বিভিন্ন সংবাদপত্রে, টিভিতে ডি.এ.-এর জন্য আন্দোলন করা বা ধর্নায় বসা বিভিন্ন লোকেদের মধ্যে অনেক বয়স্ক মানুষদের দেখে আমার মাঝে মাঝে অবাক লাগত। এইসব মানুষ যাঁরা প্রায় জীবনের প্রান্তে উপস্থিত হয়েছেন, যাঁদের জীবনে রোগ-ব্যাধি, সাংসারিক অসামঞ্জস্য প্রধান সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাঁরা কিসের তাড়নায় ডি.এ.-এর জন্য আন্দোলন চালাচ্ছেন? শুধু কিছু টাকা পেনশন বেশি পাবেন বলে, নাকি এঁদের অন্য কিছুর তাড়না আছে?
আমাদের সমাজের একটা বিশেষ দিক হল আমরা বয়স্ক মানুষদের বেশি পাত্তা দিই না। তাঁদের মতামতের অধিকার নেই, প্রেমের অধিকার নেই, নিজের মত করে বাঁচার অধিকার নেই, আন্দোলন করার অধিকার তো সেখানে অনেক দূরের ব্যাপার। আমরা এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তাই বিরানব্বই বছরের ওয়ারেন বাফেট যখন জনসমক্ষে বলেন তাঁর কোনো রিটায়ারমেন্ট নেই- আমরা তাঁকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিই, অথচ সত্তর-আশি বয়সের আমাদের বাবা-জেঠুরা যখন সকালে দুধ-মুড়ি খেয়ে নিজেদের বঞ্চিত করা পাওনা আদায়ের জন্য ডি.এ.-এর আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য মফঃস্বল থেকে সকালের ট্রেনে কলকাতা যান- আমরা তাকে বুড়ো বয়সের ভীমরতি বলে হাসাহাসি করি। আমারও মনে হয়। আমার কাছে তো এত বয়স্ক লোকেরা আসেন তাঁদের রোগজ্বালা নিয়ে কিন্তু তবু আমি তাঁদের প্রতি বাড়তি সহানুভূতিশীল হতে পারি না।
কী ধরনের মানুষেরা আন্দোলন করেন? তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট কেমন হয়? খুব সাধারণভাবে মনে হয় তাঁরা খুব বাক্যপটু, রাগি এবং প্রতিবাদী। তাঁদের এই বৈশিষ্টগুলো বাইরের থেকেই প্রতিভাত হয়। কিন্তু সব সময় এমনটা হয় না। অনেক জেদি প্রতিবাদী মানুষকে আপনি বাইরের থেকে দেখে বুঝতেও পারবেন না তাঁর ভেতরে কী আগুন জ্বলছে। আমি তো এতদিন ওই বয়স্ক রুগিটিকে দেখে কখনও বুঝতেও পারি নি উনি এতটা প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারেন অন্তত এই বয়সে।
যাঁরা মার্কেজের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউড’ পড়েছেন তাঁরা সকলে কলোনেল অরিলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কথা জানেন। চরিত্রটি আমার খুব প্রিয়। খুব কম কথা বলা শান্ত এক যুবক যিনি সারাদিন বাবার পরীক্ষাগারে বসে একমনে সোনার ছোট ছোট মাছ তৈরি করতেন, তিনি একদিন হঠাৎ করে মকন্দ গ্রামের কয়েকজন যুবককে নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গেরিলা আন্দোলনের পথে পা বাড়ালেন। পরবর্তী কুড়ি বছর তিনি এক নিষ্ঠুর, কঠোর সেনানায়ক হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর নিরলস লড়াই চালিয়ে যান। সতেরজন বিভিন্ন নারীর গর্ভে তাঁর সতেরটি ছেলে হয়। সরকার একই দিনে সতের জনকেই গুমখুন করে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছেলেটি তখন পঁয়ত্রিশও পার করে নি। যে কয়টি বিপ্লব তিনি করেছিলেন সব কয়টি ব্যর্থ হয়েছিল। সরকার তাঁকে পেনশন দিতে চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। শেষে যখন প্রায় তাঁর মরণকাল আসন্ন তখন সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে যুদ্ধ শুরু করার অভিপ্রায়ে তাঁর বহুদিনের সঙ্গী এক জেনারেলের কাছে যান। তখন তিনি পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। জেনারেল হেসে বলেন, ‘কলোনেল, আজকে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সত্যিই তোমার বয়স হয়ে গেছে’।
এমনই যে মানুষটা প্রতিবাদী, তিনি সারাজীবন প্রতিবাদী। বাইরে থেকে দেখে সবসময় তাঁকে বোঝার উপায় নেই।
উনি রিটায়ার করেছেন আঠারো বছর আগে। অর্থাৎ প্রায় আমি যখন থেকে প্রথম প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করি তখন থেকে। তখন থেকেই তাঁর বাড়ির লোকেরা আমাকে দেখাতেন। তার স্ত্রী ছেলে মেয়ে জামাই সবাই। লিভারে সিরোসিস হয়ে হঠাৎই তাঁর স্ত্রী একদিন মারা যান। তারপর থেকে তিনি ছেলে বউয়ের সাথে থাকেন। কানে খুব কম শোনেন। এখন প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কথা বলতে হয়। সেদিন সকাল বেলায় ফোন করলেন।- ডাক্তারবাবু আপনি কী আজ বসবেন? আমার জামাইকে পাঠাব নাম লেখার জন্য।
সকালে দেখাতে এলেন। বয়স প্রায় আশি। কথা চিরকালই খুব আস্তে বলেন। এখন বার্ধক্যের ভয়ে কিছুটা আক্রান্ত। সবসময় একটা আশঙ্কায় ভোগেন। অথচ বেশি ওষুধ খেতে চান না। কখনও কখনও প্রেসারের ওষুধ নিজে থেকেই বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রস্টেটের ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছেন। হোমিওপ্যাথি করেন। একটা মিশ্র সিস্টেমের মধ্যে চলেন।
– কী হয়েছে দাদা?
– শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। কয়েকদিন খুব পরিশ্রম গেছে।
– কেন কী হয়েছে?
– জানেন তো মুক্তমঞ্চে ডি.এ.-এর জন্য আমাদের আন্দোলন চলছে। টিভিতে, কাগজে নিশ্চই দেখছেন। কলকাতায় এই গরমে কয়েকদিন মিছিল করেছি। অনেক্ষণ ধরে ধর্নামঞ্চে বসে ছিলাম। এতেই মনে হয় গরম লেগে গেছে।
– আপনি এই বয়সে আন্দোলন করছেন?
– কত না করা হয়েছে ডাক্তারবাবু, উনি কিছুতেই শুনবেন না। পাশে বসা তাঁর জামাই বললেন। তাঁর গলার স্বরও খুবই নিচু।
– আন্দোলন করব না, কী বলেন? আন্দোলন না করলে এরা টাকা দেবে? এরা যখন ক্ষমতায় আসে তার আগে বলেছিল যে সরকার ডি.এ. দিতে পারে না তার ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। অথচ আজ এরা ডি.এ. না দেবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এখন মামলা সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে গেছে। এদের অনেক লম্বা হাত। মামলা সরিয়ে নিয়ে গিয়ে এরা সাধারণ মানুষের অধিকার আরো খর্ব করবে।
– আপনারা কোনো রাজনৈতিক দলের ছাতার নীচে আছেন?
– না, আমরা কোনো দলেরই না। আজ বিজেপি বলছে ওরা ক্ষমতায় এলে নাকি ডি.এ. দেবে। আমরা জানি এসব ভাঁওতা। এরা যা করেছে ওরাও তাই করবে। আমি আজ থেকে আন্দোলনের সাথে যুক্ত নই ডাক্তারবাবু। নাইন্টিন সিক্সটি এইট কি নাইনে যখন সরকারি কর্মচারিদের বেতন অনেক কম ছিল তখনও আমরা বেতন বাড়াবার জন্য আন্দোলন করেছি। আমার সার্ভিস ব্রেক হয়ে গেছিল কয়েক হপ্তার জন্য। সরকারি চাকরিতে সার্ভিস ব্রেক মানে বুঝতে পারছেন? রিটায়ারমেন্টের সময় পেনশনের জন্য হয়রান হতে হয়েছিল।
– আপনার কি মনে হয় আন্দোলন করে কিছু হবে?
– মনে হয় কিছু হবে না কিন্তু আন্দোলন করা ছাড়া তো আমাদের কিছু করারও নেই।
ভদ্রলোকের মেয়ে ও জামাই দুজনেই সরকারি চাকরি করেন। তাঁরা কী তাদের বাবার মত ডি.এ. এর জন্য আন্দোলনে যাচ্ছেন? মনে তো হয় না।
আমি তো নিজেও সরকারি চাকরি করি। অথচ সত্যি করে বললে আমি কখনো ডি.এ. নিয়ে ভাবিই নি। আমি কত টাকা ডি.এ. পাই ছেড়ে দিন কত টাকা মাইনে পাই আমাকে ‘পে স্লিপ’ দেখে বলতে হবে। আপনারা বলতেই পারেন, ‘আমাদের তো আপনার মত চাকরির বাইরে রোজগার নেই।’ একদমই তাই। সেই কারণেই আমার ডি.এ. নিয়ে উৎসাহ নেই। আর যে আন্দোলনের প্রতি সরকার ছেড়ে দিন সাধারণ মানুষ যাঁরা সরকারি চাকরি করেন না তাঁদেরও কোনো সহানুভূতি নেই, আমি সেই আন্দোলনে তেমন জোর দেখতে পাই না। সরকার বাহাদুর যখন জানেন যারা ডি.এ.-এর জন্য লড়াই করছে তারা ভোটব্যাঙ্কের খুব খুব সামান্য একটা অংশ- তখন যেনতেনভাবে তাকে দাবিয়ে দিতে সরকারের কোনো অসুবিধেই হবার কথা নয়। হচ্ছেও তাই।
এই বয়স্ক মানুষেরা যে লড়াইটা চালাচ্ছেন অন্যদের সাথে কারো কারো তাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিশ্চই আছে কিন্তু এনাদের তো নেই। হতে পারে ডি.এ.-এর মিছিলে গিয়ে এই রোদে কারো সান স্ট্রোক হয়ে গেলো। কেউ লাঠির আঘাত পেলো। কারো অ্যাকসিডেন্ট হলো। তাতে কারোরই কিছু যায় আসবে না। একদিন খবরে দেখাবে, কাগজে উঠবে তারপর সবাই ভুলে যাবে।
আবার এও তো হতে পারে ওনারা সফল হলেন সরকার ডি.এ. দিতে রাজি হল- তখন আমার মত লোক যারা মানসিকভাবে পর্যন্ত এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত নেই তার মাইনেতেও বাড়তি টাকা ঢুকবে। তখন তারা মনেও রাখবে না কাদের আন্দোলনের মাধ্যমে এই সাফল্য এল।
পৃথিবীতে আন্দোলনকারীরা চিরকালই একা। তাদের লড়াই কেবল আদর্শের সাথে। বলিভিয়ার যে লোকটি সি.আই.এ-এর কাছে চে গেভারাকে ধরিয়ে দিয়েছিল তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘আপনি ওনাকে ধরিয়ে দিলেন কেন? উনি তো আপনাদের কথা ভেবেই লড়াই চালাচ্ছেন’। তখন সেই লোকটি বলেন, চের সঙ্গীদের বন্দুকের গুলির আওয়াজে নাকি তার মেষগুলো খুব ভয় পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল তাই সে তাকে ধরিয়ে দ্যায়।
আন্দোলনকারীদের আদর্শ আর তাঁরা যাদের জন্য লড়াই করেন তাদের নিস্পৃহতা চিরকালই অবাস্তব এক সত্য।
দেখলাম ওনার তেমন কিছুই হয় নি। প্রেসার ঠিকই আছে। গরমে গায়ে কিছু গোটা বের হয়েছে। মাথা ঘোরাচ্ছে। তার জন্য কিছু ওষুধ দিলাম। বললাম প্রেসারের ওষুধটা যেন নিয়ম করে চালান।
তাঁকে বলতে পারলাম না, আর এভাবে গরমে যাবেন না। আমি জানি আমি কেন কেউ না করলেও উনি শুনবেন না। একটু সুস্থ হলেই আবার মুক্তমঞ্চের দিকে পা বাড়াবেন।