আমার শিশুবেলা কেটেছে কলকাতার উত্তর শহরতলির এক নিতান্ত মধ্যবিত্ত পাড়ায় — আমার বাবার পৈতৃক বাড়িতে। সে বাড়ির সামনে ছিল বিস্তৃত বাগান। পাঁচিল ঘেঁষে একটা বাতাবি লেবু আর কলকে ফুলের গাছ। আর বারান্দা লাগোয়া রোয়াকের পাশে একটা আতা গাছ আর বাগানের উত্তর কোণে একটা বিশাল নিমগাছ। মা বলত, নিমের হাওয়ায় নাকি রোগজীবাণু পালায়।
সেই বাগানে ছুটির দিনে, এমব্রয়ডারি করা টেপজামা পরে, অবাধ্য চুল ঝাঁকিয়ে পাশের বাড়ির দাসকাকিমার মেয়ে রুমুর সঙ্গে আমি খেলে বেড়াতাম। লুকোচুরি, কুমিরডাঙা, কিত-কিত, আরো কত কি! আর সোম থেকে শুক্কুর, সকালবেলা, সেজেগুজে, টিনের বাক্সে বইখাতা ভরে, রুমুর সঙ্গেই যেতাম পাড়ার প্রাইমারি ইস্কুলে। কোনদিন মা, কখনো কাকিমা পৌঁছে দিয়ে আসত। তখনো কচি ছেলেপুলেকে সাহেব-মেম করার উদগ্র বাসনায়, মোড়ে মোড়ে ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুল গজিয়ে ওঠেনি। আমাদের পাড়ার এক বিদ্যানুরাগী প্রবীণ দম্পতি নিজেদের উদ্যোগে এই ইস্কুলটি তৈরি করেছিলেন। ক্লাস এইট অবধি অনুমোদন ছিল ইস্কুলের। সেই ইস্কুলেরই দরোয়ান ছিল মটুক সিং।
তার নাম সম্ভবত ছিল মুকুট সিং। বাঙালি জিহ্বায় হড়কে গিয়ে এই অপভ্রংশটিই স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। ছাত্রছাত্রী, তাদের বাবা-মা, এমনকি বড়দিমণিকে পর্যন্ত তাকে মটুক সিং নামেই ডাকতে শুনেছি। পশ্চিমা লোক ছিল সে। বাড়ি বোধহয় ছাপরা না দ্বারভাঙ্গা, কোথায় একটা ছিল।
ইস্কুলের গেটের পাশে একটা ছোট টুলে ছিল তার নিত্য অবস্থান। একতলার গ্যারেজের এক কোণে তার চারপাই, উনুন আর লোটার ছোট্ট গেরস্থালি। ছুটি হলে, শেষ ছাত্রটি বেরিয়ে যাওয়ার পরে, গেট বন্ধ করে, বিরাট তালা লাগিয়ে, তবে ছিল তার অবকাশ। কোনো ছুটির দিনে বন্ধ ইস্কুল বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে কতদিন শুনেছি তার দেহাতি ভজন।
এই মটুক সিংকে ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে আমরা ঘোর অপছন্দ করতাম। একে তো তার বিশাল গালপাট্টা দাড়ি আর গঞ্জিকার প্রসাদে ঈষৎ রক্তাভ চোখ শিশুমনে যথেষ্ট ভীতির উদ্রেক করত, তার উপরে, সে ছিল ভারি কড়া। টিফিনের সময় কত লোভনীয় হজমিগুলি, আচার, মশলা-চাটনি আসত গেটের বাইরে। উঁচু ক্লাসের দাদা দিদিরা কিনতও সেসব, গেটের গ্রীলের ফাঁক দিয়ে। কিন্তু, আমাদের সিংদরজার কাছে ঘেঁষতে দিত না মটুক সিং। বলত – বাচ্চেলোগকা উ সব খানা মানা আছে, তফাৎ যাও। আমরা ভয়ে ভয়ে লোভ চেপে সরে পড়তাম।
আমাদের ইস্কুলের সময় ছিল সকাল দশটা থেকে বেলা আড়াইটে পর্যন্ত। মা বা দাসকাকিমাই নিতে আসত আমাদের। একদিন ইস্কুলে গিয়ে শুনলাম, সেদিন হাফ ছুটি। ভীষণ চমকে গেলাম। কারণ, ভুলটা আমারই। আগের দিনই ক্লাসে দিদিমণি বলে দিয়েছিলেন, কি মিটিং হবে ইস্কুল কমিটির — ওসব বড়দের ব্যাপার — আমরা বুঝব না, তবে বাড়িতে বলতে হবে, কারণ, তাঁরা এসে নিয়ে যাবেন ছুটির পরে। বড়দিমণির কড়া নির্দেশ ছিল, প্রাইমারি সেকশনের বাচ্চাদের যেন অভিভাবকদের হাতেই ছাড়া হয়। আমি মাকে বলতে একদম ভুলে গেছি। এদিকে রুমু সেদিন ইস্কুলে আসেনি। দুদিন ধরে ওর জ্বর।
সাড়ে বারোটায় ছুটি হল। সব ছেলেমেয়েদের বাড়ি থেকে কেউ না কেউ চলে এসেছেন। আমার চোখ ফেটে জল আসছে। ফাঁকা ইস্কুলে দু’ঘন্টা ঠায় বসে থাকতে হবে এখন? আচ্ছা, এই তো প্রথম মোড়টা ঘুরলেই নন্দীদের আমবাগান, তার পরেই চাটুজ্জেদের ভাঙা বাড়িকে পিছনে ফেলে আর একটু এগোলেই দত্তকাকুর মুদিখানা আর ভোলা ময়রার মিষ্টির দোকান পেয়ে যাব। তারপর আর একটু হাঁটলেই বেবিবউদিদের বাড়ি। ওখান থেকেই দেখা যায় আমাদের বাড়ির হলদে পাঁচিলের উপর ঝুঁকে থাকা কলকে ফুলের গাছটা — একছুট্টে চলে যাব, পারব না?
কিন্তু ওই হতচ্ছাড়া মটুক সিংয়ের চোখ এড়িয়ে বেরোনো সোজা নয়।
ইস্কুল ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি গেটের একপাশে দাঁড়িয়ে উসখুস করছি। মটুক বোধহয় গ্যারেজ থেকে তালাচাবি আনতে গেছে। এই সুযোগ! গেটের বাইরে সবে পা দিয়েছি, দুই ভদ্রলোকের একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেলাম। অচেনা লোক। তাও কি হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। যেন কতদিনের পরিচিত।
”বাড়ি ফিরবে তো, খুকু?” খুকু আমার ডাকনাম। বঙ্গদেশে ছোট মেয়ে নির্বিশেষে যে ওই সম্বোধন করা হয়, সে বোধ আমার তখনো হয়নি। ভাবলাম, ও মা — এনারা যে আমাকে চেনেন! বাবা বা মায়ের দিকের কোন আত্মীয় হবেন হয়ত। সাগ্রহে বললাম –হ্যাঁ, যাব।
”চলো, আমরা পৌঁছে দিচ্ছি। তোমার বাবা অফিস থেকে ফিরে এসেছেন তো। আমরা ওঁর সঙ্গে একই অফিসে কাজ করি। কাকু হই তোমার। আমাদের আনতে পাঠালেন তোমাকে।”
আমি তখন আহ্লাদে আত্মহারা। বাবা বাড়ি ফিরে এসে থাকলে নিজে না এসে অচেনা লোককে কেন আমাকে আনতে পাঠাবে, বা ইস্কুল যে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে সে খবর পাবেই বা কোথা থেকে, (আমাদের বাড়িতে তখন টেলিফোন ছিল না) — এত তলিয়ে ভাবার বুদ্ধি তখনো হয়নি।
অচেনা কাকুর হাত ধরে সবে বেরিয়েছি গেটের বাইরে, এমন সময় পিছন থেকে হুঙ্কার –”আপ কওন বা?”
মটুক সিং। তার ডেরা থেকে বেরিয়ে এসেছে। হাতে তালাচাবি। চোখে সন্দেহ। কপালে ভ্রূকুটি। ‘কাকু’দের দেখি মুখ শুকিয়ে গেছে। একজন আমতা আমতা করে কি একটা বলার চেষ্টা করল। মটুক সিংয়ের গালপাট্টাওলা মুখ তখন ভয়াবহ ভাব ধারণ করেছে। বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠল সে –”হাত ছোড় বিটিয়া কা–”
আমি কাঁদতে শুরু করেছি হাউমাউ করে। চোখের জলের মধ্যেই দেখতে পেলাম, সামনের মোড়টা ঘুরে হন্তদন্ত হয়ে মা আসছে।
পরিত্রাণের আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম — ”মা!”
লোকদুটো মুখ ফিরিয়ে মাকে এক ঝলক দেখেই আমার হাতটা ছেড়ে দিল। তারপর টেনে দৌড় মারল বাসরাস্তার দিকে। তখনো সমানে চলছে মটুকের হাঁকডাক। ”চোরি কে বাস্তে আতা — তোহার ঘর মে মা বহিন নাহি হ্যায় কা? আরে বিটিয়া কো উঠানে আওত, তোহার লাজশরম নাহি বা?”
মা এসে যেতে আমিও খানিক ধাতস্থ তখন। তারপর আমাকে কিছুটা বকাবকি, সামনের পঞ্চাদের এজমালি বাড়ির এক ভাড়াটের কাছে ইস্কুল ছুটির খবর পেয়ে পড়িমরি করে আসা, সব শেষে মটুকের হাত ধরে ছলছল চোখে মায়ের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। বস্তুত, মটুক সিং না দেখলে আমার ভবিষ্যতে যে কি লেখা থাকত, সেটা ভেবে, বাস্তবজ্ঞান হওয়া ইস্তক, আমার মনটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছে কতবার।
মায়ের কৃতজ্ঞ ধন্যবাদের উত্তরে মটুক বলেছিল, এ তো তার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। আর দেশে তারও ছোট মেয়ে আছে — মা-বাপের চিন্তা সে-ও বোঝে বৈকি! এই যে কতদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে আসে, ফের ইস্কুল ছুটি হলে, তবে যেতে পারবে দেশে, মেয়ের জন্য তার মন কেমন করে না? ফেরার সময়, ”টিশন কা রাস্তা মে, নিম কা পেড় কে নিচে খাড়ে বিটিয়া” যখন টা-টা করে বাপকে বিদায় জানায়, তখন বারবার পিছু ফিরে দেখতে তারও কত মন চায়, সে কথা সে সবিস্তারে মাকে জানাতে লাগল সজল চোখে। সবটা না বুঝলেও মটুক সিংকে আর ততটা ভয়ঙ্কর বাজে লোক মনে হচ্ছিল না আমার।
তারপর, কত কতদিন কেটে গেছে। বাবার চাকরিবদলের সূত্রে আমাদের ঠিকানা বদল হয়েছে। নতুন ইস্কুল, নতুন বন্ধুবান্ধব, নতুন পরিবেশ। তারপর একদিন ইস্কুলের পাট চুকিয়ে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে পড়তে আসা। এসবের মাঝে কবে যেন স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে মটুক সিং।
কিছুদিন আগে আমার ব্লাডব্যাঙ্কের ডিরেক্টর মশাই অনুরোধ করলেন একটি রক্তদান শিবির পরিচালনা করার জন্য। ক্যাম্প শিটে ঠিকানা দেখলাম। আমার ছেলেবেলার পাড়া। স্যারকে বললাম, অবশ্যই যাব।
ব্লাড কালেকশন ভ্যান ছুটেছে বিটি রোড ধরে। ডানলপ ব্রিজ পেরিয়ে গেল। সবিস্ময়ে দেখলাম, ব্রিজের গায়ে অন্য কোনো কোম্পানির বিজ্ঞাপন। ডানলপ নামটুকু অটো আর মিনিবাসগুলোর গায়ে জেগে আছে কেবল। একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাকে মনে রাখেনি বিশ্বায়নের কক্ষপথে ব্যস্ত পায়ে ঘুরতে থাকা মহানগর। সিটে মাথা হেলিয়ে দিই চোখ বন্ধ করে। আমরাই কি শেষ প্রজন্ম, যারা যৌথ আটপৌরে জীবনের ভাঙনকালের শেষ প্রত্যক্ষদর্শী? বর্তমান প্রজন্ম তো গড়ে ওঠারই সাক্ষী হয়নি কোনদিন — ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা বুঝবে কেমন করে?
আমার বাবার পৈতৃক বাড়িটি আর নেই, বিক্রি হয়ে গেছে। বাবা-ই চলে গেছে বছর কুড়ি হলো। প্রতিবেশী কারুর খবর জানিনা। রুমু, আমার বন্ধু রুমু, সে কোথায়, তাও জানিনা। দেখা হলেও চিনতে পারব না সম্ভবত।
গাড়ি ব্রেক কষতে চোখ খুললাম। সামনে স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের ঢল। যত্ন করে তাদের হাত ধরে রাস্তা পার করাচ্ছে একজন খাকি পোশাক পরা মানুষ। গালে গালপাট্টা। মুখে হাসি।
মনের অতল থেকে বুড়বুড়ি কেটে যেন ডুবসাঁতার দিয়ে উঠে এল একটা নাম। সহকর্মীদের হতচকিত করে হুড়মুড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলাম আমি। স্থানকালপাত্র ভুলে চিৎকার করে উঠলাম –”মটুক সিং!”
অবাক বিস্ময়ে ঘাড় ফেরাল অচেনা মানুষটি। আমার আচরণের অর্থ বোঝার চেষ্টা করল যেন। আমিও সম্বিত ফিরে পেয়েছি ততক্ষণে। কি করে এমন ভুল হলো? কি করে ভুলে গেলাম, মাঝখানে কেটে গেছে প্রায় চল্লিশটা বছর। আমার সেই ছেলেবেলার ইস্কুলটা উঠে গেছে কবে! ভাঙনকাল!
ঈষৎ লজ্জিত পায়ে গাড়িতে এসে উঠলাম। জায়গায় বসে পিছু ফিরে তাকালাম। দেখলাম, সেই অজানা ইস্কুলের অপরিচিত দারোয়ানজি তখনো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমি যেন দেখতে পেলাম এক বাবাকে। স্টেশনের রাস্তার একপাশে ঝাঁকড়া নিমগাছের নিচে দাঁড়ানো পাঁচবছরের কন্যাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে —
Sad to say, I’m on my way
Won’t be back for many a day
My heart is down
My head is turning around
I had to leave a little girl in Kingston town….
বেলাফন্টের গানের কলি আর আমার চোখের জল একাকার হয়ে গেল বাদলা হাওয়ায়। আমার ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠল নীরব প্রার্থনায় –”যেখানেই থাকো, ভাল থেকো, ভাল থেকো, মটুক সিং।”