(গর্ভপাত নিয়ে একটি কাল্পনিক কথোপকথন)
ডাক্তারবাবু, আপনি Pro-Life না Pro-Choice?
মানে? জীবন বাঁচানো যার পেশা সে জীবনের পক্ষে না বিপক্ষে? কী অবান্তর প্রশ্ন!
না ডক্টর, আমি জানতে চাইছি আপনি Pro-life না Pro-Choice. শহরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ন’মাসে গর্ভপাত নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাইছিলাম।
কিন্তু সে তো হয়েছে মহামান্য উচ্চ আদালতের রায় সাপেক্ষে। তাতে একগুচ্ছ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সম্মতিও ছিল। শুনেছি গর্ভস্থ ভ্রূণটির নাকি ভয়ানক শারীরিক ত্রুটি ছিল।
না মানে, আইনকানুন, কোর্টকাছারির বাইরেও তো কিছু বক্তব্য থাকে। সেই জন্যেই তো জানতে চাইছিলাম আপনি Pro-Life না Pro-Choice?
আমি Pro Patient, রোগীর বেস্ট ইন্টারেস্ট দেখাই আমার কাজ। চিকিৎসক হিসেবে রোগীর অ্যাডভোকেট হওয়াটাই আমার সেরা কর্তব্য বলে মনে করি।
তার মানে গর্ভাবস্থায় আপনি শুধু অন্ত:স্বত্তার কথা ভাববেন? গর্ভস্থ ভ্রূণের কোনো অধিকার নেই!
তা বলিনি। বলেছি মায়ের অগ্রাধিকারের কথা। মেয়েদের প্রজননগত স্বাধিকারের কথা। আজকাল মেয়েরা চাইলে ঠিক করতে পারেন কখন তিনি সন্তান ধারণ করতে চান। প্রসবের পদ্ধতির ওপরও তাঁর যথেষ্ট কর্তৃত্ব আছে। কিন্তু জেনেশুনে তাঁকে একটি অত্যন্ত অসুস্থ শিশুর জন্ম দিতে বাধ্য করা যায় না। আর যে দেশে সোশ্যাল সাপোর্ট এত নড়বড়ে তথা অসুস্থতার সমস্ত দায় বর্তায় মায়ের বা পরিবারের প্রতি, সেখানে তো ব্যাপারটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। এককথায় আমি ফোর্সড মাদারহুডের বিরোধী।
ওকে, ধরে নিলাম আপনি মায়ের বেনিফিট দেখেছেন। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে আপনি তো প্রথমে “Do no harm” এ শপথবদ্ধ। এতে কি আগত শিশুটির ক্ষতি করা হলো না? আপনি যাকে গর্ভপাত বলছেন সে তো আসলে ভ্রূণহত্যা। আর প্রতিটি মানবভ্রূণেই রয়েছে এক একটি মানবজীবন।
দাঁড়ান দাঁড়ান। অনেকগুলো কঠিন এথিক্যাল প্রশ্ন একসাথে করে ফেললেন। আর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অঙ্কের মতো ঠিক বা ভুলের বাইনারি ছকে পড়ে না। আমার কাছে যা ঠিক, আপনার কাছে সেটা গ্রহনযোগ্য নাই হতে পারে। আবার পরিস্থিতি বদলালে আমি আজকে যেটা ঠিক বলছি কাল হয়তো অন্য কথা বলবো। হ্যাঁ মায়ের বেনিফিটই অগ্রাধিকার পায়। তাঁর শারীরিক ও মানসিক দু’ধরণের স্বাস্হ্যের কথাই ভাবতে হয়। বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের মা-বাবার সাথে কথা বলে দেখবেন। সন্তানের স্বার্থে সবাই দাঁতে দাঁত চেপে লড়েন কিন্তু সম্ভব হলে তাঁদের অধিকাংশই হয়তো এই বাধ্যবাধকতা এড়াতে চাইতেন। আর ভ্রূণের প্রতি Non maleficence (Do no harm) এর কথা বলছেন? জন্মের পর যে শিশু চলতে হাঁটতে পারতো না, প্রস্রাব পায়খানার ওপর নিয়ন্ত্রন থাকতো না এবং বয়সোচিত মনের বিকাশও হতো না…আপনি কি সেই সন্তানের বাবা-মা হতে চাইবেন?
বড় বেশি জাজমেন্টাল কথাবার্তা বলছেন যে! ঈশ্বরদত্ত জীবনের ওপর খবরদারির মালিক কি চিকিৎসক? না কি মহামান্য আদালত?
হুম্। একটু ব্যাকফুটে ফেলে দিলেন যে! আচ্ছা আরো একটু পিছিয়ে যাই। নতুন প্রাণের সন্চার তো ডিম্বাণুর নিষেকের সাথে সাথেই হয়ে যায়। সে দিক থেকে দেখতে গেলে তো ক্যাথলিকদের মতো গোটা গর্ভপাত আইনটারই বিরোধিতা করতে হয়।
যদ্দূর জানি Pro-Life সমর্থকদের তো তাই মত। আর ঈশ্বরের কথা তুললেন যখন অভয় দিলে একটা কথা বলি?
বলুন।
ঈশ্বর যদি সবার প্রতি সদয় হন তাহলে কোনো কোনো ভ্রূণে এত ত্রুটি থাকে কেন? তারা কি Children of a lesser God?
তাছাড়া তারা যখন জন্ম নেয় স্বয়ং ঈশ্বর তাদের দেখভালের দায়িত্ব নেন না কেনো? এত এত অসুস্থ অসহায় মানুষ মন্দির মসজিদ গীর্জার বাইরে ভিক্ষা করে। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কি দেখতে পান না? ঈশ্বর নিজে যদি এত perfect হবেন তাঁর সৃষ্টিতে এক imperfections থাকে কেন? আর তাঁর ভুলের দায়ভার একজন মা বা অন্য কোনো মানুষ বহন করবেন কেন!
তার মানে ডক্টর আপনি মানুষের সৃষ্টিতে ঈশ্বরের অবদান অস্বীকার করেন? দু’কলম ডাক্তারি পড়ে আপনারা নিজেদের বড় বেশি ক্ষমতাবান ভাবেন। বলুন তো আমরা ঈশ্বরের সৃষ্ট না কি বিবর্তনের ফল?
বিবর্তন। আইনস্টাইন, নিউটনের তত্ত্বের পিছনে যেমন তথ্যপ্রমাণ আছে ডারউইন ওয়ালেস এর থিয়োরির সমর্থনেও যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বহু বহু বছর ধরে পরিবর্তনগুলো হয় বলে হয়তো আমাদের চোখে পড়ে না। আর সরাসরি কার্যকারণ বা সাক্ষ্যপ্রমাণ না পেলেই তো প্রবণতা আসে ঈশ্বরের দোহাই দেওয়ার। সৃষ্টির প্রশ্নে বিবর্তনবাদ এর চেয়ে ভালো যুক্তি এখনো পাই নি। আমি ওই “God of the gaps” কনসেপ্টে বিশ্বাসী নই। আজ যেটা জানি না কাল হয়তো জানবো।
নাহ্, আলোচনাটা অন্যদিকে টার্ন নিয়ে নিচ্ছে। আজ এই পর্যন্ত থাক। আমরা পরের সংখ্যায় ভ্রূণের অধিকার নিয়েই কথা বলবো।