কাল ব্যথা ও অবসাদ নিয়ে লিখেছিলেন ডা স্বস্তিশোভন চৌধুরী। আজ ডা অরিত্র চক্রবর্তীর কলমে অবসাদ আরও বিশদে।
ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার হল মানসিক রোগ গুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি রোগ।আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনে কোনো এক সময় মন খারাপ হয়।কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সময়ের সাথে অল্প কয়েকদিনেই সেই মান খারাপ চলে যায়।কিন্তু যখন এই মনখারাপ অনেক দিন ধরে চলতে থাকে,আমাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হয়,অন্যান্য আরো সমস্যা এসে জড়ো হয়, তখন মনখারাপ পরিণত হয় ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে।
সমস্যার গভীরতা-
আমরা হাসপাতালে যে সমস্ত ডিপ্রেশনের রোগী দেখি তারা আসলে হিমশৈলের চূড়ার মতো ।আসলে পৃথিবীতে প্রায় 15 শতাংশ মানুষের মধ্যে জীবনের কোনো এক সময়ে ডিপ্রেশনের সমস্যা তৈরি হয়।এই রোগ মহিলাদের মধ্যে তুলনায় বেশি হয়(পুরুষদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ)।আবার বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই রোগের প্রবণতাও বাড়ে।বর্তমানে কম বয়স্কদের মধ্যেও এই রোগের প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে।যে সমস্ত মানুষ একা থাকেন তাদের মধ্যে এই রোগের সম্ভাবনা খুব বেশি। বর্তমানে গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে যে ডিপ্রেশনের রোগীদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।তাই ডিপ্রেশনের রোগীরা সহজেই অন্যান্য শারীরিক রোগে আক্রান্ত হন।ডিপ্রেশনের রোগীদের মধ্যে হার্টের সমস্যা,একসিডেন্ট হবার সম্ভাবনা,আত্মহত্যার প্রবণতা,বিভিন্ন নেশার প্রবণতা,সংসারে অশান্তি ইত্যাদির সম্ভাবনা খুব বেশি।
ডিপ্রেশনের লক্ষণ-
ডিপ্রেশন মনে কিন্তু শুধু মন খারাপ নয়।এক্ষেত্রে মন খারাপের সাথে সাথে আরো কিছু সমস্যা দেখা দেয় যেমন -শরীরে শক্তি কমে যাওয়া,আগে যে সমস্ত কাজ করতে ভালো লাগতো সেগুলোতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মনোযোগের অভাব,ভুলে যাওয়া,অল্পতেই রেগে যাওয়া,নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, নিজেকে দোষী মনে হওয়া, আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা করা,ঘুম কমে বা বেড়ে যাওয়া,খিদে কমে বা বেড়ে যাওয়া ,ওজন কমে যাওয়া ইত্যাদি।এর সাথে সাথে অনেক সময় শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা, মাথা ব্যথা, হজমের সমস্যা,কোষ্ঠ কাঠিন্য বা পেটের গন্ডগোল দেখা যেতে পারে।রোগের গভীরতা খুব বেড়ে গেলে উপরোক্ত সমস্যা গুলির সাথে সাথে সন্দেহ প্রবণতাও দেখা দিতে পারে।
ডিপ্রেশনের কারণ-
এই রোগের কারণ নানাবিধ হতে পারে-
সবথেকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বলতে গেলে মস্তিষ্কের মধ্যে কিছু কেমিক্যালের(যাদেরকে নিউরোট্রান্সমিটার বলে) পরিমান কমে বা বেড়ে গেলে এই জাতীয় রোগ হয়।সেরোটোনিন,ডোপামিন ,নর এপিনেফরিন এদের মধ্যে অন্যতম।এছাড়া জিনগত কারণ অবশ্যই একটি বিশেষ ভূমিকা নেয়।
বিভিন্ন ধরনের শোক বা আঘাত থেকে এই রোগ হতে পারে।বর্তমানে গবেষণা বলে যে শোক বা আঘাতপ্রাপ্ত সমস্ত মানুষ কিন্তু এই রোগের শিকার হন না।যাদের মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটার এর গন্ডগোল হয় তারাই মূলত এই রোগের শিকার হন।
যে সমস্ত সামাজিক কারণ এই মান খারাপের সম্ভাবনা বাড়ায় সেগুলি হলো-একাকিত্ব,ফ্যামিলি সাপোর্টের অভাব,ছোটবেলায় ঘটে থাকা কিছু খারাপ অভিজ্ঞাতা,কাজ থেকে ছাঁটাই ইত্যাদি।বিভিন্ন শারীরিক রোগ যেমন ক্যান্সার,হেপাটাইটিস,থাইরয়েড এর সমস্যা,এইডস, কিছু আটো ইমিউন ডিসঅর্ডার , হার্টের সমস্যা,পার্কিনসনিসম ইত্যাদি ডিপ্রেশনের সাথে জড়িত।
অনেক সময় কিছু ওষুধের সাইড এফেক্ট হিসাবেও এই সমস্যা হতে পারে যেমন বিটা ব্লকার, স্টেরয়েড,খিঁচুনির ওষুধ,গর্ভরোধক পিল ইত্যাদি।খুব বেশি মদ্যপান বা অন্যান্য নেশা থেকেও ডিপ্রেশন দেখা যেতে পারে।
এছাড়া বাচ্চা হওয়ার পারে মা দের মধ্যে ডিপ্রেশন দেখা দেবার সম্ভাবনা খুব বেশি।
ডিপ্রেশনের চিকিৎসা-
বাড়িতে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে(যেমন মৃত্যু,একসিডেন্ট ইত্যাদি) মন খারাপ লাগা স্বাভাবিক।কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের মধ্যে সেটি নিজে থেকেই কেটে যায়।এক্ষেত্রে বাড়ির লোকজন,আত্মীয়স্বজনের ঠিকমতো সহযোগিতা পেলেই হয়তো মান খারাপ ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু যখন মান খারাপ এতটাই বেশি হয় যে আপনি কোন কাজ করতে পারছেন না,সংসারের কাজকর্মে ঠিকমতো অংশগ্রহণ করতে পারছেন না,আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসছে বা চেষ্টা করে বসেছেন -তখন সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিন।
সমস্যা যখন অল্প থাকে তখন কাউন্সেলিং থেকে লাভ হয়,কিন্তু সমস্যা যখন বেশি তখন ওষুধের প্রয়োজন হয়।
তাই মান খারাপ লাগলে সেটা নিয়ে কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথে আলোচনা করুন,খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো ভাবে করুন,ঘরে বসে না থেকে প্রতিদিন অন্তত আধ ঘন্টা করে বিভিন্ন ফিজিকাল এক্টিভিটি তে অংশগ্রহন করুন(যেমন ব্যায়াম, মর্নিং ওয়াক ইত্যাদি),ঠিক মতো ঘুমোন ও নেশা থেকে বিরত থাকুন।বড় কাজ করতে অসুবিধা হলে সেটিকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে এক একটি অংশে মনোযোগ দিন।ডিপ্রেশনে থাকা কালীন জীবনের কোন রকম বড় সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভাল।সমস্যা বেশি মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
বর্তমানে ডিপ্রেশনের চিকিৎসায় এস এস আর আই(SSRI) গোত্রের ওষুধ খুব ব্যবহৃত হয়,যেগুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া খুবই কম।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে মানসিক রোগের ওষুধ মানেই ঘুমের ওষুধ নয়।বর্তমানে যে সব ওষুধ ব্যবহৃত হয় সেগুলো খেলে সারাদিন ঘুম পাবার সম্ভাবনা নেই এবং কর্মক্ষেত্রে কাজ করার সময় কোন অসুবিধা হবার সম্ভাবনা নেই।অন্যান্য শারীরিক রোগের ওষুধের সাথে সাথে মানসিক রোগের ওষুধ খাওয়ার তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই।
One Response
আপনার লেখা গুলো খুব প্রয়োজনীয়। কিছু মনে করবেন না, যদি আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই, কিভাবে করব?