সরস্বতী বিসর্জনে গেলেন। সরস্বতী পুজো ঘিরে পৌত্তলিকতা, প্রগতিশীলতা ইত্যাদি বিষয়ে বড় বড় কথা বুদ্ধিজীবীরা বলবেন। বুদ্ধিজীবী হওয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। তাই জীবনের ছোট ছোট আনন্দে খেঁকখেঁকিয়ে হাসতে পারি। মন খারাপে গালে হাত দিয়ে বসে ভাবার মতো দু’দণ্ড সময়ের অভাব নেই। দৈবীশক্তিতে বিশ্বাস হারিয়েছি বহুদিন। প্রণাম করিনি, পুষ্পাঞ্জলি দিইনি। তবু পুজোর আনন্দটা এখনো আমার। পুজোর আগে রাত জেগে মণ্ডপ সাজানো, আলপনা দেওয়া, চাঁদোয়া টাঙানো, প্রাণ খুলে আড্ডা… এগুলোর বিকল্প কিছু হয় নাকি? তাছাড়া সরস্বতী পুজোকে সম্ভবত ধর্মীয় উৎসবের তকমায় বেঁধে ফেলা যায় না। এমনিতেই বাঙালির হিন্দুধর্ম সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র ধর্ম যেখানে আরাধ্যকে মায়ের মতো, মেয়ের মতো, এমনকি প্রেমিক-প্রেমিকার মতো ভেবে ফেলা যায়। সেখানে ধর্মীয় আচার কিংবা হাজারো ফতোয়া ঘাড়ের ওপরে চেপে বসে না। আরাধ্যকে নিয়েও মজার গল্প, গান, ছবি বানানো যায়। এই ঔদার্য কিংবা আধুনিকতা আরোপিত নয়, বরং সম্ভবত ঊনিশ শতকের নবজাগরণের উত্তরাধিকার। টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছাদখোলা গাড়ি চেপে ঠাকুর আনা, সবাই মিলে খিচুড়ি খাওয়া, বেসুরো গান, সবশেষে গঙ্গাবক্ষে বিসর্জন… এর কোথাও ঠিক সেই অর্থে ধর্মের গুরুগম্ভীর শেকল টানার শব্দ নেই।
এসবের মাঝখানেই সরস্বতী পুজোর দিন মালতী মরে গেল। বিসর্জনের দিন মরলো সাবিনা। সাংঘাতিকভাবে অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ নিয়ে আইসিউতে এসেছিল মালতী। ক্রমশ তার অভিঘাত ছড়িয়ে যায় সারা শরীরে। জ্বর আর খিঁচুনি নিয়ে ভর্তি হয়েছিল সাবিনা। দাঁত লেগে ঠোঁট কেটে ঝর ঝর করে রক্ত পড়ছে… চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল… বেহুঁশ… ডায়াগনোসিস হল কোভিড পরবর্তী মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রোম। তৃতীয় ঢেউতে এই প্রথমবার এত খারাপ করোনা আক্রান্ত শিশু দেখলাম। ডিউটির পরেও এই দুটো বাচ্চার ব্যাপারে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিজেদের মধ্যে নিয়মিত আলোচনা চলতো। প্রেশার কমছে… হার্ট রেট উঠছে না… ইউরিন হচ্ছে না… সন্ধ্যেবেলা আবার একবার কনভালশন হয়ে গেল… খুব খারাপ এক্স-রে…
তারপর হঠাৎই কারো একটা শিফটে সাবিনা বা মালতী মরে যায়। সুশীল পাঠক, ‘মরে যাওয়া’ শব্দবন্ধে অস্বস্তি হচ্ছে কি? বিশ্বাস করুন, সাবিনা বা মালতীদের আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় জীবনাবসান হয় না, তারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে না, পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যায়না। সাবিনা বা মালতী মরে যায়। স্রেফ মরেই যায়। আলোকপ্রাপ্ত পৃথিবীর রোজকার আলোচনার অনেক বাইরে তারা হারিয়ে যায়। ইসিজি মনিটর সরলরেখা হয়ে যাওয়ার পর তাদের দাম শুধুই একটা কাগজ- ডেথ সার্টিফিকেট! অসুস্থ হলে তাদের জন্য তড়িঘড়ি অবিচুয়ারি লিখে রাখে না কেউ। মৃত্যুর পর সবার আগে জনসমক্ষে আনতে হবে যে!
হোয়াটসঅ্যাপের আলোচনায় আর মালতী বা সাবিনা নেই। তার বদলে অন্য কাউকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। চেনা বেডগুলোর পাশে দাঁড়াতে গিয়ে থমকে যাই। বেডটা খালি। ধবধবে সাদা চাদর পাতা। কখনো বেড খালি হওয়ার সাথে সাথেই ভরে যায়। হয়তো সময়ের চোরা স্রোত একটু অন্য খাতে বইলেই মালতী বা সাবিনা পৃথিবী জয় করতে পারতো। তার বদলে এখন শুধুই চরাচর জুড়ে বিসর্জনের বাজনা…
সব তর্ক-বিতর্ক, সব হাসি-কান্না, বইয়ের পাতার প্রতিটি অক্ষর, ঐশ্বর্যের জাঁক, প্রতিটি হ-য-ব-র-ল থেমে যায়। সন্ধ্যা নামলেই পাখির ঝাঁকের ঘরে ফেরার উড়ান। ধোঁয়াটে দিগন্তের ক্যানভাসে কে যেন গোটা গোটা করে লেখে- জীবনের থেকে বড় কিছু নেই। ডাকের সাজ তলিয়ে যাচ্ছে… বাঁশের কাঠামো তলিয়ে যাচ্ছে… সাবিনা তলিয়ে যাচ্ছে… মালতী তলিয়ে যাচ্ছে…
মহানগরীতে রাত নামছে…