মায়ের বুকের দুধের কোনও বিকল্প হয় না। সদ্যজাতের প্রথম ছ’মাস কেবল মায়ের দুধ। আর কিচ্ছু না। এমনকি শিশুর জলেরও প্রয়োজন নেই।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল হোক কিংবা যে কোনও প্রসূতি কেন্দ্র এই কথাগুলো লেখা হোর্ডিং, ফ্লেক্স প্রায় চোখে পড়ে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে স্তন্যপান করানোর প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো কি এ দেশের সর্বত্র আছে? এত প্রচারের পরেও কি মায়েদের সেই আত্মবিশ্বাস দেওয়া হয়, যেখানে সে বিশ্বাস করবে তার সন্তানের জন্য তার বুকের দুধ যথেষ্ট!
মায়ের বুকের দুধ নবজাতকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই মা শিশুর জন্মের পরের প্রথম ছ’মাস শুধুমাত্র স্তন্য পান করাবে। কিন্তু এই প্রথম ছ’মাস কি মা বাড়ির বাইরে পা রাখবেন না, এমন অলিখিত শর্ত আমরা ধরে নিয়েছি?
সন্তান জন্মের পরে সুস্থ মা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবেন। প্রয়োজনে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাবেন, ইচ্ছে হলে শপিং মলে যাবেন। দরকারে বাসে-ট্রেনে চড়বেন। এগুলো ভাবতে কি আমাদের খুব অসুবিধা হয়। কারণ, এই স্বাভাবিক জীবনে মা ফিরে গেলে, সদ্যোজাতকে স্তন্যপান করাবেন কীভাবে? কারণ এ দেশে তো অধিকাংশ পাবলিক প্লেসে ব্রেস্ট ফিডিং জোন থাকেই না!
বিমান বন্দর, বাস স্টপ, রেলস্টেশন এমনকি শপিং মলে শিশুর ডায়পার পরিবর্তনের জায়গা থাকলেও, আলাদা করে ব্রেস্ট ফিডিং জোন থাকে না। এমনকি কয়েক বছর আগে, কলকাতা শহরের একটি শপিং মলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিলো, এক মা তার সন্তানকে মলের ভিতরেই স্তন্যপান করাচ্ছিলেন বলে শপিং মল কর্তৃপক্ষ তাকে বাধা দেয়। অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ জানান, এই দৃশ্য অন্যদের জন্য অস্বস্তিকর। তাই এভাবে স্তন্যপান করানো যাবে না। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যে কোনও পাবলিক প্লেসে শিশুকে স্তন্যপান করানো বেশ সমস্যাজনক। আশপাশের মানুষের বক্র দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজের ব্যক্তিগত স্থান উন্মোচন সর্বদা সহজ হয় না। কেন মায়ের কাছে শুধু ব্রেস্ট পাম্প করে দুধ বোতলে ভরে আনাই একমাত্র পথ থাকবে? সঙ্গে সন্তান থাকলে কেন সে সরাসরি স্তন্যপান করাতে পারবে না?
যে কোনও উন্নত দেশের রেল স্টেশন কিংবা বিমানবন্দর গেলে শৌচালয়ের মতোই স্তন্যপান করানোর নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারিত থাকে। সেটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। যেখানে শিশুকে মা স্তন্যপান করাতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের দেশে এমন পরিবেশ নেই। হয়তো, এ দেশে মা হলে আর বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই এমন অলিখিত নিয়মই সর্বস্তরের কর্তৃপক্ষ কায়েম করাতে চান।
তবে, পাবলিক প্লেসের পরিকাঠামোর অভাব ছাড়াও আরেকটি চ্যালেঞ্জ মায়েদের কাছে সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। জন্মের পরের মুহূর্তেই সব সময় নতুন মায়ের বুকে পর্যাপ্ত দুধ থাকে না। তবে, শিশু স্তন্যপান শুরু করলেই সেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু সেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নতুন মায়ের আত্মবিশ্বাস তলানিতে নিয়ে নামায় তার আশপাশের মানুষেরা।
‘ওই দুধে বাচ্চার পেট ভরছে না। ,’ এই বাণী হাসপাতালের নার্স, আয়া থেকেই শুরু হয়ে যায়। পরে চার দেওয়ালের ভিতরের মা-মাসীরাও দিনে কয়েক ঘণ্টা অন্তর বাচ্চা কাঁদলেই মাকে বোঝান তার দুধ তার শিশুর জন্য যথেষ্ট নয়। শিশুর ঘুম না পেলে, ঘাড় ঘোরালে, হাত-পা ছুড়লে, চেচালে, কাঁদলে সবকিছুতেই একটাই সমাধান শুধু মায়ের দুধ খেলে চলবে না।
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, কোনও বহুজাতিক কোম্পানি এমন কোনও দুধ তৈরি করতে পারেনি, যা মায়ের দুধের বিকল্প হতে পারে। এখন তো ফর্ম্যুলা মিল্ক প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো ও তাদের প্যাকেটে বড় বড় করে লিখে দিচ্ছে, মাতৃদুগ্ধের বিকল্প কিছুই না। এমনকি করোনা অতিমারির সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল, মা করোনা আক্রান্ত হলেও শিশুকে স্তন্যপান করাতে পারেন। কিন্তু তারপরেও এ দেশের একাংশের মানুষের বদ্ধমূল ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে না।
এ দেশে নতুন মায়েদের নানান মানসিক টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কারণ, এ দেশে প্রসব পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিয়ে কোনও ধারণা বা সচেতনতা কিছুই নেই। নানা ভাবে প্রত্যাশার পারদ চাপিয়ে মাতৃত্বের অধ্যায়কে একখানা পাহাড বানানো হয়, যার চূড়ায় পৌছনো কার্যত অসম্ভব। সেখানে নতুন মাকে যখন বারবার বলা হয়, তার শরীরে তৈরি দুধ, তার সন্তানের জন্য যথেষ্ট নয়, তখন তার মাতৃত্বের সূচনাকে আরেকটু নাড়িয়ে দেওয়া যায়। আরেকটু বুঝিয়ে দেওয়া যায়, সে মা হতে কতখানি অপটু।
অগষ্ট মাস ন্যাশনাল ব্রেস্ট ফিডিং মাস। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাই স্তন্যপান নিয়ে নানান কর্মসূচি চালাচ্ছে। কিন্তু নিছক সচেতনতাই আর যথেষ্ট নয়। চ্যালেঞ্জগুলো আরও বিশদে ভাবার সময় চলে এসেছে। তাই স্তন্যপান করানো নিয়ে শুধু মা সচেতন হলেই হবে না। পাশপাশি স্তন্যপান করানোর জন্য নতুন মায়েদের উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। সে দিকে নজর দেওয়াও জরুরি।