যে কোনও উচ্চ(?)শিক্ষার জন্য আমি যে অনুপযুক্ত ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত বারবার। এই ব্যাপারের জন্য সম্মিলিত ভাবে দায়ী আমার নিম্নমেধা এবং পল্লবগ্রাহিতা। এটা কোনও অতিশয়োক্তি নয়।
এমনকি পড়াশুনোয়ও ডিগ্রি মানে এমডি কোর্স দুষ্প্রবেশ্য হওয়ায় আমাকে ভায়া আদালত ইউনিভার্সিটির চৌকাঠ ডিঙোতে হয়েছে। সেই সব আত্ম অবমাননার কাহিনি অন্যত্র একবার নয় বহুবার বলেছি।
আজ যেটি বলব তা হচ্ছে আমার অন্যরকম শিক্ষাগুরুদের কথা, আমার সাহিত্যগুরুদের কথা, যেটি অদ্যপি সে ভাবে কখনও বলিনি।
আমি গদ্য লিখতে পারি না। তার মানে অবশ্যই এই নয় যে আমি পদ্য লিখতে পারি। কিন্তু পদ্য আকারে ছোটো বলে, অন্যদের থেকে টুকে মেরে দিই। আর পদ্য লোকে এমনিতেই কম পড়ে। তেমন ধরা পড়ে না। এদিকে আমার আবার লিখে যশোলাভের বাসনা ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা।
আমি যে গদ্য লিখতে পারি না সেই স্বতঃসিদ্ধকে অতিক্রম করার বাসনায় আমি কী না করেছি। অনীশ দেবের মত সুভদ্র পণ্ডিত মানুষকে, গদ্য লেখার শর্টকাট শেখার জন্য জ্বালাতন করেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অসীম স্নেহবশে তিনি সহ্যও করেছেন। ফললাভ করিনি। তিনি আমায় বলেছেন, —- অরুণাচল, পদ্য লিখছ, কী আর করা। লেখো। কিন্তু গদ্য লিখো না।
আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি। এই ব্যাপারে অদ্রীশ বর্ধন ত্রিদিব চ্যাটার্জি সহ আরও কতজনকে বিরক্ত করেছি, ইয়ত্তা নেই।
বাংলা ভাষায় গদ্য লেখা শেখানোর ক্লাস সে ভাবে কোথাও হয় বলে শুনিনি। এমন সময় খবর পেলাম গল্প লেখার ওয়ার্কশপ হবে। আমাদের এই কলকাতা শহরেই। ঐতিহ্যবাহী এক প্রকাশনা, আয়োজন করেছেন, দুজন সফল গদ্যকারকে দিয়ে গদ্য লেখা শেখানোর এই ওয়ার্কশপের।
শুনেই লাফিয়ে উঠলাম। এইবার, এতদিনে আমি সুযোগ পেয়েছি। রীতিমতো কোর্স করে ডিগ্রিধারী লেখক হব।
আমাকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অপেক্ষারত দেখে আমার সহানুধ্যায়ী আর মুখচেনা উদ্যোক্তারা তো বটেই আমার নিরীহ শিক্ষক বেচারা দুজনও কেমন যেন ইয়ে হয়ে গেলেন। মানে ভেবলে গেলেন।
ছাত্রছাত্রীরা হয় তো ভাবছিল এই আপদটা ঢুকল কী করে? কী ভেবে? কী করতে এসেছে? ও কি ফ্যালনা? ও কি ফ্যাকাল্টি? নাকি ফ্যাসিস্ট?
দুজন শিক্ষক ছিলেন আমাদের সেই ওয়ার্কশপে। সমুদ্রতট মুখার্জি আর ঈশ্বরদীপ্ত ভট্টাচার্য।
শিক্ষক দুজনই আমার পূর্ব পরিচিত। আমার অতীতের বহু কলম-কিবোর্ড সংক্রান্ত অপরাধের ও অপচেষ্টার সাক্ষী। তাঁরা কর্মজীবনে অনেক যুদ্ধের সফল সৈনিক। দুজনেই সার্থক গদ্য লেখক। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে প্রশাসনিক পদে কাজ করতেন। কাজেই তাঁদের অভিজ্ঞতায় আমার মত বিস্তর ত্যাঁদড় সামলেছেন। কিন্তু এই রকমের একটা সারস্বত পরিবেশে আমি কী গণ্ডগোল পাকাতে এসেছি এইটি ভেবে তাঁরা কি কিছুটা হলেও চিন্তিত ছিলেন?
বিশ্বাস করুন, আমি কিচ্ছুটি গোলোযোগ পাকাইনি। কত কত বিষয় তাঁরা শেখালেন। প্লট ভাবা, প্লটের বিস্তার, পাঠককে আটকে রাখার মত লেখার কৌশল, ভাষার আর চিন্তার বিশুদ্ধতা। তাঁরা দুজন যখন লেকচার দিয়েছেন, কিম্বা পরের ইন্টারঅ্যাক্টিভ সেশনেও আমি টুঁ শব্দটি করিনি। তালে ছিলাম, যদি ডিগ্রির কাগজটা বাগানো যায় কোনওমতে।
ওয়ার্কশপ শেষে হাতেকলমে যাচাই হবে। লটারি করে চিরকুটে লেখা বিষয়াভাস বন্টিত হল। তার ওপরে লিখতে হবে পাঁচশ মতন শব্দের গদ্য, কাহিনি বা অন্য কিছু।
শেষে পরীক্ষা শেষে, কে কদ্দুর হৃদয়ঙ্গম করেছে গদ্য লেখার দুরূহ প্যাঁচপয়জার, সেই খাতা দেখা হল। আমার সামনেই সহপাঠীরা সবাই তারিফ কুড়োলো। কেউ এ প্লাস প্লাস, কেউ শুধু এ, কেউ ডিস্টিংশন। আমার খাতা সম্ভবত ইচ্ছে করেই একদম পরে দেখলেন স্যার।
এটা সম্ভবত যাতে অন্যরা এই ফেলুদার অবধারিত অনুত্তীর্ণ হওয়াটা খেয়াল না করে সেই জন্য।
খাতা দেখার সময়ে আমার চোখে আকুতি ফুটে উঠেছিল নিশ্চয়ই। সেই আকুতি নাকি আমার বয়স ও পাকাচুল, কী জানি ভেবে, আমার খাতা যিনি দেখছিলেন, বললেন, — অরুণাচলদা, যা লিখেছেন বেশ ইয়ে। তবে আমি তো আর প্রফেশনাল টিচার নই। যান পাশই করলেন, ধরে নিন। এই বলে আমার খাতার পাশে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দিলেন সি মাইনাস।
এর পরেও গদ্য লেখা শিখবার এই কুকীর্তি বা অপচেষ্টা যাই বলুন আবারও করেছি। আনাড়ি মাইন্ডস অনলাইন লেখা শেখানোর ক্লাস নিল। https://www.anariminds.com/course/short_story_writing/ সেখানেও গিয়ে ভিড় বাড়িয়েছি। সেই ক্লাসও করেছি।
করে বুঝেছি, আমি বাদল সরকার নই। তিনি ষাট পেরুনো ইঞ্জিনিয়ার, যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র হয়েছিলেন। ছাত্র হয়েও শ্রদ্ধেয় ছিলেন, এমনকি তাঁর শিক্ষকদেরও(শঙ্খ ঘোষ, নবনীতা দেবসেন) কাছে।
একেবারে হালে খোঁজ খবর করে জুটেছিলাম শ্রী অরুণ আইনের কাছে। তিনি ইংরেজির মাস্টারমশাই। আমাকে দ্রুত টাইপ করার প্রকরণ শেখানোর পরেই আমি এই প্রায় সত্তরেও ইংরেজি পাঠে অক্ষম জেনে, একটা শিশুপাঠ্য ইংরেজি বই ধরিয়ে নিষ্কৃতি নিলেন।
আগেও কেউ বলেছেন, এবারেও বুঝলাম, বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় না হলে নাকি, বাংলা গদ্য লেখার স্বপ্ন না দেখাই ভাল।
এই ভাবে,
জীবনানন্দের ভাষায়,
অনেক ঘুরেছি আমি; অফ-লাইন অন-লাইন লেখার জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে…
এবং শেষাবধি,
বুঝেছি, যার আটে হয় না তার আশিতেও হয় না।
আমার প্রত্যক্ষ সাহিত্যগুরুরা, আমার অসফল সাহিত্য শিক্ষকেরা আমার প্রণাম নিন।