে দৃশ্য দেখে আমরা থমকে দাঁড়িয়েছি, ওদিকে দরজা খুলতে দেখে সুমোহন সবে এদিক ফিরে বলতে শুরু করেছিল, দেখ, অঙ্কন, বলে দে তো, যে রাত একটা অবধি থাকার কথা ছিল না…
কিন্তু অঙ্কনের পাশে আমাকে দেখে কথা শেষ করতে পারল না, মুখ হাঁ হয়ে গেল, চোখ গোল গোল, আর একবার মাটিতে-বসা আমার দিকে, আর একবার দরজায়-দাঁড়ান আমার দিকে দেখতে লাগল।
এদিকে মাটিতে-বসা আমিও আমাকে দেখে একগাল হেসে… কী বলব? ‘উঠে দাঁড়াল’, না ‘উঠে দাঁড়ালাম’? না, ‘দাঁড়াল’। ও তো কোনোভাবেই সত্যি ‘আমি’ না…
মাটিতে-বসা আমিও আমাকে দেখে একগাল হেসে উঠে দাঁড়াল। বলল, এই যাঃ, সকাল হয়ে গেল? গল্প করতে করতে একেবারে… তারপর আমার সেই ফিচেল হাসিটা, যেটা সম্বন্ধে বন্ধুরা চিরকাল বলে এসেছে হাড় জ্বালানি, সেটা হেসে আস্তে আস্তে শূন্যে মিলিয়ে গেল। পায়ের দিক থেকে মিলিয়ে যেতে যেতে পুরো অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে ডান হাতটা মাথার ওপর তুলে ধরল। তখন শূন্যে কেবল আমার মুণ্ডু, আর তার থেকে একটু দূরে ওপরে তোলা ডান হাত আকাশে উঠে আছে। থুতনির নিচ অবধি চলে যাওয়ার পর দেহহীন মুণ্ডুটা বলল, চলি তাহলে? হাতের আঙুলগুলো পিয়ানো বাজানোর মতো নড়ল, তারপর পট করে সবটাই নেই হয়ে গেল।
খাটের ওপর সুমোহন কেমন জ্ঞাঁ-জ্ঞাঁ শব্দ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
সুমোহনের জ্ঞান ফিরিয়ে আমরা পুরো বিষয়টা যাকে বলে রি-কনস্ট্রাক্ট করলাম। রাত একটা নাগাদ, তখনও সুমোহন আর অঙ্কন ঘুমোয়নি, দরজা খোলার শব্দে মুখ তুলে দেখে আমি ঢুকছি। জিজ্ঞেস করাতে আমি নাকি বলেছিলাম, এই ভয়াবহ শীতের রাতে একটা অবধি থাকাই যথেষ্ট, বিশেষত ভূত-ফুত বলে যখন কিছু নেই, কোনও দিন ছিলও না। সুমোহন তখনই তর্ক করতে গেছিল, কিন্তু আমি-রূপী সে-যেই-হোক, সে নাকি বিছানায় শুয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন ওরাও ঘুমোতে যায়, কিন্তু ভোরবেলা ঘুম ভেঙে সুমোহন আমাকে স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থাকতে দেখে বলে রাত একটা অবধি শ্মশানে থাকা বাজি যেতা নয়। মিনিট কয়েক তুমুল বাকবিতন্ডার পরে দরজা খুলে অঙ্কনের সঙ্গে আমার পুনরাবির্ভাব হয়।
এইসব ঘটনা যে বাড়ির লোকের সঙ্গে আলোচনা করা যাবে না, সে তো বলা-ই বাহুল্য।
কিন্তু গোরাচাঁদবাবুর কথাটা জিজ্ঞেস করব, বলেছিলাম আমি।
অঙ্কনের খুড়তুতো ভাইদের সকলের একই মত। গোরাচাঁদ খ্যাপাটে, প্রচুর জ্ঞানী, কিন্তু ডিগ্রিধারী নন, সত্যিই সারা রাত গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়ানো ওঁর অভ্যেস, তবে পাগল বা মনোরোগী উনি মোটেই নন।
খুব ইচ্ছে হচ্ছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, কাল রাতে আপনি কি শ্মশানে আমার কফি খেয়ে নিয়েছিলেন?
যদি বলেন কই, না তো! তা হলে কি সেই রাতে তপোধন সরকারের সঙ্গে আমিও গল্প করেছি ধরে নিতে পারি? মানুষ একসঙ্গে দু’জায়গায় থাকতে পারে না, ভূত কি পারে?