মৃত্যুর আগে আমার মাসির একটি আইসিইউ বেড প্রয়োজন ছিল। ICU– ‘ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট’।
না! পাওয়া যায়নি। ফোঁটা ফোঁটা কমতে থাকা অক্সিজেন, আর কার্বন ডাই-অক্সাইডে ভর্তি হতে থাকা শরীর। ঝিমিয়ে যাচ্ছিল আমার শৈশবের আশ্রয় ওই মোটাসোটা দেহটা। এরপর একটা সময় অন্ধকারে ‘ dowziness’ র গোলকধাঁধায় একা একাই পাড়ি দিল অন্য জগতে। আমার ভালো করে পথ-ঘাট না-চেনা, আনস্মার্ট, ভালোমানুষ মাসিটা। কি করে যেন স্বাবলম্বী হয়ে উঠলো! হয়তো ‘মন-কি বাত’ পড়ে ফেলেছিল!
না, ভেন্টিলেশনের কপাল আমার মাসির হয়নি। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাত্র ‘ছ’টি আইসিইউর কোটা। ছুঁতে পারেনি ও। হুঁ, মেডিকেল কলেজ!!
আমার যাবতীয় ফোনা-ফোনির চেষ্টা বাতিল করে একাই চলে গেল না ফেরার দেশে। অভিমান- রাগ- নাকি যন্ত্রণা, কোনটা ওর শেষ সঙ্গী ছিল? আমার জানা নেই!
যেমন জানা নেই, গত এক বছর ধরে দ্বিতীয় ঢেউ আসবে জেনেও কেন হাত পা গুটিয়ে বসে ছিল কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার??? দীর্ঘ এই সময়ে না সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামোর উন্নয়ন, না স্বাস্থ্য খাতে বেশি করে অর্থ বরাদ্দ!! কেন প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও কোনটাই করেনি সরকার?? ইতিমধ্যেই সেফহোমগুলোর ঝাঁপ গুটিয়েছে। কোভিড বিধি চুলোদ্দোরে দিয়ে ক্ষমতা-অর্থ-সময় ঢেলেছে নির্বাচনী প্রচারে! মানুষের জীবনের কথা ভাবেনি! মানুষের কথা ভাবেনি!
ঘন ঘন খিদে পেত, ভীষণ চা ভালোবাসতো, চতুর্থীতে ফ্রাইড রাইস আর মাছ ভাজায় প্লেট সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল পুকুর ঘাটে। খেয়েছিল কিনা জানা নেই!! জানা নেই শেষ বেলায় কি একটু জল পেয়েছিল?? কিংবা একটু শান্তির ঘুম, যা ও শেষবারের মত চেয়েছিল। ওর শেষ আর্তিটুকু আমার কানে বেজেই চলে! রাত ১০-৩০ নাগাদ আমি ফোনটা করি ওকে। “ও ভাই, ভাই। আমার বিছানাটা একটু উঁচু করে দিয়ে যাবে, আমি একটু ঘুমাব”। ওই শেষ। ও মাসি তোকে অক্সিজেন দিয়েছে ওরা? আমার প্রশ্ন। মাসি আমার হেমন্তের কুয়াশার ঘোরে। এরপর কিছু গোঙানির মত শব্দ। ঠান্ডা কিছু তোর না পছন্দ ছিল। মৃত্যুর হাত কি ঠান্ডা মাসি??? ঘোলাটে???
না, হাসপাতালের কোন হাত এগিয়ে আসেনি ওর বিছানাটা উঁচু করে দেওয়ার জন্য।
এখন শুনছি মরার সময় হরিনামের মতো বেড বাড়ছে। কি লাভ ওই বেডে যদি অক্সিজেনের ব্যবস্থা না থাকে? কি লাভ যদি ১০০ জন রোগী পিছু মাত্র একজন নার্স থাকেন?? কি লাভ এমন মেডিকেল কলেজের যেখানে 50 টা মুমূর্ষু রোগীর জন্য মাত্র ছটা ভেন্টিলেশন থাকে?? কি লাভ রোগী যদি তার ন্যূনতম সমস্যাটাটুকু জানানোর জন্য কাউকে না পায়?? কি লাভ রোগী যদি ডাক্তারকে না পায়??? আমার মাসিও হাসপাতালে ডেকে কাউকে পায়নি। বেশিরভাগ রোগীরাই পাচ্ছে না। দেশের কোন সরকারি কোভিড হাসপাতলে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী নেই। একটানা শ্রমে তারা ক্লান্ত।
এত কোটির দেশে কেন সেই ২০১৯ থেকে ভেন্টিলেশন এর সংখ্যা বাড়েনি। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে এ দেশের মোট ভেন্টিলেশনে সংখ্যা ৪৮ হাজারের কাছাকাছি। আর আই সি ইউ বেড মাত্র ৯৫ হাজার। মানুষ না পিঁপড়ে আমরা?? দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব সরকারের। সরকার কেন তা সুষ্ঠুভাবে পালন করবেন না? কেন অক্সিজেনের অভাবে, আইসিইউ বেডের অভাবে, ভেন্টিলেশনের অভাবে পিঁপড়ের মতো মানুষ মারা যাবে? কেন আমরা মানুষকে তার মৃত্যুর সময়ে যোগ্যতম সম্মান দিতে পারব না???? আমার এই প্রশ্ন রাষ্ট্রের কাছে? কেন দেশের নাগরিক সু-স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে?
ডাক্তারের বলা সত্বেও ও হাসপাতালে যেতে চাইনি। দুদিন ধরে অক্সিজেন স্যাচুরেশন নামছিল। অচেনা অজানা কোন হাসপাতালে মাকে পাঠাতে চায়নি আমার বোন- আমার মায়েরা। আমারও কি দুশ্চিন্তা ছিল না??? শেষবার যখন তোর হাতটা শক্ত করে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে তোকে ধরে এম্বুলেন্সে তুলে দিচ্ছিলাম, ভয় তো আমার করছিলোই, নয়তো প্রণাম করলাম কেন তোকে???
সেই হাসপাতলে পাঠালাম! দুদিন আগে যদি পাঠাতাম! হয়তো। হয়তো এই দিনটা দেখতে হতো না!! হ্যাঁ আমি ভুল করেছি। ভুল করেছি শরীরে অক্সিজেন কমতে দেখেও সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা না করে। বুঝতে পারিনি আসলে তোর নিঃশ্বাসে বিষ জমছে। আসলে তুই একটু একটু করে ফুরিয়ে যাচ্ছিস।
আর সবার মতো বাড়িতে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেছি। যা এই ধরনের রোগীকে কখনোই সুস্থ করতে পারে না। বাড়ির অক্সিজেন সিলিন্ডার রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছনোর সময়টুকু সাপোর্ট দিতে পারে মাত্র, তার বেশি নয়। আর কেউ যেন এমন ভুল না করে সেই জন্যই এই লেখা। শরীরে অক্সিজেনের স্যাচুরেশন 98 থেকে কমলেই সতর্ক হোন। 95 এ গেলে অবশ্যই হাসপাতলে ভর্তি করার চেষ্টা করুন। নইলে আমার মত প্রিয়জনকে হারাতে হবে। “মা দিবস” তুই বলতি মায়েদের কী কোনদিন হয় পাগলী?
আই সি ইউ, সারা জীবন এই কথাটা আমার কাছে প্রচন্ড দামি হয়ে থাকবে। আমার আর সব সময় আমাকে মনে করিয়ে দেবে, “আমরা কেউ কিচ্ছু না। মৃত্যুর কাছে সবাই ক্ষমতাহীন-শিশু-অক্ষম”।