“মাতা জননী ধরিত্রী, দয়াদ্র হৃদয়া সতী।
দেবীভ্যো রমণী শ্রেষ্ঠা নির্দ্দোশা সর্ব দুঃখ হরা।।”
দু’বছর বয়সের আগে মানুষের নাকি কোনো স্মৃতি থাকে না। আমারও নেই। অথচ চেতনার আলোআঁধারির পেছনে সেই মহিলাকে যেন দেখতে পাই আমাকে ‘মা’ বলানোর চেষ্টা করছে। কিংবা টলমল পায়ে হেঁটে ফেলতেই হাততালি দিয়ে উঠছে। নিজের বুকের ওমে শীতের রাতে সময়ের আগে হয়ে যাওয়া ছেলেটাকে গরম রাখার চেষ্টা করছে।
‘মা’ সবার একরকমই হয়। হয়তো হয় না। যাদের হয় না তাদের মতো ভাগ্যহীন পৃথিবীতে কমই আছে। আমি ভাগ্যবান – আমি মায়ের স্নেহ পেয়েছি।
চিকিৎসক বলে জানি মানুষের জীবন কয়েকটি শিরা-উপশিরা, মাংসপেশি, অস্থি মজ্জা, স্নায়ুতন্ত্রের সমষ্টি। এদের জটিল বোঝাপড়ার প্রতিফলন মানুষের বেঁচে থাকা বা সুস্থ থাকা। মনও কিছু হরমোন ও স্নায়ুর সফটওয়্যারের কারসাজি। আমরা, চিকিৎসকরা সেই কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা একেকটা কম্পিউটার। আমরাও একই অ্যানাটমি, ফিজিওলজির সমষ্টি, আমাদেরও অসুখ আছে। সুখও আছে। শরীর খারাপ আছে, মন খারাপ আছে। স্মৃতিতে খুশি হওয়া আছে, দীর্ণ হওয়া আছে। মায়ের কথা লিখতে বসে এক আকাশ ভাললাগা আছে।
শুরুর দিকে মায়ের কথা বলেছিলাম। শেষটুকুতেও না হয় মায়ের কথা বলি। আমার অর্ধেক জীবনটাই যে মাকে নিয়ে গল্প। দু-হাত জড়ো করা আঁজলায় যেটুকু মাকে ধরা যায় সেটুকু থাক সবার জন্য। আর বাকি এক সমুদ্র মা রয়ে যাক আমার স্মৃতির মণিকোঠায়।
মায়ের সঙ্গে প্রথম স্মৃতিটাই ডাক্তারি এবং প্রথম মার খাওয়া নিয়ে। তখন বছর চারেক বয়স। মায়ের একটা হোমিওপ্যাথির বাক্স ছিলো। আর ছিলো হোমিওপ্যাথির মোটা একটা বই। বইটা আমার খুব প্রিয় ছিল – কারণ ওই বইয়ের পাতায় পাতায় এবিসিডি-র চেনা অবয়বগুলো এদিক ওদিক ছড়ানো ছিলো। বিকেলবেলায় মা ওই বইটা হাতে পাড়ার মহিলাদের টুকটাক চিকিৎসা করতো। ছোট ছোট সাদা গুলিতে ঝাঁঝালো তরল কয়েক ফোঁটা মিশিয়ে ওষুধ তৈরি হতো। মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখতাম কান্ডকারখানা।
ঘটনাটা ঘটেছিল এক দুপুরে। মা ঘুমিয়ে রয়েছে। আমি আমার ভাঙা খেলনা রেলগাড়ি আর বিনাকা টুথপেষ্টের সাথে পাওয়া খরগোশ, কুকুর, বেড়াল পুতুল নিয়ে ব্যস্ত। হয়তো তাদেরই কারো শরীর খারাপে ওষুধ দেবার প্রয়োজন হয়েছিল। মায়ের ওষুধের বাক্স থেকে কয়েকটি দানা আর কয়েক ফোঁটা তরল দিয়ে তৈরি হ’ল ওষুধ। কিন্তু পুতুল তো আর ওষুধ খেতে পারে না। ওদের হয়ে আমিই কয়েকটা দানা খেয়ে নিলাম। বাহ্, খেতে তো বেশ ভালো। আরো দু’চারটে খেলে মা নিশ্চয়ই ধরতে পারবেনা!
লোভ বড়ো ভয়ংকর জিনিস। বড়ো বড়ো মহাপুরুষেরা বলে গেছেন। তখনো মহাপুরুষদের বাণী শোনার বা বোঝার বয়স হয়নি। পরে শ্রীরামকৃষ্ণের বলা সেই গল্পটা শুনেছি। একটা পাখি একটা গাছে ফল খেয়ে বেড়াচ্ছে। যখন মিষ্টি ফল খাচ্ছে তখন মন বলছে আরেকটা খাই। পরের ফলটা যদি বিস্বাদ হয় মন বলে ওঠে আরেকটা খাই- মিষ্টি ফল হলে মুখটা ঠিক হয়ে যাবে। এই ভাবেই সংসারে জড়িয়ে যায় মানুষ। সেই গল্পের অন্য একটি পাখি চুপচাপ গাছে বসে থাকে। লোভ তাকে ছুটিয়ে নিতে পারেনা। আমি তখন ঠাকুরের গল্পের প্রথম পাখি। কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো বাক্স ফাঁকা।
পাপ কাজ চাপা থাকে না। মা তার ফাঁকা বাক্স আবিষ্কার করে আমার সম্বর্ধনার ব্যবস্থায় হাত দিলো। অতো ওষুধও যখন হজম করে নিয়েছি মারধোরও তখন ঠিক হজম করতে পারবো।
আরেকটা ঘটনা। তখন ক্লাস সিক্সের একটা বৃত্তি পরীক্ষা হতো। স্কুলের ভালো কয়েকটা ছেলেকে সেই পরীক্ষায় বসানো হতো। আমারও পরীক্ষা দেবার কথা। বাবার কি কারণে অফিসে সেই সময়টায় খুব চাপ ছিলো। এদিকে মায়ের ধুম জ্বর। বাবা বললো যে স্কুলে জানিয়ে দেওয়া হোক আমি পরীক্ষা দেবো না। সকালবেলা তাই ঠিক ছিলো। আমিও খুব খুশি। দুম করে ঘাড়ের ওপর এসে পড়া পরীক্ষাটা আর দিতে হবে না। মা ছাড়ার পাত্রী নয়। ওই জ্বর নিয়ে আমাকে তৈরি করে সেন্টারে নিয়ে গেলো। মায়ের গা দিয়ে তখন আগুন বেরোচ্ছে। পরীক্ষা হলো একরকম। কিন্তু ছুটির পর মাকে আর খুঁজে পাইনা। শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যে অনেকগুলো স্কুল। সেরকমই একটা স্কুলের বেঞ্চে শুয়ে মা অচেতন হয়ে পড়ে আছে । মাকে তুলে নিয়ে অনেক কষ্টে বাড়ি এলাম।
বৃত্তি পেয়েছিলাম। মায়ের আশীর্বাদ ছাড়া পাওয়ার কথা ছিলনা।
সেই মা শুয়ে ছিলো আমাদের আইসিইউর একটা বেডে। একটা ভীষণ অসম লড়াই চলছিল তখন। মৃত্যুর সাথে আমরা সাধারণ কটা ডাক্তারের। মায়ের শরীরে পোষা সুগার। দীর্ঘ দিনের সঙ্গী। ইনসুলিন চলে মায়ের ইচ্ছে মতো – ডাক্তারের নির্দেশ মতো নয়। যেদিন ইচ্ছে হলো ইনসুলিনের ছুটি। এর সাথে ছিলো অসম্ভব মিষ্টিপ্রীতি। এর ওপর মায়ের বান্ধবীদের (মা একটা লিটল ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত ছিল) কাছ থেকে হাড় হিম করে দেওয়া সব তথ্য পাচ্ছিলাম। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে মায়ের অনুরোধই ছিল – “আমার জন্য শুধু দুটো রসগোল্লা আনাস আর একটু বেশি চিনি দিয়ে চা করাস।” আইসিইউর ইনচার্জ আমার বন্ধু সৌপ্তিক বসু। সে মাথাফাথা চুলকে বলে “মাসিমা তো সোজাসাপটা কেসরে! ব্রেনে বেশ কিছুটা রক্ত জমে আছে, সুগারের আপার লিমিটের কোনো বার নেই, কিডনিটাও সুগারের জন্য ড্যামেজ হয়ে আছে, হার্টেও অ্যাটাক হয়েছে, সারা শরীরে জল জমেছে -মানে হ্যারিসন বইয়ের লাস্ট এডিশনের অ্যাডভারটাইজমেনট।”
মা বৈদ্যবাটী থেকে কৃষ্ণনগরে আমার কাছে এসেছিল পূজো উপলক্ষে। এসে পর্যন্ত ঝিম মেরে রয়েছে। রত্নেশ্বরদা মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। বাড়িতে এসে বললেন “ভালো ঠেকছেনা, রক্তের সোডিয়ামটা টেস্ট করাও।” সোডিয়াম কম এলো। রাতে সোডিয়াম চালিয়েও ঝিম ধরা ভাব কাটে না। সিটি স্ক্যান করে দেখা গেলো মাথায় বেশ খানিকটা রক্ত জমে আছে।
মা হার্টের জন্য রক্ত তরল রাখার ওষুধ খেতো। বাবার কাছ থেকে জানা গেলো দু’চারদিন আগে রাতের বেলা খাট থেকে নামতে গিয়ে মাথাতে লেগেছিল। সেটা থেকেই হয়তো এই রক্তপাত। এতো সুগার, সব ডাক্তারদের মতে ম্যানিটলের মতো ওষুধ চালিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা চালানো উচিত। জেলা হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হলো। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বন্ধু ডাক্তাররা মায়ের খোঁজ নিচ্ছিলেন, পরামর্শ দিচ্ছিলেন। হোয়াটসঅ্যাপে মায়ের রিপোর্টগুলো পৌঁছে যাচ্ছিল তাঁদের কাছে। আমাদের হাসপাতালের সব চিকিৎসক খোঁজ নিয়ে যাচ্ছিলেন মায়ের। সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যার সুযোগ পেলেই মাকে দেখতে আসছিলেন। জেলার মূখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক স্যার আমার কলেজের সিনিয়র। “মাসিমাকে ঠিক করার জন্য যা প্রয়োজন হয় কর। কোনো ব্যাপারে অসুবিধে হলে আমি আছি।”- মাকে দেখতে এসে সিএমও স্যারের প্রকৃত দাদার মতো খুল্লামখুল্লা বক্তব্য।
কিন্তু পাঁচদিন পেরিয়ে যাবার পরেও উন্নতি নেই। সিটি স্ক্যানে বরং কিছুটা অবনতি। আমার নিউরোসার্জন বন্ধুরা, এইমসের এক নিউরোসার্জন, আমার বন্ধুর বন্ধু ইংল্যান্ডের এক নিউরোসার্জন – সবারই বক্তব্য এবার অপারেশন করা উচিত।
কলকাতার এক নামকরা বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক প্রিয়জিত দত্ত আমার ব্যাচমেট। সেই মাকে সেখানে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দিলো। সেদিনই নিউরোসার্জন মিনুদা অপারেশন করলেন। অনেকটা রক্ত বেরলো। পরের দিন একটু ভালো। কিন্তু দুদিন পর আবারও মা ঝিমিয়ে পড়তে লাগলো। এবার সিটি স্ক্যানে আর রক্ত জমা দেখতে পাওয়া গেলো না। কিন্তু কিডনি ড্যামেজ হচ্ছিল। প্রতিদিন একটা করে অ্যালবুমিন চালিয়ে মোটামুটি ঠিক রাখা হচ্ছিল। সাতদিন বাদে সেখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো। সরাসরি নিয়ে এলাম কৃষ্ণনগরে। ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা বাদে মায়ের আবার শ্বাসকষ্ট। নেবুলাইজ করলাম। শ্বাসকষ্ট কমেনা। রত্নেশ্বরদা ডায়াগনোসিস করলেন যে এবার হয়েছে হার্টের সমস্যা। মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কসন নিয়ে আবার জেলা হাসপাতালের আইসিইউতে। সেটাও সামলানো গেলো তো কিডনি একদম কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কলকাতা থেকে আমার জুনিয়র এক নেফ্রোলজিস্ট এসে বললেন যে ডায়ালিসিস করতে হবে। কদিনের ব্যবধানে তিনটে ডায়ালিসিস হলো।
সাতই ডিসেম্বর, কিছুক্ষণের জন্য হাসপাতালের বাইরে এসেছিলাম। আইসিইউর অন ডিউটি মেডিক্যাল অফিসারের ফোন – “দাদা, শীগগির এসো, মাসিমার অবস্থা ভালো বুঝছিনা।”
ঠিক একমাস ন’দিন। আমাদের সবার লড়াইটা থেমে গেলো। ঈশ্বরের সাথে অসম লড়াইয়ে হেরে গেলাম আমরা। মায়ের বুকে মাথা রাখলাম – হৃদযন্ত্র শব্দ তুলছেনা। গালে চুমু খেলাম – বরফের মতো ঠান্ডা সে গাল। আমার চোখের জলে মাখামাখি হয়ে গেলো একমাস ন’দিন কষ্ট পাওয়া মায়ের মুখ।
মায়ের নিথর দেহ নিয়ে ফিরে এলাম বৈদ্যবাটী – আমার দেশের বাড়ি।
সব শেষ হওয়ার পর শীতের রাতে গঙ্গাজলে ভাসিয়ে দিলাম মায়ের শেষ অংশটুকু।
আমার আজন্ম স্মৃতি ভেসে যায় আঁধারে কালো হয়ে যাওয়া বরফ শীতল জলে। আমি ঘাট থেকে উঠে আসি। পেছন থেকে সমস্ত অতীত ‘অনি’ বলে ডেকে ওঠে। আমি কাঁদতে কাঁদতে মাতৃহীন পৃথিবীর দিকে এগোতে থাকি। সম্পূর্ণ অন্য এক আমি। আর পিছু ফিরে তাকাই না। চোখ ভরা জল নিয়ে আর কিছু দেখতে পাবো না যে!
———————–আগামী পর্বে সমাপ্য ————–
মা হারানোর আখ্যান মনকে কষ্ট দিল। সহমর্মিতা ছাড়া আর কী ই বা জানাতে পারি।
আজ আপনার লেখনী মনের কোথায় আঘাত করেছে নিজেই বুঝতে পারছি না।
মন ছুঁয়ে যায়
Kaandaali Bhai! Abar kaandaali! Maashima benche thaakben chirokaal. Amader moner modhye. Smritigulo niyei jibone shesh hawbe. Akhon tow kono gondi dwaara abawddho non uni. Shob shawmay aachhen tore saathei! Akbaar bhaab tow!
Cheshta korechhilaam amra. Mone theke. Hridoy diye. Oitukui shaantona. Bidhir bidhaan amader maantei hoy. Baar baar. Roj. Proti muhurtey .
কষ্ট গুলোকে এত গুছিয়ে লিখেছেন যে আরো বেশী কষ্ট লাগছে, এছাড়া আর কিছু বলতে পারছিনা ।
Sir মায়ের কষ্টের বেদনাদায়ক কথা গুলো শুনে হৃদয়ে খুবই কষ্ট পেলাম. ঈশ্বর যেন মাকে ভালো রাখেন. আর আপনি নিজে মানুষের সেবায় নিয়োজিত কমর্কে পালন করে মায়ের অসময়ে নিয়োজিত হয়ে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন আপনাকে দেখে আজকের সমাজের সন্তানদের শিক্ষা নেওয়া দরকার গর্ভধারিনী মা কি? ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন. আপনি খুব ভালো sir আপনি আমাদের মাঝে দীর্ঘ সময় ধরে থাকেন. আমার বাবা কে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আপনাকে খুব কাছে থেকে চিনেছি আপনার মানবিক আচরণ good sir good . ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক.
মন টা ভারাক্রান্ত করে দিলে, এ কষ্ট যে কি মা হারা যারা তারা বোঝে, তোমার জন্য আমাদের সমবেদনা জানাই, তোমার আন্তরিক চেষ্টা করে ও মা কে ধরে রাখা যায়নি, তবে এ সুযোগ আবার অনেকে পায় না, আশা করি তাঁর স্মৃতি নিজের মধ্যে চিরকাল এমনই অমলিন থাকবে, মায়ের কথা মনে করে আরও অনেক মায়ের সেবায় নিজেকে জড়িয়ে নাও, তাঁর আশীর্বাদ সব সময় তোমার সাথে থাকবে। আরও অনেক অনেক কিছু তোমার কাছ থেকে পাবার আশায় রইলাম আমরা সবাই।