আমাদের সময়ে মেডিকেল কলেজগুলোয় ডাকসাইটে মহিলা বস(মানে শিক্ষক) ছিলেন হাতে গোনা। তাও শুধুই পেডিয়াট্রিক্স আর গাইনিতে।
পেডিয়াট্রিক্সে ছিলেন প্রফেসর শান্তি ইন্দ্র। আমি কোনওদিনও তাঁর ক্লাস বা ওয়ার্ড করিনি। আমার স্ত্রী সুনন্দার সঙ্গে সুদূর আত্মীয়তা ছিল ডাঃ ইন্দ্রর। সেই সুবাদে তাঁর প্রাইভেট চেম্বারের ক্লিনিকে কখনও সাহায্যকারিনী হয়েছে সে। কিন্তু সেই ভেঞ্চার খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
শিশুনিবাস মেডিকেল, মানে মেডিকেল কলেজে পেডিয়াট্রিক্সের হাউসস্টাফ সহপাঠীদের কাছে শুনেছি, শান্তিদির পড়ানো আর ক্লিনিকস সবই খুব ভালো হত। কিন্তু খুব কড়া ছিলেন রোগীর যত্নের ব্যাপারে। তাও বলত ওরা।
এই প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট শোনা গল্প শেয়ার করি। আমি তখন চেস্টের হাউসস্টাফ। সেই সময়ে এমারজেন্সিতে কিছু স্বনামধন্য সিনিয়র ওডি (সিনিয়র অফিসার অন ডিউটি) ছিলেন। সিনিয়র ওডি মানে ডাকসাইটে চিকিৎসক, এমারজেন্সির অল ইন অল। দীনেশদা’ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
এমারজেন্সিতে প্রচুর খরচ করতেন সহযোগী অন্য স্টাফদের রাত্রিকালীন ভরণপোষণের জন্য।
টানা নাইট ডিউটি করতেন। সারাদিন প্র্যাকটিশ করতেন কোথায় কোথায়। নো বিশ্রাম। বনগাঁ থেকে বারুইপুর, ক্যানিং থেকে কৃষ্ণনগর। সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ল্যান্ড করতেন এমারজেন্সিতে। পরিশ্রান্ত দাদার স্ট্যান্ডার্ড নির্দেশ ছিল, কম ঝামেলার কোনও কেস এলে তাঁর বিশ্রাম যথাসাধ্য ডিস্টার্ব না করার। অ্যাডমিশন টিকিটে অগ্রিম সই করা থাকত। (কম্পিউটার আসবে তার তিরিশ বছর বাদে।)
সই না হয় হল। কিন্তু ভর্তি হওয়া পেশেন্টের ডিরেকশন?
এই সমস্ত পেটি কেস, যাদের অনিবার্য ছুটি হবে আগামী কালই, তাদের জন্য অগ্রিম স্টিরিওটাইপ ডিরেকশন লিখে শুতে যেতেন দাদা। বলা থাকত, শয্যার মাথার দিকে ডানদিকের তলায় ডায়রিয়া। বাঁদিকে বাচ্চা ছেলের জ্বর ইত্যাদি। আবার বাঁদিকে পায়ের কাছে হাঁপানি। সেই কাগজ বার করে অ্যাটাচ করে দিতে হবে। এই রকমের নানান সুলুক।
অভিজ্ঞ এমারজেন্সি স্টাফেরা, অনেকদিনের অভিজ্ঞতাবশত বুঝে ফেলতেন কী রোগী আর তার নিদানই বা কী। সেই মত কাগজপত্র তৈরি করে দীনেশদা’কে না জাগিয়ে সুচারু ভাবে ডিউটি সারতেন।
সেদিনও তাই। রোগী এসেছে। শিশুনিবাসে রোগী ভর্তি হত গার্জিয়ান সমেত। এক বৃদ্ধা আর তার কোলে সযত্নে আঁকড়ে ধরা দীনেশদার আদৌ না দেখা পেশেন্ট।
ত্বরিত সেই রোগী গার্জিয়ান সমেত শিশুনিবাস মেডিকেল মানে পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে গেছে।
সে দিন ডাঃ শান্তি ইন্দ্রর অ্যাডমিশন ডে। কোনও খারাপ পেশেন্টের জন্য তিনি সেই রাত দুপুরে ওয়ার্ডে এসেছেন। আহা, চমকে উঠবেন না। সে কালে বসেরা আসতেন এমন।
বেরিয়ে যাবার সময়, এই সদ্য আসা রোগীকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। দেখেই যাওয়া যাক। ওয়ার্ডে হাউসস্টাফ রয়েছে যদিও।
ওয়ার্ডের নিয়ম ছিল রোগী এলেই সিস্টার তার ওজন ইত্যাদি নেবেন। নিয়ে বেডে দেবেন। অভিভাবিকা সেই বুড়ি। তার কোলে রোগী।
শান্তিদির সামনেই তৈরি হল এক আশ্চর্য নাটকীয় পরিস্থিতি। আশ্চর্য ম্যাজিকও বলা যায়। রোগী কই? ফুটপাথবাসিনী বুড়ি কোলে সযত্নে একটা পুঁটলি ধরে আছেন বটে। কিন্তু সেই পুঁটলি কোনও শিশু নয়। বস্তুত ওই পুঁটলিতে তাঁর পার্থিব সর্বস্ব সম্পদ।
বৃদ্ধা আসলে নিজেই জ্বরের জন্য ভর্তি হতে এসেছিলেন।
এমারজেন্সিতে কোলের পুঁটলি আদৌ একসপ্লোর না করে শিশু ভেবে নিয়েছে এমারজেন্সির স্টাফ। তাতেই এই সিরিয়াস বিপত্তি।
শান্তিদি তারপরে একতলায় এমারজেন্সিতে এসে কী করেছিলেন সহজেই অনুমেয়।
আমাদের সময়ের আর বাকি মহিলা বসেরা ছিলেন গাইনিতে। এককথায় বলতে গেলে তারকা তাঁরা। প্রফেসর মুকুলিকা কোনার, অনিলাদি (সেনগুপ্ত), কল্যানীদি এঁরা সবাই অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে ইডেনে কাজ করতেন আমাদের সময়ে।
যেটা বলার, এঁদের মধ্যে অনিলাদির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে আমাদের জীবনে। আমার দুটি ছেলেই সুনন্দা ওঁর অ্যান্টিনেটাল তত্ত্বাবধানে থাকার পর ইডেন হাসপাতালে ওঁর কাছেই সিজার। অনিলাদির প্রাইভেট চেম্বারেও গেছি তখন। ফিজ্ দিতে গিয়ে বকুনি খেয়েছি। দ্বিতীয় বাচ্চাটিও সিজার। অনিলাদি আমাকে ওটিতে থাকতে দেননি। (সেকালে দেওয়া হত না। এখন কর্পোরেটে পারমিশন দেয়!)
হঠাৎ অপারেশনের মধ্যপথে ওটি থেকে মুখ বাড়িয়ে দিদি আমায় ডেকে নিলেন। – অরুণাচল, রিপিট সিজার তো। লাইগেশনটা করে দিচ্ছি। তুমি পরে কনসেন্টে সই করে দিয়ো।
অনেক পরে আমার ক্লাসমেট বন্ধু অমিতাভ এই লাইগেশনে কনসেন্ট দেবার খবর শুনে কী দারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। – তোমার কী অধিকার ছিল, অসহায় অজ্ঞান একটা মেয়ের পারমিশন না নিয়ে লাইগেশন করিয়ে সারাজীবনের জন্য হ্যান্ডিক্যাপড্ করে দেবার? ছিঃ, পুরুষতন্ত্র ছিঃ!
এমনি সব কেটেছিল আমাদের সেই সব দিন।
দুটো সিজারই মেডিকেল কলেজে! তখনও মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা মেডিকেল কলেজকে এতটাই ভরসা করত। ইদানীং কোনও প্রসূতি চিকিৎসকের ডেলিভারি মেডিকেল কলেজে হয় কি? আমার কানে আসেনি। অবশ্য আমি কী আর কতটাই বা জানি!
অন্য ডিপার্টমেন্টে মানে মেডিসিনে আর সার্জারিতে কিম্বা চেস্টে স্কিন আই ইনএনটিতে মহিলা বস ছিলেন না কেউ। পরে কিন্তু এই সব ক্ষেত্রেও মহিলা বসেরা এসেছেন। দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন।
মেডিকেল কলেজে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটে আমার এক ইয়ার জুনিয়র পরে এমডির উজ্জ্বল সহপাঠিনী সুমিত্রা বসুঠাকুর চেস্টের দাপুটে বস হয়েছিল।
এহ বাহ্য, আসল কথায় ফিরি। আমার সার্জারি করার খুব বাসনা ছিল। নেহাত দুর্মতিতেই চেস্টে অনুপ্রবেশ ঘটে আমার।
যদিও শুনতে অদ্ভুত লাগবে, এখন খুব ইচ্ছে করে, সার্জারিতে ফের ছাত্র হয়ে ঢুকি। ইন্টার্নশিপ, হাউসস্টাফশিপ (ওঃ, আজকাল তো ফার্স্ট ইয়ার পিজিটি বলে) নতুন করে করি। সার্জেন হই।
এই সব ভাবনার বদহজমে আজকাল আজব স্বপ্নও দেখি। কী আশ্চর্য, এইবারের এইসব স্বপ্ন-ট্রেনিংয়ে সার্জারির বস মহিলা। কড়া চোখে ভুল ধরা, ইউনিট হেড সেই বসকে পেশেন্ট নিয়ে গুল (সে আমি সেকালেও দিতাম… ওরকম রাশি রাশি ইনভেস্টিগেশন মনে থাকে নাকি?) মারতে গিয়ে থতমত খেয়ে যাই। কেমন যেন চেনা চেনা মুখ।
আসলে মগ্ন চৈতন্যে সেই যে মায়ের কাছে অ আ ক খ শিখেছিলাম, সেই স্মৃতি সাঁতরে বেড়ায় বোধ হয়। মাকে খুঁজি।
মোটমাট আমি সার্জারিতে নতুন করে ইন্টার্নশিপের জন্য মনে মনে হন্যে হয়ে থাকি।
★