সারাজীবন ধরেই ডাক্তাররা ছাত্র। একটা মোটা করে গ্র্যাজুয়েশন, পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের দাগগুলো কাটা থাকে বটে, কিন্তু পড়াশোনা করে যেতে হয় সবসময়। ডক্টরস’ ডায়েরি যখন লিখতে শুরু করেছিলাম তখন একটাদুটো উল্লেখযোগ্য ঘটনা লিখে থেমে যাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু “তারপর? তারপর?” -বলে যাওয়ার মতো এতো আগ্রহী পাঠকপাঠিকা পাবো বলে কখনো ভাবিনি। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম যে তাহলে ডাক্তারদের চাকরিজীবন নিয়ে লিখি। লিখতে গিয়ে দেখি আমার চাকরিজীবনের মাঝে সিরিয়ালের কমার্শিয়াল ব্রেকের মতো ছাত্রজীবনও ঢুকে বসে আছে।
থমকে গিয়ে ভাবি বড্ড বেমানান হয়ে যাবে ব্যাপারটা। আবার ভাবি, সারাটা জীবনই তো আমাদের পড়াশোনা -তাহলে চাকরির মাঝের এই ছাত্রজীবন নিয়ে লিখবো না কেন? আর অনেক ডাক্তারই পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করে চাকরির মাঝপথে। পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের পড়াশোনার ধাঁচটা একেবারে অন্যরকম। এই হঠাৎ গজানো ছাত্রজীবন নিয়ে অল্প কিছুটা লিখে এগিয়ে যাবো। আবার চাকরিতে ফিরে যাওয়ার পর না-হয় উঁকি মেরে একবার দুবার এইসময়টা ফিরে দেখে নেবো। ছাত্রজীবন, পরীক্ষার আতঙ্ক, পড়া তৈরি করা, কেস প্রেজেন্টেশন এইসব ভাবলেই পেটের ভেতর একটা অস্বস্তি হয়। তাই মাঝখানের এই তিনবছর নিয়ে খুব একটা জাবর কাটার ইচ্ছে নেই।
খুব অল্প কথায় বলি, জেনারেল সার্জারিতে এমএস করতে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হই। ন্যাশনালের সার্জারি ডিপার্টমেন্ট তখন মণিমাণিক্যে ভর্তি। হেডডিপ ছিলেন প্রফেসর মৃত্যুঞ্জয় মুখার্জি। ছিলেন হিরণ্ময় ভট্টাচার্য, শৈবাল মুখার্জি, উজ্জ্বল ভট্টাচার্য, মঞ্জু ব্যানার্জির মতো দিকপাল সার্জন। ইউরোসার্জারিতে ছিলেন প্রফেসর দিলীপ কর্মকার। প্রফেসর প্লাবন মুখার্জি ছিলেন কার্ডিয়োথোরাসিক সার্জারিতে। মোট কথা এবলে আমায় দেখ তো ওবলে আমায় দেখ। একেকজনের অতলস্পর্শী জ্ঞান।
আমাদের তিনটে ইয়ারের পিজিটিদের সার করে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন ধরতেন মৃত্যুঞ্জয় স্যার। অন্য স্যারেরা ঘিরে বসে থাকতেন। যেন কলোসিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটর যুদ্ধ করতে নেমেছে, বাকিরা দর্শক। সেরিব্রাল কনস্টিপেশন কথাটা সেইসময়ে শুনি। সেই উত্তর পেটে আসছে মুখে আসছে না-র গল্প। আর স্যার শুরু করতেন সার্জারির প্রশ্ন দিয়ে, শেষ হতো অ্যানাটমি, ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রি দিয়ে। মানে সব সাবজেক্টে জ্ঞান না থাকলে কাপড়চোপড় নোংরা হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর স্যার জানতেন না – এমন কিছু বিষয় ছিল না। টুপি দিয়ে বেরিয়ে আসার কোনো রাস্তা ছিলনা।
কিছু দুষ্টুমিও ছিল। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে বেশ রোগীর চাপ ছিল। অনেক বড়সড় অপারেশন জমেও যেতো। স্যারের অনুমতি নিয়ে সেগুলো এমারজেন্সি অপারেশন দেখিয়ে রাতের বেলা করে দিতাম। কোনো রোগী হয়তো গলব্লাডারে পাথর নিয়ে অপারেশনের অপেক্ষায় রয়েছে। তাকে শিখিয়ে নেওয়া হতো যে “অজ্ঞান করা”র স্যার প্রশ্ন করলে বলবে হঠাৎ করে পেটের যন্ত্রণা উঠেছে। এক্সরে ডিপার্ট্মেন্টের দাদাকে সিগারেট দিয়ে ম্যানেজ করতাম। সে এমন একটা ভয়ংকর এক্সরে তুলে দিতো যে কারোর পিতৃদেবের সাধ্য ছিল না সেটা দেখে রোগ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করে। পাকস্থলী ফুটো হলেও এরকম অসাধারণ এক ছবি হতে পারে, না হলেও পারে। রাতে অ্যানাস্থেসিয়ার ডাক্তারবাবুকে সেই মডার্ন আর্টমার্কা এক্সরে দেখিয়ে করুণ মুখ করে বলতাম “স্যার, এর বাঁচা-মরা এখন আপনার হাতে। আপনি অজ্ঞান না করলে বেচারি হয়তো কালকের সকাল আর দেখতে পাবেনা।”
কোনও মহৎ কাজই অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না। হিতেনদা ছিলেন অ্যানাস্থেসিয়া ডিপার্ট্মেন্টের এক নামকরা মেডিকাল অফিসার। অগাধ জ্ঞান। বুদ্ধিতে শার্লক হোমসকে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। একদিন আমার নিয়ে যাওয়া এক্স-রের দিকে না তাকিয়েই ফিক করে হেসে বলেন “কেন কষ্ট করে অন্য ইনসিশন দিয়ে গলব্লাডার খুলবি, ঠিক পদ্ধতিতেই পেট কাট না।” থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম “বুঝলেন কি করে?” ড্রেস চেঞ্জ করতে করতে বললেন “এক -তুই সিগারেট খাসনা, তোর গা থেকে সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছি। দুই, এক্সরে দেখানোর জন্য তোর এতো উৎসাহ কোনোদিন দেখিনি। আর বাইরে তোর পেশেন্টকে দেখলাম ওভার অ্যাক্টিং করছে। ওকে বুঝিয়ে বল পেপটিক আলসার ফুটো হয়ে গেলে পেশেন্ট এতো লাফায় না।” এরপর হিতেনদার দিনে সরাসরি অনুমতি নিয়ে রাতেরবেলা বড়ো অপারেশনগুলো করে দিতাম। উনি প্রয়োজন বুঝে থামিয়েও দিতেন। একদিন একটা রোগীকে দেখে বললেন যে তাকে এমারজেন্সিতে অপারেশন না করতে। পরে নির্দিষ্ট কোল্ড ওটির দিনে পেশেন্টের পেট খুলে বোঝা গেল ক্যান্সার হয়েছে।
আবার অনেক খারাপ এমারজেন্সি অপারেশনও করেছি। কিছুকিছু অপারেশন সারাজীবনের জন্য মনের ওপর ছাপ ফেলে গেছে। চব্বিশ সপ্তাহের প্রেগ্ন্যাসি নিয়ে একটা রোগী গাইনি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি ছিল। পেটে ব্যথার কারণ বোঝা যাচ্ছেনা। আল্ট্রাসাউন্ডে শুধু বলেছে পেটে জলের মতো কিছু জমে আছে। বাচ্চা আছে বলে এক্স-রে করা যাবেনা। তাতে বাচ্চার রেডিয়েশন জনিত ক্ষতি হবে। গায়নাকোলজিস্টদের সন্দেহ নাড়ি ফুটো হয়েছে। সার্জারি ডিপার্টমেন্টে যখন ট্রান্সফার হয়ে এলো তখন রোগীর অবস্থা বেশ খারাপ। নাড়ি ফুটো হলে অপারেশন করতেই হবে। মেয়েটি হাতদুটো জড়িয়ে বললো যে তার এটা প্রথম বাচ্চা। আমি যেন দেখেশুনে অপারেশন করি। দু’ শতাংশ মানুষের পেটে অ্যাপেন্ডিক্সের মতো দেখতে একটা জিনিস থাকে – তার নাম মেকেল’স ডাইভারটিকুলাম। মেকেল’স ফেটে যাওয়া খুব বিরল ঘটনা। আরো বিরল ছ’মাসের প্রেগ্ন্যাসিতে এরকম হওয়া। মেয়েটিকে বাঁচাতে পারিনি। একটা জার্নালে ঘটনাটা লিখে পাঠিয়েছিলাম। ছবি ছিল না বলে তারা ঘটনাটা বিশ্বাস করেনি। জার্নাল থেকে ছবি চেয়ে পাঠিয়েছিল। তখন মোবাইল সদ্য বেরিয়েছে। মোবাইলে ছবি তোলার ব্যবস্থা ছিলনা।
অপারেশন ভালো হয়েছিল। তবে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। অন্তত সপ্তাহখানেক আগে মেকেলস ফেটেছে। অপারেশনের পরে তিনদিন পেশেন্টটি বেঁচেছিল।
তিনদিন পর বাড়ি ফিরেছিলাম। কসবার ভাড়াবাড়িতে। হাউহাউ করে কেঁদেছিলাম।
অনেক ঘটনা, অনেক। একটা ডাক্তারকে ঘটনাগুলো আস্তে আস্তে অনেক কঠিন করে দেয়। এরকম মৃত্যুতে এখন আর চোখ দিয়ে জল পড়েনা, শুধু ভেতরের অনির্বাণ অঝোর ধারায় আকুল হয়ে কাঁদে।
সে কান্নার কাউকে সাক্ষী রাখতে নেই যে।
হিতেনদার ছিল জ্ঞান অর্জনের নেশা। পরীক্ষাতে এত বেশি করে লিখত যে, সব জানা প্র্শ্নের উত্তর লিখতে সময় পেত না। সম্ভবত ডি জি ও-র পর আর কিছু করার চেষ্টা করেনি। করাটা ওর কাছে খুব একটা কঠিন ব্যাপার ছিল না । হিতেনদা আজ নেই, তাই কথাগুলো লিখতে পারলাম।
So far my knowledge goes Hitenda did DNBE , probably in gynae.
Mrityunjay da was RMO when I did MS.
Plaban Mukherjee appeared in ms with me but he failed on the first attempt.
Saibal is now principal of NRS Medical College but when I was asst.professor at r g kar , he was RMO there.
হিতেনদার মৃত্যু সংবাদেে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
আমি ধারাবাহিকটায় আসল নাম ব্যবহার করছিনা। এই পর্বটায় কিছুটা অসাবধানে নামগুলো লিখে ফেলেছি। আসলে করোনার গ্যাপটার প্রভাব। আগে থেকে ভাবা ছকটা ভেঙে যায়। আশা করি যাঁদের নাম উল্লেখ করে ফেলেছি, তাঁদের ব্যক্তিজীবন বিঘ্নিত হবেনা।
ঘটনাগুলো সত্যি। প্রতিটি প্রফেসর সেইসময়ে আমাদের চোখে একেকজন স্তম্ভ ছিলেন। তাঁদের শ্রদ্ধা জানাই।
আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। ??
অনেক ধন্যবাদ দাদা। ??
আপনার ও আগে মানুষ, পরে ডাক্তার,এটা অধিকাংশ লোক কে বোঝানো হয় না। ইচ্ছা করেই। আপনারা ও যে ভেতরে কাঁদেন সেটা কেউ দেখেও না, বোঝেও না। সস্তা দোষারোপ করে।
খুব স্বাভাবিক সত্যি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ??????
খুব ভালো লাগছে পড়তে।
??? অনেক ধন্যবাদ। ???
Valo likhchhis Anirban.Carry on.
ধন্যবাদ রামজীবনদা। ??
খুব ভালো লাগলো আপনার ছাত্র জীবনের গল্প পড়ে,এরকম আরো অনেক গল্প পড়তে চাই, অপেক্ষায় থাকলাম ।
আমার লেখার একনিষ্ঠ পাঠিকা। ধন্যবাদ তোমাকে। ??
খুব সুন্দর লেখেন আপনি ডাক্তারবাবু
অনেক ধন্যবাদ ????☝?
?
লেখার ধরনে এক জাদু আছে যা মানুষকে আচ্ছন্ন করে এবং ভাবায়। আরো পড়তে চাই।
ধারাবাহিকটা এখন মাঝপথে, আরো সাতখানা পর্ব লিখবো। তারপর যদি পূণ্যদা (আমাদের সম্পাদক) বলে তখন ভাবতে হবে।
সাতটা পর্ব আরো বেরোবেই, পূর্বাা। ???
খুব ভালো লাগলো Sir আপনার ছাত্র জীবনের সামান্য একটু অংশ জানতে পেরে।।।?
?