এত মনোযোগ দিয়ে অনেকদিন রাস্তায় হাঁটিনি। পেছন থেকে লাল্টুদা বলল, সবাই মিলে একটা ছবি তুললে হয়। বেশ ছোটো বেলার মধ্যমগ্রামের একটা ফিলিংস আসছে। রাস্তার কাউকে বল। তুলে দেবে।
বললাম, কী করে তুলবে? সবার হাতেই তো চটি। চটি হাতে ছবি তুলবে কীভাবে?
সঞ্জীবদা পড়তে পড়তে কোনরকমে বাঁচল। খাল ধারের একটা কচা গাছ ধরে টাল সামলাল। দেখে আমরা সকলেই হতাশ হলাম। আজকের বিকালটা স্মরণীয় করে রাখতে কারো পড়া দরকার। খুবই দরকার। কিন্তু কেউ পঙ্কিল হতে রাজি নয়।
আমরা চলেছি নোয়াই খালের পাশ দিয়ে কোঁড়ার বিবেকানন্দ আশ্রমে। সেখানে বিকাল চারটে থেকে একটি স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির করার কথা। চারটে বেজে গেছে অনেকক্ষণ। এখনও পৌঁছাতে পারিনি।
পাশের দরমার ঘর থেকে এক মহিলা বললেন, দেখে যান ডাক্তারবাবু, আমরা কী পরিস্থিতিতে থাকি। বৃষ্টি হলেই এক হাঁটু কাদা। কিছু একটা আপনারা মিলে করেন।
পার্থ বলল, ডাক্তারবাবু কী করবে অ্যাঁ? ডাক্তারবাবু কী পুরসভার চেয়ারম্যান?
মহিলা বললেন, চেয়ারম্যানকে কোথায় পাব? ডাক্তারবাবুকে পাওয়া যায়। অন্তরের দুখের কথা কয়ে ফেলিছি। কিছু মনে করেন না।
ডিউক হাফপ্যান্ট পরে এসেছে। পোশাকের দিক থেকে আমাদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। ও এবার পা হড়কাল। বলল, বাপরে , ট্রেকিং ফ্রেকিং ফেল।
এর মধ্যেই ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। সোমনাথ কাকুকে আশে পাশে দেখা যাচ্ছে না। ভদ্রলোক কোথায় গেলেন কে জানে। পরোপকার করার নেশা যে সবচেয়ে মারাত্মক ও বিপদজনক নেশা ভদ্রলোক আজ হাড়ে হাড়ে টের পাবেন।
প্রণবদা সবার পেছনে রয়েছে। চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম, সোমনাথ কাকুকে দেখা যায়?
প্রণবদা বলল, না তো। কাকু মনে হচ্ছে ফিরে গেছেন। নয় খালে পড়ে গেছেন।
ফিরে আর যাবেন কোথায়। বাইক নিয়ে যে জায়গায় ঢুকে এসেছি সেখান থেকে একা একা ফেরার ঝুঁকি দুঃসাহসী অভিযাত্রী ছাড়া আর কেউ নেবে না। তার থেকে খালে পড়ে যাওয়াটা বেটার অপশন।
সঞ্জীবদা আবার হড়কে খালের ঢালের দিকে কিছুটা নেমে গেল। একটা গাছ ধরে সামলালো। তারপর বলল, এভাবে হবে না। দাঁড়া।
বললাম, দাঁড়ানো যাবে না। দাঁড়ালে পা কাদায় ঢুকে যাচ্ছে। বের করা মুশকিল।
সঞ্জীবদা বলল, এ রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না। খাল দিয়ে যেতে হবে।
প্রণবদা বলল, খাল দিয়ে কীভাবে যাবে? সাঁতরে? আর এই ওষুধের বাক্স দুটো কী ভাবে নেবে? যতো সব উদ্ভট পরিকল্পনা।
সঞ্জীবদা বলল, একটা নৌকা জোগাড় করতে হবে। একটা নৌকা পাওয়া যাবে না?
তুমি নৌকার খোঁজ করো। আমরা চললাম।
সমনে একটা তেরো চৌদ্দ বছরের মেয়ে হাজির হলো। এই কাদার মধ্যেও দিব্যি তরতর করে চলেছে। বাপ্পাদা বলল, মা’রে আমাদের একটু হেল্প কর। কাদার মধ্যে বিচ্ছিরি ফেঁসে গেছি।
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, আমি কী করে হেল্প করব? কাদা শুকিয়ে দেব নাকি? তাছাড়া আমি এখন ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছি। শরীর খারাপ।
বাপ্পাদা আমাকে দেখিয়ে বলল, ওরে এটাই তো ডাক্তার। ডাক্তারই যদি না পৌছাতে পারে, তাহলে তুই কাকে দেখাবি? তোর অসুখ কী করে সারবে?
মেয়েটি আমাকে দেখল। নিশ্চয়ই পছন্দ হলো না। না হওয়ারই কথা। একেই তো কাকভেজা হয়ে গেছি। প্যান্ট গোটাতে গোটাতে হাঁটুর উপরে। জুতো হাতে ডাক্তার এর আগে সে নিশ্চয়ই দেখেনি। ডাক্তার এখন রোগীর থেকে বেশি বিপদে। সে রোগীকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে কী করে?
মেয়েটি বলল, রাস্তার ধারে ঝোপঝাড় ছিঁড়ুন। সেটা কাদার মধ্যে ফেলে তার উপর পা দিন। তাহলে পা অতো কাদায় জড়াবে না।
মেয়েটির কথা শুনলাম। একটু সুবিধা হলো। মেয়েটি খানিকক্ষণ বাদে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, একটু দেখে শুনে হাত দেবেন… হ্যাঁ। ঝোপঝাড় কিন্তু জোঁকে ভর্তি।
অবশেষে আমরা কাঠের ব্রিজে পৌঁছে গেলাম। এবং ছবি তুললাম। মেয়েটি অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, তাড়াতাড়ি চলুন। সময় নষ্ট করবেন না। ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরে পড়তে বসব। কালকে ক্লাসে পরীক্ষা আছে।
আমার শুধু মনে হচ্ছিল, এই তরতরে মেয়েটি আমাদের খারাপ রাস্তাটুকু পার করে কোথাও হারিয়ে যাবে। আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আগেকার দিনে তো এমন প্রায়ই হতো। ঠাকুর টাকুররা কিশোরী রূপ ধরে পথ দেখাতেন। কিন্তু মেয়েটি ব্রিজ পার হয়ে নিজেই হড়কালো। এবং প্রায় দুই ফুট পিছলে কাদা মাখামাখি হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
আমরা সাবধানে দেবীকে টেনে তুললাম। হাসি চেপে বললাম, লেগেছে নাকি রে মা?
সে অপ্রস্তুত ভাবে হেসে বলল, একটুও লাগেনি বুঝলেন তো।
ঘাড় নেড়ে বললাম, বুঝেছি।
তারপর রিমিঝিমি বৃষ্টির মধ্যে ষাট জন রোগী দেখা হলো। সোমনাথকাকুও কাদা টাদা মেখে এসে গেছেন। এসেই ছবি তুলতে শুরু করেছেন।
যখন ফিরছি সুমনদা বলল, জুলাই মাসে বর্ষাবরণ অনুষ্ঠান আছে, সবাই মিলে আসিস।
বললাম, বর্ষাবরণে না এসে একেবারে বর্ষবরণে এলে হয় না?