লেখাটা লিখেছিলাম ঠিক ১০ বছর আগে। কম্পিউটার দেখাচ্ছে ২০১৩-র ২৫শে নভেম্বর লেখা।
______________________________________
বিশ্বের বৃহত্তম শিল্প-দুর্ঘটনার শহর ভোপাল—২৮ বছর আগে যেখানে ডাক্তার হিসেবে, জনস্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলাম। না, শেষ অবধি টিঁকে থাকতে পারিনি।
প্রথম যাওয়া ১৯৮৫-র ২রা জুলাই, জ্যোতির্ময় সমাজদারের সঙ্গে। ঠিক এক মাস আগে ৩রা জুন ইউনিয়ন কার্বাইড প্রাঙ্গণে ‘গণ-হাসপাতাল’-এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপণ করেছিল জনস্বাস্থ্য সমিতি। গ্যাসপীড়িতদের দুটি সংগঠন—জাহরিলী গ্যাস কান্ড সংঘর্ষ মোর্চা, নাগরিক রাহত আউর পুনর্বাস কমিটি, বোম্বের ট্রেড ইউনিয়নগুলির ট্রেড ইউনিয়ন রিলিফ ফান্ড এবং ইউনিয়ন কার্বাইড কর্মচারী সংঘ মিলে জনস্বাস্থ্য সমিতি গড়ে তোলেন।
ইউনিয়ন কার্বাইড প্রাঙ্গণে শুরু হয় জন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাজ। জন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গ্যাসপীড়িতদের সোডিয়াম থায়োসালফেট ইঞ্জেকশন দেওয়া হত।
সায়ানাইড বিষের প্রতিষেধক সোডিয়াম থায়োসালফেট। ভোপালের গান্ধী মেডিকাল কলেজের ফরেন্সিক বিভাগের প্রধান ডা হীরেশ চন্দ্র ’৮৪-র ৩রা ডিসেম্বরই গ্যাসকান্ডে মৃতদের শবব্যবচ্ছেদ করে সিদ্ধান্তে আসেন—সায়ানাইড বিষ আছে গ্যাস-আক্রান্তদের শরীরে। তাঁর সুপারিশ ছিল জীবিত গ্যাস-আক্রান্তদের থায়োসালফেট দেওয়া হোক। ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া-স্থিত কারখানার প্রধান মেডিকাল অফিসার ৪ঠা ডিসেম্বর এক টেলেক্স-বার্তায় বিষ-গ্যাসের প্রতিষেধক হিসেবে সোডিয়াম থায়োসালফেট ব্যবহার করতে বলেন। ৮ই ডিসেম্বর বিখ্যাত জার্মান বিষবিদ ম্যাক্স ডন্ডেরার-এর মত ছিল একই রকম। সে সময় ভারতে সোডিয়াম থায়োসালফেট তৈরি হত না, তাই তিনি রেখে গেলেন ১০হাজার এম্পুল ঐ ইঞ্জেকশন। বিরোধিতা করেন ভোপালের সরকারী চিকিৎসকরা, নানাভাবে যাঁরা কার্বাইডের প্রসাদধন্য। থায়োসালফেটে গ্যাস-পীড়িতদের অবস্থার উন্নতি হওয়া মানে বিষ-গ্যাস মিশ্রণে সায়ানাইডের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়ে যাওয়া—এতে কার্বাইডের criminal responsibility অনেকগুণ বেড়ে যায়, অনেক বেশি ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয় কার্বাইড।
’৮৫-জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী, এপ্রিলে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকাল রিসার্চ-এর বারবার সুপারিশেও টলে না সরকারী স্বাস্থ্য-দপ্তর। তাই গ্যাসপীড়িতের নিজস্ব উদ্যোগে জন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে থায়োসালফেট দেওয়া। এ কাজে উদ্যমী ছিলেন কলকাতা মেডিকাল কলেজে আমার পরের ব্যাচ, তখন যাঁরা ইন্টার্ন। ইন্টার্নশিপ থেকে ছুটি নিয়ে ২-৩ জনের দলে এসে তাঁরা কাজ করতে লাগলেন। দিনে প্রায় দেড়শ’ জনকে ইঞ্জেকশন দেওয়া হতে থাকল, রোগীরা উপকার পেতে থাকলেন, কার্বাইডের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় হতে থাকল। হত্যাকারী কার্বাইড শাস্তি পায়নি, অথচ আক্রমণ নেমে এল জন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ওপর। ২৪শে জুন রাতে ডাক্তার-সহ ৩১জন স্বাস্থ্যকর্মী গ্রেপ্তার হলেন, কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হল, স্বাস্থ্য-দপ্তর কেন্দ্রে সোডিয়াম থায়োসালফেট সরবরাহ বন্ধ করে দিল।
এই পর্যায়েই আমার ভোপাল যাওয়া, অনেকটাই উত্তেজনার খোঁজে। সে সময় আমি হাউসস্টাফশিপ করছি। ভোপাল গ্যাস-কান্ড আমার মনে অন্য যে কোনও শিল্প-দুর্ঘটনার চেয়ে বেশি দাগ কাটেনি। আমার জুনিয়ার বন্ধুরা যখন ভোপাল যাচ্ছেন, তখন আমি হাসপাতালে ব্যস্ত থেকেছি। পুলিশি আক্রমণের পর যখন স্বাভাবিক ভাবেই ডাক্তাররা যেতে ইতস্তত করছেন তখন মনে হল একবার দেখে আসা যাক। ২রা জুলাই বন্দী স্বাস্থ্যকর্মীরা ছাড়া পেলেন, জেলের সামনে ছত্তিশগড়ের শ্রমিকনেতা শংকর গুহ নিয়োগী স্লোগান তুলছেন—জেলকে তালা টুটেগা, হমারা সাথী টুটেগা। সে দফায় সাতদিন ভোপালে ছিলাম আন্দোলনটাকে জানতে বুঝতে। চোখ খুলে গেল—মানুষ কিভাবে স্বাস্থ্যের দাবীতে লড়াই করতে পারেন শেখা শুরু হল।
আগস্টে হাউসস্টাফশিপ শেষ, ততদিনে ঠিক করে ফেলেছি গ্যাসপীড়িতদের সঙ্গেই শুরু করব আমার চিকিৎসক-জীবন। ২১শে আগস্ট দ্বিতীয়বার গেলাম, সঙ্গে দশদিনের জন্য ডা দেবাশিস চক্রবর্তী। স্বাস্থ্যকেন্দ্র নতুন করে খোলা হল ২৫শে আগস্ট। ২৮শে আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিলেন জন স্বাস্থ্য কেন্দ্রকে থায়োসালফেট সরবরাহ করতে।
প্রতি সপ্তাহে আমরা ৫০জন করে রোগীর চিকিৎসা করতাম। প্রথমে তাঁদের উপসর্গগুলো লিপিবদ্ধ করা হত। সে সময়কার প্রধান উপসর্গগুলো ছিল—সামান্য পরিশ্রমেই হাঁফিয়ে পড়া, ক্ষুধামান্দ্য, পেটে ব্যথা, দুর্বলতা, অবসাদ, অনিদ্রা। সোম থেকে শনি রোজ এঁদের শিরায় থায়োসালফেট ইঞ্জেকশন লাগানো হত—তৃতীয় ও ষষ্ঠ দিনে পরীক্ষা করে দেখা হত রোগী কতটা লাভবান হলেন, সে তথ্য নথিভুক্ত করা হত। যে সময়কার কথা বলছি—তখন ফুসফুসের ক্ষমতা মাপার যন্ত্র স্পাইরোমিটার বহনযোগ্য ছিল না, ছিল না কাজ চালানোর মত পিক ফ্লো মিটার।
আমি যখন চিকিৎসা ও প্রমাণ জোগাড় করার কাজ করছি, তখন আরেক সাথী মেডিকো ফ্রেন্ড সার্কেল-এর ডা অনন্ত ফাদকে জনশিক্ষার বই লেখার কাজ করছেন। একমাস থেকে তিনি মহারাষ্ট্রে ফিরে গেলেন, এলেন কর্নাটক থেকে ডা সঞ্জীব কুলকার্নি। আমি ছিলাম নভেম্বর অবধি। আমার পরে মুখ্য-চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন যথাক্রমে শহীদ হাসপাতালের ডা শৈবাল জানা, ডা চঞ্চলা সমাজদার। ১৯৮৬-এর শুরুতে ডাক্তারের অভাবে স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়।
দীর্ঘদিন থাকার পরিকল্পনা নিয়ে গিয়েও আমি থাকতে পারিনি। জনস্বাস্থ্য সমিতি-র দুই প্রধান সংঘটক মোর্চা ও এনআরপিসি-র দ্বন্দ্ব স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্তৃত্ব নিয়ে, পরে মোর্চার মধ্যেকার বিজ্ঞানকর্মীদের কোনঠাসা করার জন্য এসইউসি-র প্রয়াস। তার চেয়েও বেশি নেতিবাচক প্রভাব আমার ওপর ফেলছিল—ভোপালের মানুষের পাশে দাঁড়াতে আসা তরুণ-তরুণীদের বেশ কয়েকজনের ক্ষয়িষ্ণু জীবনযাত্রা-মূল্যবোধ।
কিন্তু বিষ-গ্যাসের উপাদান কি ছিল ও বিষ-গ্যাস তাঁদের শরীরে কি ক্ষতি করেছে তা জানার দাবীতে, যথাযথ চিকিৎসার দাবীতে ভোপালবাসীদের আন্দোলন আমাকে, আমাদের পথ দেখিয়েছে বারবার ছত্তিশগড়ে, বাংলায়…।
****
সময়ঃ অক্টোবর, ১৯৮৯।
১৫-২২শে অক্টোবর ৩৫ সদস্যের এক সার্ভে-দলের সদস্য হয়ে আবার ভোপালে। ১৯৮৫-র মার্চে, গ্যাস-কান্ডের তিন মাস পর গ্যাস-পীড়িতদের শারীরিক অবস্থার দুটো সমীক্ষা করেছিল নাগরিক রাহত আউর পুনর্বাস সমিতি এবং মেডিকো ফ্রেন্ডস সার্কেল। এই সমীক্ষাদুটোর নথি মজুত ছিল। যাঁদের দেখা হয়েছিল সে সময়, পাঁচ বছর পর তাঁরা কেমন আছেন খতিয়ে দেখা ছিল আমাদের উদ্দেশ্য।
বেশি প্রভাবিত বসতি—জয়প্রকাশ নগর, কাঁইচি ছোলা, গরীব নগর, ওড়িয়া বস্তি, রাম মন্দির, ফুটা মাকওয়ারা, রাজগড় কলোনি, সুভাষ নগর, রেলওয়ে কলোনি, ছোলা মন্দির, কাজী ক্যাম্প এবং কম প্রভাবিত—আন্না নগর-এ ছিলেন আমাদের সমীক্ষার মানুষ-জন।
এই সমীক্ষায় দেখা যায়ঃ—
- বেশি-প্রভাবিত এলাকার ৭০-৮০% মানুষ ও কম প্রভাবিত এলাকার ৪০-৫০% কোনও না কোনও অসুস্থতায় ভুগছেন।
- ক্ষতিগ্রস্ত শরীরের তন্ত্রগুলো হল—শ্বাসতন্ত্র, চোখ, পরিপাক-তন্ত্র ও মাংসপেশি-কঙ্কালতন্ত্র।
- দুই এলাকার মহিলাদের অধিকাংশই মাসিক রজঃস্রাবের অনিয়মিততায় ভুগছেন।
- পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার গ্যাস-পীড়িতদের বড় মানসিক সমস্যা।
সমীক্ষার অন্তরিম রিপোর্ট ১৯৮৯-এর ডিসেম্বর-এ প্রকাশিত হয়েছিল Against All Odds নামে।
সব মিলিয়ে অবস্থাটা আশাব্যঞ্জক মনে হয়নি। ’৮৪-’৮৫-তে গ্যাস-পীড়িতদের অধিকার-আন্দোলনে অগ্রণী ছিল জাহরিলী গ্যাস কান্ড সংঘর্ষ মোর্চা। মোর্চায় রাজনীতিকদের দবদবায় কোনঠাসা হয়ে ভোপাল ছাড়লেন অধিকাংশ বিজ্ঞানকর্মী ’৮৬-তে। আর সরকারের সঙ্গে ইউনিয়ন কার্বাইডের অন্যায় চুক্তিকে সমর্থন জানিয়ে গ্যাস-পীড়িতদের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয় মোর্চা। ১৯৯০-এর লোকসভা নির্বাচনে ভোপালে কংগ্রেসের প্রার্থী মনসুর আলি খান পতৌদির বিরুদ্ধে জনতা দলের প্রার্থী ছিলেন স্বামী অগ্নিবেশ। অগ্নিবেশের নির্বাচনী প্রচারে সাহায্য করতে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার এক প্রচার-দলের দায়িত্ব নিয়ে আবার যাই ভোপালে। ’৮৯-’৯০-এ আশার আলো দেখেছিলাম গ্যাসপীড়িত মহিলা উদ্যোগ সংগঠন-এ।
শুরু থেকে ছিল, আজও আছে সত্যু—বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতকোত্তর সতীনাথ ষড়ঙ্গী। পেশা ছেড়ে সত্যু যোগ দিয়েছিল মধ্যপ্রদেশের হোশাঙ্গাবাদ জেলায় শিশুদের বিজ্ঞান-শিক্ষা নিয়ে কর্মরত কিশোর ভারতী-তে। গ্যাস-কান্ডের পর কিশোর ভারতী ছেড়ে মোর্চা, মোর্চা দালালি শুরু করার পর সত্যু গড়ে তোলে Bhopal Group for Information and Action. তারপর সম্ভাবনা ট্রাস্ট। সম্ভাবনা ট্রাস্টের ক্লিনিকে আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে প্রাকৃতিক চিকিৎসা, আয়ুর্বেদের মেল-বন্ধন(?) করে গ্যাস-পীড়িতের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা চলে, স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীদের পরীক্ষা করে ফলাফল নথিভুক্ত করেন—ইউনিয়ন কার্বাইডের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহের কাজ।
কারখানার মালিকানার হাতবদল হয়েছে, এখন মালিক ডাউ কেমিকাল। ভোপাল আন্দোলন গণ-আন্দোলনের চরিত্র হারিয়ে কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষের আইনী লড়াই-এ পর্যবসিত হয়েছে।
ভোপাল গ্যাস-কান্ডের ২৯ বছর হল। গ্যাস-পীড়িতদের পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে জন্মগত বিকৃতির প্রাদুর্ভাব দেখতে সম্ভাবনা ট্রাস্ট এক সমীক্ষা চালাচ্ছে গত এক বছর ধরে। তাতে অংশগ্রহণকারী ডাক্তাররাও অধিকাংশ পশ্চিমবঙ্গের, শিক্ষক চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
আমি এবার যাইনি। হয়ত যাব, যখন ভোপাল আন্দোলন আবার গণ-আন্দোলনের রূপ নেবে।
_______________________________
ভোপালে যাওয়া হয়নি আর। যে সমীক্ষার কথা বলেছিলাম ১০ বছর আগে, আমার ছেলে এখন এক গবেষক দলের হয়ে সেই সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করছে।