ভোট দিতে গিয়ে দেখলাম, খাঁকি পোশাকের অতি সাধারণ চেহারার মানুষটির কোমরে পিস্তল, মাথায় টুপি। দৃশ্যটি এমন কোন বিশেষ কিছু নয়। অথচ সেই সাধারণ একটি দৃশ্যই পঁচিশ বছর পর আমার মনের কোন গুপ্ত কুঠুরী থেকে বেরিয়ে এল। মাঝের সিকি শতাব্দী ধরে কত কি তো আমার জীবনে দেখে নিলাম। পঁচিশ বছর আগে যে বাম শাসনের শেষ দেখার কথা আমরা ভাবতেও পারিনি, সেই বাম যুগ একদিন শেষ হল। বিরাট প্রত্যাশা নিয়ে, লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে দিতে একদিন হতাশ হয়ে গেলাম। আর ভোট দিতে যাব না ভাবছি। এমন সময় আবার খোঁজ নিতে হল, ভোটের পুরনো সব কাগজ পত্রের।
২০০২ সালের খবর নিতে হবে। ঐ সময় আমরা ব্যারাকপুরে থাকতাম। প্রথমে খুঁজে দেখলাম, ব্যারাকপুরে শেষ বছর দশেক যে পাড়ায় ছিলাম, সেখানকার তালিকায়। পরিচিত কয়েকজনের নামও দেখলাম। কিন্তু আমার নাম দেখা যাচ্ছে না। এক সময় মনে পড়ল, ঐ ২০০২ সালে থাকতাম অন্য পাড়ায়, ভাড়া বাড়ীতে। কিন্তু সেই পাড়ার নামেই চিনতাম, যে গলি রাস্তার পাশে ভাড়া বাড়ীতে থাকতাম, সেই রাস্তার নাম মনে নেই। কাছাকাছি দুটি গার্লস স্কুলে যাওয়ার আবছা স্মৃতি মনে পড়ে। কিন্তু কোথায়, কি কাজে যেতে হয়েছিল, এতোদিন পর আর মনে নেই।
হঠাৎই মনে পড়ল ঐ পিস্তল নিয়ে ডিউটি করতে দেখা পুলিশ ভদ্রলোকের কথা। আমি তখন ব্যারাকপুরের মহকুমা হাসপাতালে চাকরী করি। হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িতে কয়েকজন কনস্টেবল ডিউটি করতেন। সকলকে ঠিক মনেও নেই। নাম তো কারও জানতাম না। বেশী মনে পড়ে, অমলদার বলা সেই নির্মম রসিকতার কথা। ঐ কনস্টেবলদের সাথে অমলদার মত সিনিয়রদের বন্ধুর মত সম্পর্ক ছিল। একদিন অমলদার সাথে ইমারজেন্সি ডিউটি করছিলাম। এক লম্বা চওড়া চেহারার কনস্টেবল বোধহয় ওষুধ নিতে এসেছিলেন। রুগীর ভিড় ছিল না। অমলদা ওনার সাথে রসিকতা করে একটি গল্প শোনাচ্ছিলেন। অবশ্য রসিকতাটি একটু পলিটিক্যালি ইনকরেক্ট হয়ে যায়। শ্মশানে গভীর রাত্রে এক বৃদ্ধের মৃতদেহ দাহ করতে এসে বিপদে পড়ল। পাঁচ লিটার পেট্রল ঢেলেও আগুন ধরে না। দূরে গাছের তলায় এক সাধুবাবা বসে ছিলেন। সকলে গিয়ে বাবার পায়ে পড়লে, সাধু বাবা সব কিছু মন দিয়ে শুনলেন। তারপর জানতে চাইলেন, উনি করতেন কি? পুলিশের চাকরী করতেন শুনে বললেন, একটা দশ টাকার নোট ভাঁজ করে ওনার বুকের উপর দিয়ে দে, ঠিক চলে যাবেন। অমলদার এই গল্প শুনে পুলিশ ভদ্রলোক দৌড়ে বেড়িয়ে গেছিলেন।
আমি এই তেইশ চব্বিশ বছর পর, কোথায় ভোট দিতে গেছলাম ভাবতে গিয়ে, কোমরে পিস্তল ঝোলানো যে পুলিশের ছবি হঠাৎ মনে পড়ল, তিনি নিতান্তই গোবেচারা চেহারায় একজন মানুষ ছিলেন। ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে সেই গোবেচারা চেহারায় মানুষটিকেই ঐ রকম স্মার্ট সাজ পোশাক পরে ডিউটি করতে দেখে বেশ ভালো লেগেছিল। সেই ছবি মনে থেকে গেছে।
ব্যারাকপুরের সেই গার্লস স্কুলের ভোটার তালিকা থেকে আমার নাম পেয়ে গেলাম।
৬.১১.২৫.










