আজ ষষ্ঠ পর্বে আবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে ফিরতে চাইছি। দেড় সপ্তাহ হলো আমি ঘর থেকে বেরিয়েছি। কোন সমস্যা এখন আর নেই। দোকান বাজার যাচ্ছি। অনেকেই আমার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিচ্ছেন। অভিজ্ঞতা শুনতে চাইছেন। কেউ কেউ আবার ‘করোনা জয়ী’, এমনকি ‘করোনা যোদ্ধা’ পর্যন্ত বলছেন। সবিনয় বলছি, ‘যোদ্ধা’ শব্দটি চিকিৎসক – স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য তুলে রাখাই বাঞ্ছনীয়। আমার মতো মৃদু উপসর্গের রোগীরা নিজে থেকেই সুস্থ হয়ে উঠছেন। প্রয়োজন একটু সাহস, আত্মবিশ্বাস, আর ধৈর্য। অন্তত আমার ক্ষেত্রে, ‘জয়ী’ শব্দটিও বাহুল্য বলেই মনে করি।
তবে, যুদ্ধ না হলেও লড়াই একটু করতে হয়েছে বটে — দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিভ্রম-বিভ্রান্তি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা ইত্যাদির সঙ্গে। বরং যুদ্ধ যদি সামান্য হলেও কেউ করে থাকে, তা হলো আমার পরিবার, পরিবারের প্রত্যেক সদস্য — আমার মা, দুই মেয়ে, এবং অবশ্যই আমার স্ত্রী, নবমিতা। সতেরো দিনের পুরো ঝক্কি সামলাতে হয়েছে নবমিতাকেই। রোগী-পরিচর্যা, মা ও বাচ্চাদের দেখভাল, রান্না-বান্না, সাংসারিক খুঁটিনাটি, স্বজন-প্রতিবেশীর মাধ্যমে দোকান বাজারের বন্দোবস্ত — আরও অনেক কিছু। বাড়ির কাজকর্মে সহায়তা করেন যে মহিলা, বিধি মতো তাঁরও চোদ্দো দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকার কথা। তাঁকে অনুরোধ করা হয়, এই কটা দিন এখানেই থেকে যেতে। তিনি রাজি হওয়াতে অনেকটাই সুরাহা হয়। তবুও অনেক কাজ। তার সাথে অন্তত প্রথম সপ্তাহের ভয়-ভীতি উদ্বেগ এবং বিভ্রান্তি।
প্রত্যেকেরই উৎকন্ঠা যেমন আমাকে নিয়ে ছিল, তার সঙ্গে বড় দুশ্চিন্তা ছিল, যদি বাড়ির অন্য কেউ সংক্রমিত হয়। প্রশাসন থেকে বাড়ির আর কারও করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করেনি। করলে কী পাওয়া যেত বলা মুশকিল। আমারও যেটুকু উদ্বেগ ছিল, তা বাকিদের নিয়েই, বিশেষত মা এবং ছোট মেয়ে। আমিই স্বয়ং ঘরবন্দি, সে ক্ষেত্রে অন্য কেউ সংক্রমিত হলে কিভাবে কী ব্যবস্থা হবে, তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। ধীরে ধীরে সবাই ধাতস্থ হতে থাকে। আমিও সুস্থ হতে থাকি। সঙ্গে অধৈর্যও। বই-পত্রিকা- সংবাদপত্র পড়া, ফোনে বন্ধু শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে কথা বলা, সামাজিক মাধ্যমে ঘোরাফেরা করা — এসব সত্ত্বেও আইসোলেশনের শেষ দিকে সময় কাটানোটা একটু সমস্যাই হচ্ছিল। এই সুযোগে বলে রাখি, একেবারে শুয়ে বসে সময় কাটানো নয়, কিছু কাজ-কম্মও করতে হয়েছে বৈকি। কারণ, হোম আইসোলেশনে থাকা মানে আমার ঘরে কেউ প্রবেশ করতে তো পারবেই না, আমার ঘর থেকে কোন জিনিস বাইরে যাবে না, বা আমার ব্যবহৃত কোন জিনিস কেউ ধরবেও না। স্বাভাবিক ভাবেই ঘর ঝাড়া-মোছা, বাসন ধোয়া, জামা কাপড় কাচা — এগুলো পুরোপুরি নিজের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে যাচ্ছে।
সে না হয় হলো। সমস্যা তৈরি হলো ঘরের আবর্জনা ফেলা নিয়ে। একটা ঢাকনা দেওয়া ডাষ্টবিনে আমার ঘরের ময়লা আবর্জনা এঁটোকাটা রাখছিলাম। কারণ, ফেলবো কোথায়? কিভাবেই বা? কিছুদিন পরে দেখি রীতিমতো দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। পোকা হয়ে গেছে। শুধু আমার ঘর নয়, সারা বাড়ির আবর্জনা নিয়েই সমস্যা দেখা দেয়। পৌরসভার যে ব্যক্তি বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করেন, তিনি দ্বিতীয় দিন থেকেই আসা বন্ধ করে দেন। এদিকে বাড়ির বাইরে সবারই বেরোনো নিষেধ। অন্তত দুই সপ্তাহ এ ভাবেই কেটেছে। পরে বাধ্য হয়ে বাইরে গিয়ে ফেলে আসতে হয়। আমাকে অবশ্য সতেরো দিন ঘর আর বারান্দার মধ্যেই থাকতে হয়েছে। এমনকি গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার দরজার সামনে থেকে টেনে এনে দোতলায় তোলা, সিলিন্ডার লাগাতে গিয়ে ত্রুটিপূর্ণ ভাল্বের জন্য সশব্দ গ্যাস বেরিয়ে যাওয়া, মা মেঝেতে পড়ে গেলে ধরে তোলা — কোন সমস্যা সমাধানেই আমি সাহায্য করতে পারি নি। ছাত্রদের অনলাইন ক্লাস, মেয়েদের পড়ানো — সতেরো দিন এবং তার আগের চার পাঁচ দিন, মোটামুটি তিন সপ্তাহের বেশি বন্ধ ছিল। এখনও নিয়মিত করে উঠতে পারি নি।
দুই মেয়ে, তোড়ি-তোড়াও ছোটখাটো একটা সংকট কাটিয়ে উঠল। স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে ফোনে যখন আমাকে জানানো হলো, আমি করোনা পজিটিভ, বড় মেয়ে তখন আমার পাশেই ছিল। কিছুক্ষণের কথোপকথনেই বুঝে গেছে ঘটনাটা। বুঝলাম ভয় পেয়ে গেছে। প্রথমেই দৌড়ে নীচে গিয়ে মাম্মামকে (আমার মা) খবর দিল। নবমিতা তখন বাড়িতে নেই। মেয়ের স্কুলে গেছে। ফোনে খবর দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখি, মা উপরে উঠে এসে আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে। বুঝিয়ে সুঝিয়ে নীচে পাঠালাম। আসলে আমার শরীর খারাপ হলে দিনে অন্তত একবার মা এসে পাশে বসবে, এটাই নিয়ম। মা’র জন্য, আমার জন্যও। নবমিতা এসে কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকল। তারপর সদলবল হাসপাতালে গেল করোনা পরীক্ষা করাতে। কিন্তু টেস্ট-কিট না থাকায় কারোই পরীক্ষা হলো না। সে পরীক্ষা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সমস্যা হলো ছোট মেয়েকে নিয়ে। এমনিতেই ওর একটু জ্বর ছিল (১০০° ফাঃ-এর মধ্যে)। তার ওপর, যে করোনার কথা গত আট মাস ধরে শুনে শুনে একটা ভীতি তৈরি হয়ে আছে, সেই করোনা ভাইরাস ঘরে এসে হাজির এবং ওরও করোনা পরীক্ষা করতে হবে, এ কথা শুনে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। ঠিকমতো খেতেই পারলো না। আর তাতে আমরাও একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। পরে ছোট মেয়েকে বোঝানো হলো, ওর টেস্ট করার কোন প্রয়োজনই নেই। তাতে কাজ হলো। জ্বরটাও পরের দিন সন্ধ্যা থেকে আর আসেনি। ফলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক খেলাধুলা, পড়াশোনা, দিদির সঙ্গে খুনসুটি শুরু হয়ে গেল। সারা দিনে কয়েকবার আমার ঘরের দরজার বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলা। খোঁজ খবর নেওয়া — আমার আর জ্যাক-ম্যাকের। জ্যাক-ম্যাক দুজনের দুই পুতুল। আমার সঙ্গে ওরাও ঘরবন্দি হয়ে গেছিল। এভাবেই নিভৃতবাস একদিন শেষ হলো।
আমার তো অল্পের উপর দিয়েই কেটে গেল। শুধু মাত্র সতেরো দিন বিচ্ছিন্ন থাকা। তাও বাড়িতেই থাকতে পেরেছি। কিন্তু যাঁদের সরকারি সেফ হোমে থাকতে হয়, তাঁদের হয়রানি এবং পরিবারের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মাত্রা বুঝতে পারি। মাঝারি বা তীব্র উপসর্গ নিয়ে যাঁদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কয়েক গুণ বেশী। বস্তুত, এতদিন যতটা মনে হতো, এখন বুঝতে পারছি তার থেকে অনেকটাই বেশী। যথারীতি সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও অনিশ্চয়তা এবং সেই ব্যবস্থার ওপর মানুষের ক্রমবর্ধমান অনাস্থার সুযোগ নিতে বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোম বীর বিক্রমে মাঠে নেমে গেছে বাণিজ্য করতে। সরকার দেখছে। মাঝেমধ্যে শূন্যগর্ভ হুঙ্কার দিচ্ছে। উভয় পক্ষই জানে এই হুঙ্কারের অর্থ। প্রচুর অর্থ ব্যয়ে রোগীকে সুস্থ করে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে আনতে হচ্ছে। অনেক রোগীকে আর ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। তাঁদের পরিবারের অবস্থা আমি উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি। আমরা এখন জেনে গেছি, কোভিড সংক্রমিতদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক মানুষেরই মৃত্যু হচ্ছে। মাত্র দুই থেকে তিন শতাংশ মতো। এবং এটাও জেনে গেছি, সাধারণভাবে যাঁরা বয়স্ক এবং কোমরবিডিটি যুক্ত, অর্থাৎ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন — তাঁদের ক্ষেত্রেই এই চরম পরিণতি ঘটছে। কিন্তু যে সমস্ত পরিবারে এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটল, তাঁদের কাছে কিন্তু হিসেবটা একশো শতাংশই হলো। এঁদের উদ্দেশ্যে আন্তরিক সমব্যাথা, সমবেদনা, শোক জ্ঞাপন ছাড়া আপাতত আর কীই বা করতে পারি?
(ক্রমশ)