গঙ্গার জলে দাঁড়িয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ভাসিয়ে দিই মাকে। চরাচর জুড়ে নিকষ কালো অন্ধকার। পেছনে নাকি আর তাকাতে নেই। আর হাহাকার করতে করতে সমস্ত ফেলে আসা পেছনটা সপাটে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। কান্নার আগল ঠেলে সেই পেছনে তাকাই আমি।
“না, আমি যাবো না।” মায়ের জবাব। কথা হচ্ছিল নতুন স্বামীস্ত্রীর সাথে তাদের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার ব্যাপারে। নতুন জায়গায় মেয়েটাকে গুছিয়ে দিয়ে আসার প্রয়োজন। খোদ মেয়ের মায়ের আব্দার। ছেলের মায়ের আবার সম্পূর্ণ অন্যরকম মতামত। “ওরা নিজেরাই গুছিয়ে নেবে। এই গুছিয়ে নেবার একটা আলাদা আনন্দ আছে। আর এইভাবে বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গেলে খুব বিপদে ওদের দুজনকে কেউ আলাদা করতে পারবেনা ভবিষ্যতে।” জানি না, সব ছেলের মায়েরা একই ভাবে একথা বিশ্বাস করেন কিনা।
মা তার পরের বার জলঢাকা গিয়েছিল। সেবারে নববিবাহিত ডাক্তারটি তার স্ত্রীকে নিয়ে একাই কর্মক্ষেত্রে ফিরে গিয়েছিল।
প্রজেক্টে হৈহৈ রব- ডাক্তার বউ এনেছে। তা, অল্পবয়সী ডাক্তারের অল্পবয়সী বন্ধুবান্ধবতো থাকবেই। বেশ কিছু একই হায়ারসেকেন্ডারি ব্যাচের ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু ছিল আমার। সলিলের সাথেতো ভয়ংকর দোস্তি। সলিল সন্ধ্যাবেলায় এলো আলাপ করতে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নতুন বউ, তার হাতে চা না খেলে কি চলে? সুতরাং ‘হয়ে যাক এক রাউন্ড চা’। দুইবন্ধুর জোরালো আড্ডা চলছে, চা আর আসে না। কাজের মহিলা বিকেল বিকেল কাজ করে চলে গিয়েছে। ফলে নতুন বউ চায়ের দায়িত্বে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে রান্নাঘরে উঁকি দিই। এক ডেকচি জল টগবগ করে ফুটছে আর তার সামনে দাঁড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছে আমার স্ত্রী। দুই হতভম্ব স্বামী-স্ত্রীকে সলিল উদ্ধার করেছিল সে যাত্রায়। আমিও যে কিছু রাঁধতে পারতাম না।
পরদিন থেকে রান্নার দিদির আন্ডারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই ইন্টার্নশিপ শুরু। একসপ্তাহের মধ্যে ভাত-ডাল মাংসের ঝোল রাঁধতে শিখে গেল স্ত্রী। আমি স্টুডেন্ট হিসেবে খুব খারাপ বোঝা গেল। একদিন ভাত আর একদিন হাত পুড়োলাম। ও বললো “তোমায় আর রান্না শিখতে হবেনা, আমি বর নির্যাতনের দায়ে জেলে যেতে রাজি নই।” ফলে আমার ভালো ‘শেফ’ হওয়ার যে প্রতিভাটা ছিল সেটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হলো। পরে আমার মা শুনে অবশ্য বলেছিল যে, তার মতে আমি নাকি এ্যাভারেজের থেকে একটু বেশি বুদ্ধি ধরি।
সে যা হোক, রান্নার দিদি বিকেলে আসা ছেড়ে দিল। প্রত্যেকদিন ডিনারে আমাদের মাংসের ঝোল আর ভাত। ম্যাডাম রান্না শিখে গেছেন জেনে ড্রাইভার তামাং দাজু একদিন অনেকটা মাংস দিয়ে গেল। ও খুব খুশি। ব্যাপারটা জানানো উচিত হবে কি হবে না ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললাম – “ওটা কিন্তু শুয়োরের মাংস।” শোনার পর ওই ঠান্ডায় বেচারি বারংবার স্নান করে ঠান্ডা ফান্ডা লাগিয়ে একসা। আমার মিসেস বেশ সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করে “তুমি কি ওসব খাও নাকি?” আমি আঁতকে উঠে জানাই “তোবা, তোবা – শোনাও পাপ!” আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে, প্রেমে এবং নববিবাহিতা স্ত্রীর সামনে মিথ্যে বলায় কোনো দোষ নেই। আমাদের একটা পোষা কুকুর ছিল। তাকে মাংসটা দিয়ে দেওয়া হলো শেষ পর্যন্ত।
বেশ চলছিল। আর পাঁচটা অল্পবয়সী স্বামী-স্ত্রীর মতোই আমাদেরও একমাস পূর্তি, দুমাস পূর্তি ইত্যাদির সেলিব্রেশন চলতো। সত্যিকথা বলতে কি – প্রতি রাতে মাংসের ঝোল আর ভাতে অরুচি ধরে যাচ্ছিল। রাস্তাঘাটে মুরগীগুলো আমাদের দেখলে ভয়ে ভয়ে আড়চোখে তাকাতো। এরকম একটা পূর্তির দিনে বললাম “আজ না হয় রুটি হোক, সাথে আলুর দম।” আলুর দমটা খাসা হয়েছিল। ডাইনিং টেবিলের মাঝখানে বড়ো একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে সব আলো নিভিয়ে দিয়ে রোমান্টিক ডিনার। রুটিগুলো ওপর থেকে দেখতে খুব একটা সন্দেহজনক ছিল না। প্রথমে এক হাতের দু আঙুলে রুটিটা ছেঁড়ার চেষ্টা করলাম – ছিঁড়লো না। দুহাত লাগালাম, উঁহু। কামড়েও তাকে বাগে আনা গেলনা। পোষা ভুলুকে দেওয়া হ’ল। সে বেচারি তারপর থেকে তিনদিন আর আমাদের বাংলো মুখো হয়নি।
সেই অপটু রাঁধুনিকে নিয়ে গল্পের শেষটুকু বলি। এর বছর তিন-চার বাদে সার্জারিতে মাস্টার্স করতে ঢুকেছি। বিদ্যুৎ পর্ষদ আমাকে ‘উইদাউট পে লীভ’ দিয়েছে। স্টাইপেন্ডের টাকা টুকু ভরসা। সেবছরই আমার সন্তান হয়েছে। থাকতাম কসবার এক ভাড়াবাড়ীতে। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। তার মধ্যে আমাদের ইউনিটে ইন্টার্নদের টেনিওর শেষ হওয়ার পর তাদেরকে নিয়ে ভালো হোটেলে একদিন খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল। মাসের অর্দ্ধেক মাইনে যেতো গচ্ছা। একদিন আমার স্ত্রী পরামর্শ দিলো হোটেলে না নিয়ে গিয়ে বাড়িতে ডাকা হোক। তাতে খরচ অনেক কমবে। “এত জনের রান্না করতে তুমি পারবে? তারওপর প্রায় হোটেলের মতো উপাদেয় করে রাঁধতে হবে।” প্রথমবার সত্যি ভয়ে ছিলাম। পরেরবার থেকে নিশ্চিন্ত থাকতাম। বরং সবার সাথে অনেক বেশি আনন্দ হতো। আমার বন্ধুরা ওই একবেলাতে পারিবারিক বন্ধু হয়ে যেতো।
ও একটা কথা খুবই বলে, অসময়ে ও অসুবিধাতে পরস্পরের পাশে দাঁড়ালে বিপদ কেটে যায়। সেটা আমার মা ওকে শিখিয়ে গেছে। আজ দুমাস হ’ল মা চলে গেছেন- ওপরওয়ালার সাথে প্রায় দেড়মাসের অসম লড়াইয়ের পর।
জানি না, মায়ের মৃত্যুর গল্প লেখার মতো মানসিক জোর পাবো কিনা। শুধু মায়ের কথাগুলো গল্প হয়ে চারপাশে ঘোরে। সেই গল্পগুলো আঁকড়ে ল্যাপটপের চৌহদ্দির মধ্যে ঢোকানোর চেষ্টা করি।
প্রতিটি সন্তানের কাছেই ‘মা’ শব্দটা এতো বড়ো যে ল্যাপটপের গন্ডির বাইরে অধিকাংশ স্মৃতি ছড়িয়ে পড়ে – মা কোনো চৌখুপির মধ্যে আঁটে না। কোনোভাবেই।
Jibonto kahini…
Golpei jibon ar jibon e golpo
Sottie osadharon
ধন্যবাদ❤?
শেষ লড়াই তো তোকে নিয়ে লড়েছি ভাই। ঠিক একমাস নদিন, সারা জীবন ক্ষতটা বইতে হবে। ভালবাসা নিস।
খুব সুখপাঠ্য। চেনা মানুষের অজানা কথা।সবকটা এপিসোড পড়ছি। দারুণ লাগছে।
অনেক ধন্যবাদ ❤❤❤
অনেক ধন্যবাদ ❤❤❤
আমি আপনাকে চিনি না । আমার স্মৃতিহীনা মায়ের জীবন ” নারী স্বাধীনতা বিষয়ক” লেখায় বলেছি ।
নারী স্বাধীনতা ও এক বৃদ্ধা…
দীপঙ্করের লেখা :-
ধূসর রাস্তা ভোরের বৃষ্টিতে গাঢ় নীল হয়ে ঝকঝক করছে । দূরে একটা দিনমজুর নেতাজীর মূর্তি পরিস্কার করছে । ছেলেরা নেতাজীর জন্যে মালা গাঁথছে । বিরাট বিরাট বাক্সে গান বাজছে “বর এলো মাদল বাজায়ে ” । বাজার সরগরম । মাছকুটুনীরা ডাকছে “ ও বাবুরা ইদিকে এসো তোমারটা কেটে দিই – ছোট হলে পনেরো – বড় হলে দশ ট্যাকা ” অর্থাৎ নেতাজীর ছুটি চমৎকার জমেছে । রবির চায়ের দোকানে বহুতলের নাগাল এড়িয়ে এক টুকরো রোদ এসে পড়েছে । দোকানে ছুটির সকালে আড্ডা চলছে । রবিবাবু সুকৌশলে দোকানের পেরেকে ঠেকিয়ে দুধের প্যাকেট ফুটো করে চা প্রস্তুতির জোগাড় করছেন । আড্ডাবাজদের পরিচয় দিয়ে রাখা যাক । এরা সবাই ছাত্রছাত্রীরা । দেশিকোত্তম বা দিশী , পঞ্চম বা পচুই , ধণ্বন্তরী বা ধেনো , চলিষ্ণু বা চুল্লু , মেয়েরা যথাক্রমে টমেটো শর্মা সে সদ্য পশ্চিম বঙ্গে পড়তে এসেছে তবে টটামট বাংলা বলতে পারে , চঞ্চরী বা ভোম্রা , আহ্বানীয় বা হাবু , ঋতম্ভরা বা ঋমি । টমেটো হিন্দিভাষী হলে হবে কি বর্তমানে বাংলা নিয়ে পড়ছে । ও দিশী কে বল্লো
“ দিশী তু পুরো ঝুঠে হ্যায় – পুরা চন্দ্ররেণু আছিস – পত্রিকায় বরেণবাবুর লেখাটা পুরা ঝেড়ে দিয়েছিস –” আহ্বানীয়া বা হাবু কাঁকুই দিয়ে নিজের দীর্ঘ চিকুর বাঁধছিলো । তাই দেখে চুল্লু বললো “ এবার আমুও লম্বা লম্বা চুল রাখবো ”
হাবু মুখে চিরুনী পুরে চমৎকার কায়দায় উত্তর দিলো “ রাখ না ! কে বারণ করছে ?রাখে তো অনেকেই……” ।
“ তোরা এতো সময় পাস কোথায় রে ? তেল শ্যাম্পু আঁচড়ানো …” ধেনোর সবিষ্ময় জিজ্ঞাসা ।
এরমধ্যে একজন পক্ককেশ তীক্ষ্ণনাসা চোখে উচ্চ ক্ষমতার উপনেত্র বৃদ্ধা এসে বসেছেন । উপনেত্রের ভেতরে দুটো বড়ো বড়ো চোখ । অতি ফর্সা – ক্ষীণতনু – স্বল্প কেশ – অত্যন্ত ভুলো – অন্যমনস্ক ভীত ধরনের এক ভদ্রমহিলা ।
বাচ্চারা অবাক চোখে তাকালো । ভদ্রমহিলা ভারী অপ্রস্তুত ভাবে ভেবেচিন্তে বললেন
“ আমি শিউলি” আসলে কিন্তু উনি গায়ত্রী … পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার আগে আগে হঠাৎ ওনার মনে হচ্ছে – উনি শরতের শিউলি । উনি আজকাল মাঝেমাঝে সবই ভুলে যান । টমেটো তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো
“ যারা খেজুর রস পাড়ে তাদের শিউলি বলে – আমি জানি ”
ভোম্রা লবনাক্ত আম্রবেতস চুষছিলো সে শিউলির নতুন মানেটা শুনে বিষম খেয়ে বিষম কাশতে থাকে ।
ঋমি বলে “ আমি যেভাবে ইচ্ছে সাজবো – সেটা আমার স্বাধীনতা – সেটা নারীমুক্তির প্রথম ধাপ – বুঝলি ? এভাবে সাজবে না .. এটা পরবে না … এটা করবে না .. এসব বিধিনিষেধের দিন শেষ … আমরা এখন স্বাধীনতার দিকে পা বাড়াচ্ছি….. তোদের ওসব বিধিনিষেধ শিকেয় তুলে রাখ .. যতো সব এমসিপি ….”
এমন সময় আরেক জন উলোথুলো পাজামা পাঞ্জাবি পরা টিকালো নাক – পাকা চুলো গায়ে চাদর – বয়স্ক মানুষ হন্তদন্ত এসে হাজির । আমরা এনাকে চিনি সকলের হীরকমামা । প্রায়ই বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটান । বৃদ্ধাকে দেখে বললেন “ কী মুশকিল দিদি – তুমি কাউকে না বলে কয়ে এসে এই চায়ের দোকানে বসে আছো ? এদিকে সবাই .. বোঝো কান্ড ! …… ও রবিবাবু আমার দিদিটাকে একটা চা দিন …আমাকেও ” শিউলি দেবী ভয়ানক অস্বস্তিতে পড়ে নাক খুঁটতে থাকেন । “ আসলে আমার দিদি মাঝেমাঝে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে আর বাচ্চা ছেলে মেয়েদের দেখলে তাদের কাছে যেতে চায় । হয়তো সবাইকে নাতি নাৎনি মনে করে …”
পচুই এতোক্ষনে মুখ খোলে
“ হুঁঃ তোদের নারীমুক্তি মানে তো ঐ ব্রা পোড়ানো ….. ব্রা না পরে রাস্তায় ঘোরা সিগারেট ফোঁকা আর …. ঐসব …” শিউলিদেবী কিছু একটা বলবেন ভাবছেন … মুখচোরা স্বভাবের জন্য ইতস্ততঃ করছিলেন । ভোম্রা বললো
“ ঠাম্মা তুমি কিছু বলবে ? বলো না ?” বৃদ্ধা বলতে চেষ্টা করেন – থেমে থেমে – তারপর ভাষা হারিয়ে বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনা হয়ে যান । টমেটো ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলে “ না মানে আমাদের জামাকাপড় তো আমরা নিজেদের সুবিধেমতো…. ….. যদি ওগুলো মানে বুবসগুলো খুব বড়ো হলে দৌড়ঝাঁপ করা … অসুবিধে … হবে … ”
মেয়েরা একটু থতমত খেয়ে যায় – ওরা এই যুক্তিটা ঠিক এভাবে ভাবে নি । শিউলিদেবী অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের গলায় হাত ঘসতে থাকেন । চশমার ফাঁকে ওনার চোখদুটো কেমন অর্থশূণ্য হয়ে পড়ে । হীরকমামা প্রিন্স হেনরির প্যাকেট থেকে তামাক বার করে সিগারেট রোল করছিলেন । ধরিয়ে নিয়ে বলেন
“ ঊনিশশো আটষ্ট্টি সালে নিউইয়র্কের রাস্তায় নিউইয়র্ক গ্রুপ অফ লিবারেল উইমেন পুরুষ যৌনতার বিরুদ্ধে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে ব্রেসিয়ের পোড়ায় – উদ্দেশটা কিন্তু অন্য ছিলো অথচ পুরুষতান্ত্রিক সংবাদমাধ্যম এটাকে অন্য ভাবে প্রচার করলো ”
বাচ্চারা সমস্বরে বলে উঠলো “ তাহলে ওরা কি উদ্দেশ্য এটা করেছিলো দাদু ?”
হীরকমামা ওনার বুড়ি দিদিকে টেনে রোদ্দুরে বসিয়ে – সিগারেটে একটা টান দেন
“ আসলে প্রথমে আন্দোলনটা হয়েছিল মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা – অবাঞ্ছিত গর্ভ নষ্ট করার দাবিতে – সেটা কিন্তু শেতাঙ্গিনীদের আন্দোলন ছিলো … দিদি তুমি তো সকালে উঠে খাওনি কিছু.. একটা বিস্কুট খাও ? ”
বুড়ি অতি বাধ্য বালিকা কন্যার মতো ঘাড় নাড়েন । ঋমি উঠে দুটো বড়ো বড়ো বিস্কুট এনে দ্যায় । উনি বিস্কুটদুটো দুহাতে নিয়ে কি করবেন ভেবে পান না । দিশী এসে একটা বিস্কুট নিয়ে বলে
“ ঠাম্মা হাঁ করো …” বুড়ি লাজুক হেসে বিস্কুটে কামড় দ্যান । সিগারেটে টান দিয়ে আকাশে চোখ তুলে হীরকমামা বলতে থাকেন
“ প্রাচীন যুগে তো লিপস্টিক ছিলো না – তবে অনেক আগে সম্ভবতঃ গ্রীসের সম্রাট আইন করেন যে প্রত্যেক দেহোপজীবিনীকে ঠোঁটে লাল রং লাগাতে হবে নাহলে সোওওজা জেল আরও অবাক কান্ড যে কোনও ঠোঁটে রং করা মহিলা যদি বিয়ে করে তাহলে তাকে ধরা হবে সে ডাইনীবিদ্যার সাহায্যে পুরুষের মন জয় করেছে – ডাইনীবিদ্যা মানে – উইচক্র্যাফ্ট বোঝো তো ?”
বাচ্চাদের চোখ তখন কপাল ছাড়িয়ে আকাশে ওঠার জোগাড় । গায়ত্রীদেবী তখন খুব মন দিয়ে একটা কাক একটা কুকুরের ল্যাজে ঠোক্কর মারার চেষ্টা করছে – সেটা দেখতে ব্যস্ত । হীরকমামা বলতে থাকেন
“ তারপর জাপানের সম্রাট একই রকম আদেশ জারি করেন ”
ভোম্রা ব্যস্ত হয়ে বলে
“ কিন্তু নারীমুক্তি ?” হীরকমামা সিগারেটটা ফেলে কাবুলি জুতোর তলায় পিষে নেভালেন । ভোম্রাকে পাত্তা না দিয়ে বলে যেতে থাকেন
“ তখন মেয়েদের গর্ভপাত করানোর অনুমতি ছিলো না । অর্থাৎ কোনও ধর্ষিতা গর্ভবতী হলেও সে গর্ভপাত করাতে পারবে না – কোনও নারীর কোনও যৌন ইচ্ছে অনিচ্ছা স্বাধীনতা কিচ্ছু নেই । ছিলো না । আজও আছে কিনা জানি না । তোমরা সিমন দ্য ব্যোভেরির নাম শুনেছো ?” হাবু বলে “ মনে হচ্ছে শুনেছি ” হীরকমামা প্রিন্স হেনরি
( আসলে উচ্চারণটা অঁরি )র প্যাকেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন “ ওনার লেখা বইটার নাম ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ – একটু বিষয়টা বলি ? মেয়েদের এমন ভাবে মানুষ করা হয় যে তারা ভাবতে শেখে মেয়েদের কাজ শুধুমাত্র স্বামীর উপার্জিত টাকায় জীবনযাপন আর সন্তান পালন করা ”
“ এটা কোন দেশের বই?”
“ ফরাসী”
“ ওদেশেও এই অবস্থা ?” বাচ্চাদের সমবেত বিষ্ময়জ্ঞাপন !
“ হ্যাঁ এদেশেও বলা হয় পুত্রর্থে ক্রিয়তে ভার্যা – ক্রিয়তে মানে করা হয় , অর্থাৎ পুত্র উৎপাদনের জন্যেই বৌ – দ্যাখো এখানেও পুত্র – কন্যার কথা বলা নেই । তারপর শেখানো হয় যে যদি তোমার উপার্জন বা সম্মান পুরুষের থেকে বেশী হয় তাহলে হয় তোমার স্বামী বা প্রভু তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে নাহলে তোমার স্বামী জুটবে না । ১৯৪৯ সালে লেখা – ১৯৫৮ সালে বইটার ইংরেজী অনুবাদ হয় তারপর রাস্তায় শুরু হয় নারীবাদী আন্দোলন । প্রথমে কেবলমাত্র মধ্যবিত্ত শেতাঙ্গিনীদের মধ্যেই এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল । এটাকে নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম তরঙ্গ বা ফার্স্ট ওয়েভ বলা হয় । এরা নারীর রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা এবং অত্যাচারের অবসান দাবী করেন , সংসারের অত্যাচার এবং যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে পথে নামেন ”
পচুই উশখুশ করছিলো । হীরকমামা প্রিন্স হেনরি তামাকের প্যাকেটটা ওর হাতে তুলে দিলেন ।
“ বাব্বা এতো চমকে দেওয়ার মতো বই – আজও তো আমাদের এই শিক্ষা দিয়েই বড়ো করা হয় … ” টমেটোর চোখমুখে বিষ্ময় থৈ থৈ করে । হীরকমামা দ্বিতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে পচুইএর কাছ থেকে তামাকের প্যাকেট নিয়ে বলতে থাকেন “ এর পর দ্বিতীয় তরঙ্গ তৃতীয় তরঙ্গ এক এক করে নারীমুক্তি আন্দোলনের ঢেউ এসে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে । এর পর কালার্ড মানে কালোরাও এই আন্দোলনে সামিল হয় – মূল বক্তব্য কিন্তু সেই নারীর স্বাবলম্বন ব্যাপারটাই থাকে । অর্থাৎ শ্রমের সম অধিকার – সমান মজুরি – যৌন স্বাধীনতা – মানে সমলিঙ্গের প্রেম – ক্রস ড্রেসার – ট্র্যান্স জেন্ডার – ঐ ইয়ে সেক্স ওয়ার্কার – মানে গিগোলোরাও এবং – পুরুষতান্ত্রিক নিয়মকানুন থেকে মুক্তি এবং….” মামু আবার চায়ে চুমুক দিলেন
“ অথচ আজকের অনেক মেয়েই নারী স্বাধীনতা বলতে কেবলমাত্র ধূমপান – ইচ্ছে মতো সাজপোশাক..এটাকেই ধরে নিয়েছে ”
বাচ্চারা শুনতে থাকে । বুড়ি দিদি দূরে কোথাও তাকিয়ে থাকে । ওনার সামনে এসে একটা শালিখ বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ওনাকে নিরীক্ষণ করে “ চলো পিড়িং ফুরুৎ করে…..” বলে উড়ে চলে যায় ।
“ আজও মেয়েরা মনে করে পয়সাওয়ালা স্বামী চাই – সুন্দর মুখ চারটে গয়নাই আমার সম্পদ – অথচ ভাবে না আমি স্বাবলম্বী হবো… আবার বিপরীতে নিম্নতম আয়ের পরিবারে মেয়েরা শ্রমের কাজ করে মাটি কাটে – পাথর বয় এবং ক্রীতদাসীর মতো জীবন কাটায় – এটাও না – সমদায়িত্ব সমমর্যাদাই কাম্য ”
হাবু মানে আহ্বানীয়া বলে
“ আমরা নিজেদের সুন্দর দেখাতে চাইবো না ?”
হীরকমামা বলেন “ নিশ্চয়ই – কিন্তু পুরুষের ঠিক করে দেওয়া পথে নয় – ঠোঁটে রং মেখে – শুধু সাজপোশাক দিয়ে নয় । শিক্ষায় সুন্দর হও – শরীরের চর্চা করে শরীরে সুন্দর হও – সাহসী হও – তোমাদের মধ্যেও তো কেউ কেউ বেশ মোটা কিন্তু পরেছো ভীষণ দামী কোম্পানির জামাকাপড় – এটাই বুঝি স্বাধীনতা ? ব্যায়াম করে সুন্দর হও – সৌন্দর্য স্বাস্থ্যেই থাকে ” হীরকমামা কাপ নামিয়ে রেখে ওনার দিদির মাথায় হাত রাখেন
“ দিদি তুমি কি ইস্কুলে পড়েছো ? ”
শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বৃদ্ধা মাথা নাড়েন – না ।
“ দিদি তুমি কলেজে পড়েছো ?” দিদি ওপর নিচে মাথা নাড়েন । “ কি পড়েছো ডাক্তারি ?” বৃদ্ধা শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন “ হ্যাঁ ”
“ দিদি প্রাইভেটে ম্যাট্রিক দিয়ে ডাক্তারি পড়েছে – আমাদের সব ভাইবোনের রান্না করে কলেজে যেতো … জামাইবাবুকে যখন ভালবেসে বিয়ে করে তখন জামাইবাবু ভাইবোনের দায়িত্ব পালনের জন্য পড়াশোনা ছেড়ে সিনেমা হলের ম্যানেজারি – পাহাড়ে পাহাড়ে ওভারসিয়ারি এইসব করছে … আমার দিদি গয়না পরেনি .. সাজেনি … মাথা উঁচু করে চলেছে । আমার কাছে নারী স্বাধীনতা মানে আমার দিদি ..”
হীরকমামা তাঁর বৃদ্ধা স্মৃতিহীনা দিদিকে ধরে ধরে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকেন । বৃদ্ধার পায়ে পায়ে নেড়ি কুকুরগুলো চলতে থাকে ।
অপূর্ব, মুগ্ধ হলাম। আমার মেলে যোগাযোগ রাখবেন প্লিজ।
My mail – drajana69@gmail.com
গল্পের বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই, প্রত্যেক বারের মতো এবারও খুব ভালো হয়েছে, আমি আপনার অনেক পুরনো পেশেন্ট, আজকেও আপনার আন্ডারেই চিকিত্সাধিন রয়েছি, ডান হাতে সূচ ফুটানো তাই বা হাত দিয়ে লিখছি, যেটা বলার সেটা হলো আমি আপনার গল্পের একজন নিয়োমিত পাঠক, বহুবার নতুন গল্প লেখার জন্য আবদার করেছি মানসিক ভাবে আনন্দ পাওয়ার জন্য কিন্তু আজ আপনাকে সারাদিন হসপিটালে না খেয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরেও যখন আমার মতো পাঠক দের আনন্দ দেবার জন্য আপনি লেখেন এবং তার জন্য আপনাকে মানসিক ভাবে কতটা স্ট্রং থাকতে হয় সেটা কাছ থেকে দেখার পর আপনার লেখার সুনাম করার জন্য ভাষা জোগাড় করতে পারছিনা ।
???
অসাধারণ Sir । মন ছুঁয়ে গেল। । বলার ভাষা নেই