ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ।ক্যানো জানি না, প্রকৃতিরাণীর কোন অপরূপ লীলায় এ’বছর জব্বর শীত পড়ে গেছে। সেদিন সন্ধেবেলায় চেম্বারে বসে আছি। শুনশান। খোলা জানালা দিয়ে হাড় কাঁপানো হাওয়া আসছে। দাঁতে দাঁতে ঠকঠক করে আমার পিসিমাকে ডাকলাম। “পিসিমা ও পিসিমা”
পিসিমা মহা বিরক্তিতে কানের থেকে খোল লাগা ইয়ার ফোন বার করে’ এসে জিগ্গেস করলো “এই মাত্র তো এলেন, এক্ষুণি আবার কি চাই?”
বুঝতেই পারছি, এই ঠান্ডায় চা চাইলে পিসিমা চ্যাঁচাবেন। সুতরাং বললাম “পেশেন্ট পাঠা”
মুখ বেঁকিয়ে উত্তর দিলো “কোথায় পাবো?”
বলতে বলতেই দেখি দুয়োর প্রান্তে এক দীর্ঘাঙ্গী মহিলা আর তাঁর গাট্টুম কন্যা উঁকি দিচ্ছেন। মহিলা একবার ডায়েরিয়া নিয়ে ভর্তি ছিলেন। হিমোগ্লোবিন তিন দশমিক নয়। সিস্টার হিমশিম। কিন্তু আমার মনটা কেমন যেন খুঁৎখুঁৎ করছিলো, ঐ যে ফেলু বলেছিলো মিলছে না রে তোপসে-ঐ রকম আরকি। ল্যাবরেটরি খুলে খাতা আনিয়ে দেখি, খাতায় লেখা নয় দশমিক তিন। টাইপো মিষ্টেক!
সে যাই হোক গে। বিষয় হলো-গাট্টুম পাহাড়ে যাচ্ছে (জীবনে প্রথম) এবং প্রায় ষোলো হাজার ফিট উচ্চতায়। মায়ের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে- মেয়ে রেললাইনে গলা দিতে যাচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার নিতে হবে কিনা, ইয়েতির চামড়ার জামা লাগবে কিনা-বিবিধ ভারতীর আমিন সাইনির মতো প্রশ্নবাণ।! ইতিমধ্যে বিন বুলাকে চা হাজির। গরম চায়ে ঠোঁট ঠেকিয়ে বললাম “আমি মেয়েকে যেতে বারণ করবো না। তবে আসুন,একটু এই বিষয়ে আলোচনা করি। তাইলে প্রথমে মাউন্টেন সিকনেস সম্বন্ধে দুটো কথা হোক।”
“হ্যাঁ দাদু, একটু গুছিয়ে বলোতো। বাবা তিনদিন দোকানে যায়নি।খাচ্ছে না। আর মায়ের বোধহয় হার্ট অ্যাটাক হবে বলে’ মনে হচ্ছে”
“তাহলে কান খুল করে’ শুনলো। অল্টিচিউড সিকনেস বা মাউন্টেন সিকনেস হওয়ার জন্য প্রথম কারণটা হলো ল্যাটিচিউড। নিরক্ষ রেখা থেকে যতটা দূরে যাবি, মাউন্টেন সিকনেসের সম্ভাবনা ততই বাড়বে।bকেননা নিরক্ষ রেখার কাছে বায়ুর চাপ (এয়ার প্রেসার) অনেক বেশী। এখানে বায়ুচাপ প্রায় সাতশো ষাঠ মিলিমিটার অফ মার্কারি। সেখানে দক্ষিণ মেরুর উচ্চতা ন হাজার তিনশো ফিট। অথচ ওখানে সমুদ্র সমতলে বায়ুচাপ অনেক কম (ছ’শো পঞ্চাশ মিলিমিটার অফ মার্কারি)। যেহেতু চ্যাপ্টা নিরক্ষীয় অঞ্চলে মাধ্যাকর্ষণ বেশী তাই এখানকার পাহাড়ের ওপরও বায়ুচাপ বেশী। অর্থাৎ মাউন্ট এভারেস্টের থেকে আল্পস বা আন্ডিজে মাউন্টেন সিকনেসের সম্ভাবনা (বাস্তবেও) বেশী”
“কিছুই মাথায় ঢুকলো না।.….তাহলে অক্সিজেন? অক্সিজেন কম কেন?” দীর্ঘাঙ্গীর প্রশ্ন।
আমি পাল্টা প্রশ্ন করি “কে বলেছেন কম?”
“বলেনি? কেউ বলেনি? কিন্তু সবাই তো বলে!”
আমি নাতিশীতোষ্ণ চায়ে চুমুক দিই “গোটা পৃথিবীর সব জায়গার বাতাসে অক্সিজেন থাকে মোটামুটি একুশ শতাংশ। এভারেস্টের চূড়ায় বা সমুদ্র সমতলে,সব জায়গাতেই”
আমার মুখে পরিতৃপ্তির হাসি, যেন পাতে পড়েছে খাসির মাংস বাসি। দীর্ঘাঙ্গীর মুখখানি বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছে দেখে আমি আবার খেই ধরলাম।”যেহেতু বাতাসের চাপ কম, তাই বয়েলের সূত্র অনুযায়ী বাতাসের প্রতি একক আয়তনে, অক্সিজেনের পরমাণু কম আছে। কম চাপে সেটা ছড়িয়ে গেছে।bসুতরাং নিঃশ্বাসের সঙ্গে প্রতিবার কম অক্সিজেন ঢুকছে”
“তাহলে ব্যাপারটা কি হয়?”
“বাতাসে পার ভল্যুম এরিয়া অক্সিজেন কম বলে রক্তে অক্সিজেন কমে আসে। আবার কম বায়ুচাপ অথচ ভেতরের অঙ্গের চাপ বেশী, তাই ভেতরের অঙ্গ ফুলে ওঠে (জলে কিসমিস এফেক্ট)। দুয়ে মিলে সেরিব্রাল ইডিমা আর পালমোনারি ইডিমা হবে।”
মা মেয়ে দুজনেই হাঁ।
“এটা অল্প হলে অ্যাক্যুট মাউন্টেন সিকনেস, এরপর হাই অল্টিচিউড সিকনেস- হাই অল্টিচিউড পালমোনারি ইডিমা (HAPE) এবং হাই অল্টিচিউড সেরিব্রাল ইডিমা (HACE)”
“এগুলো কি করে বুঝবো?”
“কিসে কি হয় বোঝার দরকার নেই। আমরা লক্ষণগুলো জানার চেষ্টা করি, কেমন?
প্রথমতঃ মাথায় ব্যথা হবে, ক্ষিধে কমে যাবে, ঘুম কমে যাবে, বমি পাবে, তার পরের অবস্থায় শ্বাসকষ্ট হবে, প্যালপিটেশন হবে, অক্সিজেন কমবে, অসম্ভব দুর্বল লাগবে আর সেরিব্রাল ইডিমা হলে ভাবনাচিন্তা উল্টাপাল্টা হবে, ক্রমশঃ আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে এবং অবশেষে কোমায় চলে যাবে। মাথায় ব্যথা শুরু হলেই ওপরের দিকে ওঠা বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে দুদিন ঐ জায়গায় দুদিন থেকে, ঠিক হলে পরে এগোতে হবে। না কমলে ফিরে আসতে হবে। আসলে ফিরে আসাটাই আসল চিকিৎসা।”
“এটা যাতে না হয় সেটার জন্য কি করা যাবে?”এটা দীর্ঘাঙ্গীর প্রশ্ন।
“প্রথমে আট হাজার ফিট উঠলে একদিন বিশ্রাম নিয়ে, এগোতে হবে। এবং দিনে এক হাজার ফিটের বেশী ওঠা উচিত নয়। এটা একেবারে থিয়োরিটিক্যাল কথা। অর্থাৎ একদিনে বেশী এবং তাড়াতাড়ি ওঠা উচিত নয়। যেহেতু শুকনো আবহাওয়ায় নিঃশ্বাসে সঙ্গে প্রচুর জল বেরিয়ে যায়। এটাকে ইনসেন্সিবল ওয়াটার লস বলে। প্রতিদিনই,এই সমতলেও,আমাদের শরীর থেকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে প্রায় আধ লিটার জল বেরিয়ে যায়। বেশী জল খেলে পাহাড়ে কষ্ট কম হয়”
“হলে কি চিকিৎসা করবো?”
“হলে ফিরে আসাই সেরা চিকিৎসা। তবে পালমোনারি ইডিমা বা সেরিব্রাল ইডিমা হলে স্টেরয়েড তাৎক্ষণিকভাবে আরাম দেয়।এছাড়া সেরিব্রাল ইডিমা হলে অ্যাসিটাজোলামাইড (কার্বনিক অ্যানাহাইড্রেজ ইনহিবিটার) ব্যবহার করে উপকার হয়। তবে মাউন্টেন সিকনেস অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে।তাই ফিরে আসাটাই চিকিৎসা।”
গাট্টুম মেয়েটা খুশি মনে ফিরে গেল আর আশাহতা দীর্ঘাঙ্গী ব্যাজার মুখে ফেরার পথ ধরলো।
আমি বেজায় খুশি হয়ে একটা কবিতা লিখে ফেললাম।
“নিক্টিনিটিং, নিক্টনিটিং
রেলের গাড়ি
টিটিং, টিটিং।
খড়খড়াখড় উড়িয়ে ধুলো
চাক্কা তুলে উল্টে শুলো।
কাউকে বুঝি ধাক্কা দিলো?”