অকর্মণ্য দুপুরবেলা ভাতঘুমের পরিবর্তে শরদিন্দুর ব্যোমকেশ কাহিনীর পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। ‘বেণীসংহার’। বহুপঠিত, তবু ফের পড়তে আরম্ভ করলাম। তরতরে কাহিনী, ঝরঝরে ভাষা। দেখতে দেখতে শেষের দিকে পৌঁছে গেলাম। আসামী চালানের পরে ব্যোমকেশ অপরাধী মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে বসেছে — ‘শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য বলেছেন, নারী নরকের দ্বার। সনৎ নরকের অনেকগুলো দ্বার খুলেছিল, তাই শেষ পর্যন্ত তার নরক প্রবেশ অনিবার্য হয়ে পড়ল।’
পরের প্যারাগ্রাফে আরো মণিমুক্তো রয়েছে, যেখানে ব্যোমকেশের বক্তব্য এই যে, যুগে যুগে কিছু নারী জন্মগ্রহণই করেছে পুরুষের সর্বনাশ করার জন্য। এক্কেবারে সাগর পেরিয়ে গিয়ে আলেকজান্দার দুমা-র টীকাসুদ্ধ আমদানি করেছে সে, নিজ বক্তব্যের সপক্ষে। ধরেই নিলাম, লেখক নন, ব্যোমকেশই Cherchez la femme সম্পর্কে তার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছে, লেখক এখানে সূত্রধার মাত্র।
ভাবতে বসলাম। ভাবতে ভাবতে প্রচুর অস্বস্তিকর উদাহরণ স্মৃতির অতল থেকে সাঁতরে বুড়বুড়ি কাটতে কাটতে চিন্তাসমুদ্রের কিনারায় উঠে আসতে লাগল।
‘আদিম রিপু’ গল্পে মিস ননীবালার রূপবর্ণনা — ‘তিনি হাস্য করিলেন, মনে হইল হারমোনিয়ামের ঢাকনা খুলিয়া গেল—‘ শুধু কি এইটুকু? ননীবালার চেহারা কোনো গৃহের গৃহিণী হওয়ার অনুকূল নয় ঠাউরে তাঁর পেশা সম্পর্কে মনে মনে জল্পনা চলেছে — ‘শিক্ষয়িত্রী? সম্ভবত নয়। জেনানা ফাটকের জমাদারনী? উঁহু, অতটা নয়। তবে কি লেডি ডাক্তার? হইতেও পারে।’ এক্ষেত্রেও লেখকের দোষ নেই ধরে নিচ্ছি, কারণ জল্পক অজিত।
শরদিন্দু বন্দ্যোর আরো অতীব সুখপাঠ্য ছোটগল্পগুলির উদাহরণ আর টানলাম না।
তারপর ধরুন
সুবোধ ঘোষ। অসাধারণ কথাসাহিত্যিক। ভিন্ন স্বাদের গল্পগুলো গিলতাম গোগ্রাসে। সময় পেলে এখনো গিলব হয়ত। কিন্তু যতখানি অভিনবত্ব গল্পের নামকরণে লক্ষ্য করা যায়, ততখানি ঠিক গল্পগুলির প্রতিপাদ্য বিষয়ে দেখা যায় না। ‘থির বিজুরি’, ‘দুঃসহধর্মিণী’, ‘সুনিশ্চিতা’ গল্পগুলিতে নারীর সেই চিরন্তন মায়াবতী, ছায়াদায়িনী মূর্তি, আশ্রয়দাতা পুরুষের বুকেই যার ‘অন্যরকম’ হওয়ার সব অ্যাডভেঞ্চারের পরিসমাপ্তি। অবশ্যই তাঁর অন্যান্য অসামান্য গল্প রয়েছে — গোত্রান্তর, সুন্দরম প্রভৃতি। কিন্তু তাতেও অস্বস্তিটা যায় না। মনের মধ্যে খচখচ করে বিঁধতে থাকে।
নরেন্দ্রনাথ মিত্র। তাঁর অপূর্ব ছোটগল্পগুলির প্রেমে পড়েছি কোন কৈশোরে। নরনারীর সম্পর্কের বিভিন্ন স্তর, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এই গল্পগুলির মুখ্য উপজীব্য। অবশ্যই অন্য স্বাদের গল্পও রয়েছে, অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। তবু ঐ এক কাঁটা মনে গেঁথে থাকে —- মেয়েদের কেমন একচালা একমেটে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন সেইসব প্রাতঃস্মরণীয় অগ্রজেরা — অন্তত তাঁদের সৃষ্ট চরিত্রেরা সেই সময়ের নিরিখে bias free আচরণ করতে পারেনি তেমন। ইচ্ছাকৃত? জানার কোনো উপায় নেই।
তাঁদের অনুজ সাহিত্যিকেরা ভাষা, ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে আধুনিকতর হলেন, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিটি কিছুটা অনাধুনিকই রয়ে গেল। এক সদ্যপ্রয়াত বিশিষ্ট সাহিত্যিকের নানা স্বাদের উপন্যাসে দেখি প্রোটাগনিস্ট নারী চরিত্রগুলি সকলেই ভয়ঙ্কর রূপসী। প্রশ্ন জাগে, কুরূপা বা সাধারণদর্শনার কি নায়িকা হওয়ার যোগ্যতা নেই? হতে পারে আমি বুঝতে ভুল করেছি, কিন্তু আমার সীমিত পাঠেও, পাঠকজীবনের উপান্তে পৌঁছে প্রশ্নগুলো খোঁচায় বড্ড।
ঠিক যেমন খোঁচায় বিশ্ববরেণ্য সত্যজিৎবাবুর নারীচরিত্র বর্জিত (প্রায়) ফেলুদা কাহিনীগুলো। এখনো মন খারাপ হলে সোনার কেল্লা বা রয়েল বেঙ্গল রহস্য নিয়ে বসি, কিন্তু প্রশ্নগুলো পিছু ছাড়ে না। ফেলুদা বা তোপসের প্রেমিকা আমদানি না-ই বা করলেন সত্যজিৎ, কাহিনীতে নারীদের এমনভাবে ব্রাত্য করার কারণ কি হতে পারে? মেয়েরা ‘ক্যারেকটার’ হয়ে উঠতে পারে না কিশোরপাঠ্য উপন্যাসে? উত্তর জানা নেই।
আমি কিন্তু সমালোচনা করতে বসিনি, সে বৈদগ্ধ্য/বিদ্যা/মনন কোনোটাই আমার নেই। আমি কেবল fact গুলোকে state করছি। এ লেখাকে Soliloquy ও ভাবা যায়। (তাহলে only friends করা নেই কেন বলে ট্রোল কর্বেন্না প্লিজ)
মুশকিল হচ্ছে এইসব সাহিত্য হৃদমাঝারে প্রায় পুঁতে ফেলে, আমাদের মায়েদের প্রজন্ম, আমাদের প্রজন্ম সক্কলে বড় থেকে বুড়ো হয়ে গেলাম। এইসব লেখাদের ভালবাসিনি বললে সত্যের অপলাপ হবে। তবে? দুধ-জলের মিশেল থেকে হাঁসের মতো দুধটি ছেঁকে নেওয়ার মানসিকতা থাকলে, লেখকের বিচার-টিচার বাদ দিয়ে গপ্পের নির্যাসটুকু শুষে নিয়ে ছিবড়েটা ফেলে দেওয়াই যায়, তবে ততটা পরিপক্কতা সব যুগের সকল শ্রেণীর পাঠিকার মধ্যে ছিল/আছে কি? না থাকলে আমার এক পরিচিত ডাক্তারগৃহিণী তথা সংস্কৃতের অধ্যাপিকার মতোই বলতে হবে —“যাই বলো বাপু, আমাকে যদি কোনো নারীবাদী মিছিলে যেতে বলে কলেজের মেয়েরা, আমি কিন্তু যাব। স্লোগান দিয়ে হাত মুঠো করে আকাশেও ছুঁড়ব, কিন্তু সে হাতে পলা আর শাঁখা থাকবেই থাকবে। ওসব আমি খুলতে পারব না।”
অনেকের বিরাগভাজন হবো জানি, তবু জিজ্ঞাসা করছি, মিসোজিনি কি কেবল intense hatred and prejudice against female sex mainly shown by males? না, তা তো নয়। যখনই গড়পরতা সামাজিক সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে জীবনযাপন করতে চায় কোনো মেয়ে, তার প্রতি soft/hard, virtual/real সবরকম আক্রমণের পুরোধা কি কেবল পুরুষরা হয়? Patriarchal society-র দোহাই দিয়ে আর কতকাল শিক্ষিতা মেয়েদের নিজেদের বিয়েতে একগাদা গয়না আর দানসামগ্রী নেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারিণী ছেলের মায়ের ফরসা বৌমা আনার তদ্বির করা, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ‘আলোকপ্রাপ্ত’ স্ট্যাটাস দেওয়া মহিলার অন্য মহিলাদের খোলামেলা পোশাকের প্রতি অনুদার কটাক্ষ, তথাকথিত ‘সংস্কৃতিবান’ পরিবারেও পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষায় নির্লজ্জ হ্যাংলামো, ছেলে আর মেয়ের মধ্যে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর discrimination, সে পড়াশোনা বা পেশার চয়েস নিয়েই হোক কিংবা গৃহকর্মের বিভাজন — লিস্ট লম্বা করাই যায় ইচ্ছামতো — মেয়েরা নিজেরা এই সোনার নিশ্চিন্ত গারদ ভেঙে বেরোবার চেষ্টা করছে কি আপ্রাণ? আমি এখানে সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর কথা তুলছিই না, তাদের বাধ্যবাধকতা অনেক, নিত্যযাপনের প্রেক্ষিত অনেক অসুরক্ষিত আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের চেয়ে। তাদের চেয়ে ঢের বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা নিজ শ্রেণীর মহিলাদের কথাই বলছি — কতটা তেড়েফুঁড়ে এগিয়েছি সকলে এই আপাত নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার শিকল ভাঙতে? মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম বাদে কেউই তেমন এগোইনি। বরং অন্যভাবে বাঁচতে চাওয়া মেয়েটির উপর যূথবদ্ধ হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছি — কখনো পুরুষতান্ত্রিকতার অজুহাত দেখিয়ে তো কখনো নিজেরা পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার অভিলাষে। তাই নারীবাদী সেমিনারে চৌদিক চমকানো বুলি আওড়াতে পারি, কিন্তু বাড়ি ফিরে ব্যথায় কাতর গৃহসহায়িকাটিকে ঋতুকালীন ছুটি দিতে মন নারাজ হয়ে ওঠে।
দেশ,কাল,জাতি নির্বিশেষে এই মিসোজিনির শিকড় বহু বহু গভীরে প্রোথিত, অনুপম রায়ের গান বেয়ে গেলেও সেখানে পৌঁছানো যাবে না। পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মের চেয়েও প্রাচীন এই prejudice…. কালে কালে নানা সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, বিজ্ঞাপনে, দৈনন্দিন জীবনচর্যায় তা প্রতিফলিত। আজকাল বড় হতাশ লাগে। জানি, মানুষের এই ব্যাধি সারবে না। পরিবেশদূষণের চেয়েও এ মারাত্মক, যুদ্ধ বা মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর — মানবজাতির নিঃশব্দ ঘাতক।
পরিশিষ্টঃ
গতকাল হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে একজন মধ্যবয়স্ক ডকশ্রমিক দেখাতে এসেছিল। আমার ‘কি হয়েছে’-র প্রত্যুত্তরে অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে জবাব দিল — ‘আর বলবেন না মাসি, গত পরশু থেকে জ্বর—‘
আমি সভ্য সম্বোধন নিয়ে তাকে কিঞ্চিৎ জ্ঞানদান করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই কাউন্টারে বসা রিসেপশনিস্ট ভদ্রলোক তেড়ে এলেন — ‘হাসপাতালে এসেচ? ডাক্তারকে কি ভাবে ডাকতে হয় জানো না?’
শ্রমিকটি হাতজোড় করে ভদ্রলোককে বলল —‘সরি সার, ভুল হয়ে গেছে।’ তারপর আমার দিকে ফিরে বলল — ‘কাকিমা, পরশু থেকে আমার খুব জ্বর আর মাথাব্যথা, কিচ্ছু খেতে পারছি না, মুখ তেতো হয়ে থাকছে—-‘