প্রিন্সিপ্যালের রুমের কাঁচ ঢাকা বড় টেবিলটার উল্টোদিকে রাখা কালো ভারী টেলিফোনটা বেজে উঠল। ষ্টুডেন্টস ইউনিয়নের সেক্রেটারি পরিতোষ রিসিভারটা তুলে ডাঃ অমিতাভ বোসের হাতে সেটা এগিয়ে দিল। ‘স্যার আপনার টেলিফোন।’
ডাঃ বোস রিসিভারটা কানে নিয়ে অপর প্রান্তের কথাগুলো শুনলেন।
‘না না, আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এরা তো সবাই আমার ছাত্র।’
‘….’
‘আলোচনা চলছে। তাড়াতাড়ি মিটে যাবে মনে হয়।’
‘….’
‘না না, মাথা খারাপ নাকি! ক্যাম্পাসে পুলিশ পাঠাতে হবে না। সিচুয়েশন কন্ট্রোলেই আছে। ধন্যবাদ।’
রিসিভারটা রেখে দিয়ে উল্টোদিকের চেয়ারগুলোতে বসা ও তাদের পিছনে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘থানা থেকে ফোন করেছিল। ওদের বোধহয় কাজকর্ম এখন কম। মেডিক্যাল কলেজে সামান্য ব্যাপারেও নাক গলানোর ইচ্ছে।’
আজ সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেই স্ত্রী স্বাতী-র কাছ থেকে খবরটা পেয়েছিলেন ডাঃ বোস। ছাত্ররা ফী বৃদ্ধি নিয়ে ডেমনস্ট্রেশন দিতে আসবে। সত্তর দশকের দুশো টাকা ফী যে নব্বইয়ের দশকে চলে না, সেটা তিনিও বোঝেন। পঞ্চাশ শতাংশ বাড়াতো, ঠিক ছিল। কোনো সমস্যা হত না। তা না করে একেবারে ষোলশো টাকা! কারা যে এইসব সিদ্ধান্ত নেয় কে জানে! কত নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়ে। তাদের কথা এরা ভাবেও না।
তিনি প্রিন্সিপ্যাল হয়েছেন দু-মাস। তার আগে প্যাথোলজির হেড ছিলেন। স্বাতী ফার্মাকোলজির প্রফেসর। দুজনেই কলেজ অন্ত প্রাণ।
সকাল আটটায় ক্লাস নেওয়ার ছিল। প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব নেওয়ার পরেও ব্যস্ততা সামলে সপ্তাহে চারটে করে ক্লাস নেন অমিতাভ বোস। পড়াতে ভালো লাগে যে তাঁর!
ক্লাস শেষ করে অফিসে ঢুকতেই অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ অফিসার জামাল আবেদিনের ফোন। ষ্টুডেন্টস ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি পরিতোষ মাইতি দেখা করতে চায়। পরিতোষ ঠান্ডা মাথার ভদ্র ছেলে। অ্যানাটমি-র প্রসেক্টর ছিল। প্যাথোলজির অনার্সটা এবার একটুর জন্য মিস করেছে। ডাঃ বোস ওদেরকে আসতে দিতে বললেন।
উনি ভেবেছিলেন স্মারকলিপি-টিপি দেবে হয়ত। তা না করে ওরা যে একেবারে অবস্থানে বসে পড়বে সেটা বুঝতে পারেননি। একটু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। দুপুরের পরে শোনা গেল অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজেও একই অবস্থা। তার মানে এরা প্ল্যান করেই নেমেছে।
সন্ধ্যায় রাইটার্স থেকে ফোন এল। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। তাঁকে আশ্বস্ত করে বলা হল আলোচনা চলছে। শিগগিরই ব্যাপারটা মিটে যাবে।
ডাঃ বোস মোটেই দুশ্চিন্তায় নেই। এরা সবাই তাঁরই ছাত্রছাত্রী। সকলেই বুদ্ধিমান, যুক্তি মানে। এরা বোঝে যে একটা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে ষ্টুডেন্টস ফী বৃদ্ধির ব্যাপারে তাঁর একার কিছু করার নেই। বিষয়টা কিছুটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, বাকীটা সরকার সিদ্ধান্ত নেয়।
শুধু কয়েকটা ব্যক্তিগত অসুবিধা রয়েছে। তিনি বাড়ি থেকে বিশেষ কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই এসেছেন। অন্য দিনগুলোর মত।
বিকেল পাঁচটা বেজে গেল। আজ আর কোনো ফয়সালা হবে বলে মনে হচ্ছে না। সারারাত এভাবে ঘেরাও হয়ে অফিসেই থাকতে হবে বোধহয়। অথচ জামাকাপড়, টুথব্রাশ, ওষুধবিষুধ- কিছুই সঙ্গে নেই।
স্বাতী ফোন করেছিল। ইউনিয়নের কালচারাল সেক্রেটারি নবনীতা ফোন ধরে বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। আপনি স্যারের সব জিনিস আর ওষুধপত্র পাঠিয়ে দিন।’
‘উনি কিন্তু ডায়াবেটিক। ইনসুলিন নেন। খেয়াল রেখো।’
‘হ্যাঁ ম্যাডাম, মেডিসিনের মৌলিক স্যার দেখে গেছেন। এখন সব ঠিক আছে। আমরা ইনসুলিন দিয়ে দেব। হাউসষ্টাফরাও আছে এখানে।’
স্বাতী বাড়ির ড্রাইভার সন্তুর হাতে ব্যাগপত্তর পাঠিয়ে দিল।
আগামী পরশু থেকে কন্যা অতসীর ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। অঙ্কটা তিনিই দেখেন। এবারে কি হবে?
রাত ন’টায় অতসীর ফোন এল। ‘বাবা, দুটো অঙ্ক একটু বলে দেবে? পারছি না।’ মেয়ের কাঁদোকাঁদো গলা।
সব শুনে এস এফ আই-এর পঙ্কজের হাতে ফোনটা দিয়ে দিল পরিতোষ। ‘ও অঙ্কটা ভালো পারে স্যার। টিউশনি পড়ায়। ইলেভেনের অঙ্ক ও হেল্প করে দেবে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’
আধঘন্টা ফোনেই অঙ্কের টিউশনি চলল। তাতে অতসী খুব খুশী। সে টুকটাক কথা বলে তারপর ‘গুডনাইট বাবা।’ বলে ফোনটা রেখে দিল।
‘পঙ্কজ, তুমি তো সরকারি দলের লোক। তুমি এখানে কি করছ?’
‘অন্য সময় ঝগড়াঝাঁটি করি ঠিকই। কিন্তু, এই ইস্যুটা স্যার সবার। এখানে সব দলের ছেলেমেয়েরাই আছে। এত টাকা বাড়লে সবারই গায়ে লাগবে।’ পঙ্কজ বলল।
ডিএসএ-র চন্দন হেমব্রম হাসতে হাসতে বলল, ‘স্যার, ওকে আজ সকালেই ওদের জেলা কমিটি থেকে সাসপেন্ড করে দিয়েছে।’
অমিতাভ-র খুব ঘুম পাচ্ছিল। এক গ্লাস জল খেয়ে তিনি পাশে রাখা ইজিচেয়ারটাতে হেলান দিয়ে বসলেন।
‘আপনার ডিনার এসে গেছে স্যার। খেয়ে নিন।’
সন্তু টিফিন ক্যারিয়ারটা রাখল টেবিলের উপরে।
বাড়ির খাবার খেতে খেতে অমিতাভ ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা খাবে না?’
‘আমরা পালা করে ক্যান্টিনে আর মেসে গিয়ে খেয়ে নেব স্যার।’
পরদিন সকাল। সমাধানসূত্র কিছুই বেরোয় নি। অবস্থানরত ছাত্রছাত্রীরা চাদর পেতে মেঝেতে শুয়েই ঘুমোচ্ছিল তখনো। ওদের দেখে খুব মায়া হল অমিতাভর।
ইন্টার্নরাও নাকি ছাত্রছাত্রীদের সমর্থনে আজ থেকে স্ট্রাইক করবে। অন্য একটা কলেজে বিক্ষিপ্ত গন্ডগোলের খবর পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য প্রশাসন এইবার নড়েচড়ে বসবে মনে হয়।
বিকেল পাঁচটায় সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডাঃ সুকুমার গাঙ্গুলী এলেন। হাসপাতালের ওয়ার্ডের পরিস্থিতি ভালো না। মেডিক্যাল অফিসাররা কাজ চালাচ্ছে। ডিসি সেন্ট্রাল পরিমল সিংহ প্লেন ড্রেসে এসে ঘুরে গেছেন এর মধ্যেই। ডিসি সেন্ট্রাল-এর সাথে ছাত্র প্রতিনিধিদের উত্তপ্ত কথাবার্তা শুরু হতেই হস্তক্ষেপ করেছেন ডাঃ বোস।
‘ওরা ভালো ছেলেমেয়ে। ভবিষ্যতের ডাক্তার। একটু ধৈর্য্য ধরুন। আলোচনাতেই সমস্যা মিটে যাবে।’
স্বাতী এসেছিল। ওঁর স্বাস্থ্য নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন সে। যদিও ব্লাড সুগার, ক্রিয়েটিনিন, ইসিজি – সব করানো হয়েছে। সবই নর্ম্যাল। মেডিসিনের প্রফেসর ডাঃ বরুণ মৌলিক আজও নিজে এসে দেখে গেছেন। অফিসে বসে বাড়ির রুটি, তরকারী, মাছের ঝোল খাচ্ছেন ডাঃ বোস। কিন্তু বাড়ি ফিরতে পারছেন না। যতক্ষণ এই সমস্যার সমাধান না হচ্ছে পারবেনও না।
দ্বিতীয় রাত শেষ হয়ে তৃতীয় দিন। সব ক’টা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় মেডিক্যালের ছাত্র আন্দোলনের খবর। যেরকম হয়, আটগুণ ফী বৃদ্ধি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। শুধু হাসপাতালের পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে- এই খবর।
বিকেল তিনটে অবধি এরকমই অচলাবস্থা চলল। তারপর প্রথমে একটা ফোন এল রাইটার্স থেকে। এরপর একটার পর একটা ফোন। অবস্থানরত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও গুঞ্জন- ষ্টুডেন্ট ফী বৃদ্ধি আপাততঃ স্থগিত রাখা হয়েছে।
ওরা বিজয়ীর মত স্যারের ব্যাগটা মাথায় নিয়ে প্রায় মিছিল করে স্যারকে তাঁর গাড়িতে পৌঁছে দিল। সঙ্গে ক্যান্টিন থেকে এক ঠোঙা সিঙাড়া।
ওদের স্যার আন্দোলনের মধ্যে অফিস ছেড়ে পালিয়ে যাননি যে!