হাত ধুতে ধুতে হাতের আর কিছু নেই। শরীরের বাকি অংশের চেয়ে এখন হাতের রঙ অন্তত তিন পোঁচ পরিষ্কার।
অবশ্য হাত ধোবার বাতিক আমার এমনিতেই বহু পুরোনো। এটা শুরু হয়েছিল ছোটবেলায় একবার শখ করে ঘুঁটে দিতে গিয়ে। যদিও আমি মন্দ ঘুঁটে দিই না কিন্তু একবারের বেশি আর প্রত্যয় হয়নি।
আমাদের কোয়ার্টারে কাজ করত মদনের মা। কয়লার গুঁড়ো আর গোবর মিশিয়ে মদনের মা অসাধারণ গুল দিত। আর আমাদের কোয়ার্টারের পেছনের দেওয়ালে ঘুঁটেও দিত। আমার মায়ের সঙ্গে বোধ হয় সেভেন্টি -থার্টি রফা ছিল৷ কিছু ঘুঁটে আর গুল মদনের মা নিজের বাড়ি নিয়ে যেত। আমার মাও মাঝে মাঝে গুল দিতেন। গুল দেওয়াটা একটা নেশার মত। পাশাপাশি যে কোন দুটো গুলের মধ্যে দূরত্ব সবসময় সমান রাখাটা একটা আর্ট।
গ্রামের মানুষদের একটা অভ্যেস আছে। অভ্যেস টা ভালো নয়। শৌচকর্মের সময় সাবান না থাকলে হাতে কাদামাটি ঘষে সেই হাত পুকুরের জলে ধুয়ে ফেলা। আবার সেই জলই বাড়ির বাসন মাজা কাপড় ধোয়ায় ব্যবহার হয়। আমার বাবা বহু বলেকয়েও লোকজনকে পুকুরে ঐভাবে হাত ধোওয়া বন্ধ করাতে পারেন নি। এই জন্য গ্রামের কোয়ার্টারে থাকতে আমার পেটে খুব কৃমি হত। একবার ভীষণ রক্ত আমাশাও হয়েছিল। ভীষণ রোগা আর কালো ছিলাম। আর পেটটা মোটা ছিল। অবাক করা ব্যাপার, এতে আমার দোষ কিছুই নেই। অন্যদের জন্য, রোগে জর্জরিত ছোটবেলা কেটেছে৷ ভাগ্যিস বাবা ডাক্তার। তাই এখনো বেঁচে আছি।
ফিরে আসি ঘুঁটেতে। গোবরের গন্ধ কেমন অদ্ভুত। হাজার হাত ধুলেও একটা দিন হাতে থাকেই। খাবারে, জলে সর্বত্র গোবর গোবর গন্ধ থাকে।সেই থেকে আমার বিশ্বাস হাত ধোওয়া ব্যাপারটা আমার মজ্জাগত হয়ে গেছে।
কিন্তু সেই গন্ধ কেও মাত করে দিল আর এক গন্ধ। সে হল ফরম্যালিন। ডিসেকশন হলে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত থাকা মৃত মানবদেহ আর কেমিক্যালের মিশ্রণের সে এক অদ্ভুত গন্ধ। না ফরম্যালিনের গন্ধে বমি টমি আসে না। পৃথিবীময় যা কিছু, সবই ফরম্যালিন হয়ে যায়। ডিসেকশনের পর আমাদের লাঞ্চব্রেক হত। প্রথম প্রথম হোস্টেলে এসে কাঁদতে কাঁদতে হাত ধুতাম। এরকম গন্ধ নিয়ে খাব কি করে? এখন বুঝি, ও গন্ধ যার নাকে বসে গেছে, একবার, তার কাছে,রক্ত, পুঁজ, প্রস্রাব, বিষ্ঠা এ সবের গন্ধে কিছু আর যাবে আসবে না।
আই সি ইউ-তে কাজ করতে করতে এখন সন্দিহান হয়ে থাকি। প্রত্যেক বার রোগীকে ছোঁয়ার আগে আর পরে হ্যান্ডরাব ব্যবহার করা তো বহুকাল ধরে শেখানো হয়েছে। খাবার আগে কনুই অবধি হাত ধুই। হাসপাতালের লিকুইড সাবান আর টিস্যু বক্স আর্ধেক খালি করার জন্য লোকে আমায় দায়ী করে এসেছে।
কিন্তু এখন এত রোগের মাঝে থেকেও আমার রক্ত আমাশা হয় না। কৃমি ও না৷
কারণ আমি হাত ধুতে শিখেছি।
কারণ কোন এক কালে আমি ঘুঁটে দিয়েছিলাম।