আমার এক ডাক্তারদিদি আছে। দিদি শুধু ডাক্তারই নয়, জনপ্রিয় লেখিকাও। বাংলার সব নামকরা পত্রিকায় তার গল্প উপন্যাস প্রকাশিত হয়। দিদি মাঝেমাঝেই বলে, ‘ঐন্দ্রিল, সিরিয়াসলি লেখ। ডাক্তারি জীবনের বাইরে গিয়েও অন্য কিছু লেখ। সব লেখা ফেসবুকে দিস না।’
সব দিদি ভাইকে ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষের কোন কথার প্রতিবাদ করতে নেই। আমিও করি না। শুধু হাসি।
দিদিকে বলতে পারিনা- আমি যা লিখি সেটুকুও আমি নিজে লিখিনা। ডাক্তারি জীবনই ঘাড় ধরে লিখিয়ে নেয়।
বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন চেম্বারে শুনতে হচ্ছে, ‘ডাক্তারবাবু, ভিজিট বাড়ান। নাহলে বড্ড ভিড় হচ্ছে। সামলানো মুশকিল। ভিজিট বাড়ালে আর সবার কাছ থেকে ভিজিট নেওয়া শুরু করলে ভিড় কিছুটা কমবে। আপনার রোজগারও বাড়বে।’
এতদিন ‘করোনা মহামারী চলছে, এই সময় ভিজিট বাড়ানো উচিত নয়;’ এইসব বলে তাদের সামলে রেখে ছিলাম।
গতকাল দাস মেডিকেলে ঢোকার সময় দাসকাকুও একই কথা শোনালেন, ‘ডাক্তারবাবু, হয় ভিজিট বাড়ান; অথবা এখানে সময় বাড়ান। না হলে আমি কোনদিন মারধোর খেয়ে যাব। কিছুতেই সামলাতে পারছি না।’
বললাম, ‘ঠিক সামলাতে পারবেন। আপনি চৌত্রিশ বছর ধরে দোকান চালাচ্ছেন। অভিজ্ঞতার জাহাজ হয়ে উঠেছেন।’
দাসকাকু উদাস মুখে বললেন, ‘চৌত্রিশ বছর বলেই ভয় লাগছে। আগের দিন নাম লেখা নিয়ে যা ক্যাচাল হলো। এই বছরটা ভালোয় ভালোয় কেটে গেলে বাঁচা যায়।’
কথা না বাড়িয়ে রোগী দেখা শুরু করলাম। এসব ক্ষেত্রে ঝামেলা কমানোর একমাত্র উপায় মনোযোগ দিয়ে চটপট রোগী দেখা।
একের পর এক রোগী দেখছি। মাস দেড়েক আগেও সবই প্রায় জ্বরের রোগী দেখতাম। এখন জ্বরের রোগী অনেক কমে গেছে। অন্যান্য রোগীরাও আসছেন। কারো সুগার বেড়ে গেছে। কারো সিস্টোলিক প্রেশার ২০০ ছুঁয়েছে।
রোগী দেখতে দেখতে বেশ একটা ছন্দ এসে গেছে। হাঁটু ব্যথা, কোমরে ব্যথা, হাত- পা জ্বালা সব রোগী দেখা হয়ে গেছে। পেটে ব্যথা, বুকে ব্যথার রোগীও দেখলাম বেশ কয়েকজন। হঠাৎ ছন্দটা কাটলো।
বাইরে দাসকাকু চিৎকার করছেন, ‘একসাথে তিনজন চেম্বারে ঢোকা যাবে না। রুগীর সাথে একজন ঢুকুন। অন্যজন বাইরে থাকুন।’
রোগী ও রোগীর বাড়ির লোক সেটা শুনতে নারাজ। অতএব আমিই পরিস্থিতিতে নাক গলালাম। বললাম, ‘ভেতরে বেশি জায়গা নেই। একজন রুগীর সাথে আসুন। অন্যজন বাইরে থাকুন। নইলে আমার পক্ষে রোগী দেখা সম্ভব নয়।’
ম্যাজিকের মতো সব শান্ত হয়ে গেল। ময়লা ও ছেড়া জামাকাপড় পরা একজন ও তাঁর হতশ্রী চেহারার স্ত্রী খুপরিতে ঢুকলেন। লোকটি একগাল হেসে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, কেমন আছেন? কতদিন বাদে আপনাকে দেখলাম! হাসপাতালে আপনাকে দেখাতাম। মনে আছে?’
কোনোভাবেই মনে রাখা সম্ভব নয়। আউটডোর পিছু গড়ে পাঁচশো রোগী দেখতাম। তাছাড়া হাসপাতাল ছেড়েছি প্রায় দেড় বছর।
তবে সেটা স্বীকার করলে খারাপ দেখায়। এড়িয়ে গিয়ে বললাম, ‘বলুন, কি হয়েছে।’
‘কত কিছু হয়েছে। সব কি আর বলে শেষ করা যাবে? সেসব বলতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে।’
এবার বিরক্তি লাগছে। এগারোটা বাজে। বাড়িতে ইতিমধ্যেই রোগী জমতে শুরু করেছে। সাড়ে এগারোটার মধ্যে বাড়িতে না পৌঁছাতে পারলে খবর আছে।
আমি ওনার হাত থেকে প্রেসক্রিপশনের গোছা নিলাম। সরকারি হাসপাতালের কাগজ। সুগার, প্রেশার, হার্টের অসুখ সব আছে।
আমার লেখা প্রেসক্রিপশনও পেলাম একগোছা। একটু নস্টালজিক লাগছিলো। ঘোর কাটলো ওনার কথাতে। ‘ডাক্তারবাবু, আপনার কাছে আমার একখান অনুরোধ আছে।’
‘বলে ফেলুন।’
‘বারবার আপনাকে ভিজিট দিয়ে তো দেখানো সম্ভব নয়। ভ্যান চালাই। তা যে রোগ বেধেছে, ভ্যান টানতে গেলেই হাঁপ ধরে। তার উপর লক ডাউন একেবারে শেষ করে দিয়েছে।’
শুনে খারাপ লাগলো। বললাম, ‘আপনি টাকা পয়সা খরচ করে চেম্বারে এলেন কেন? হাসপাতালেই দেখাতেন। আমি লিখলে তো সব ওষুধ কিনতে হবে।’
‘ডাক্তারবাবু, আপনাকে কোনো ওষুধ লিখতে হবে না। আপনি শুধু আমাকে, আমার স্ত্রী আর আমার মাকে একবার দেখে দেন। তাতেই আমাদের শান্তি। পানিহাটি হাসপাতালে টানা পাঁচ বছর আপনাকে দেখিয়েছি। এখনো আউটডোরে ঢুকলে মনে হয় আপনি বসে আছেন। এখনই বকা ঝকা শুরু করবেন। মাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। তিনজনের ভিজিট দেওয়ার ক্ষমতা নেই। একজনেরটাই দিতো পেরেছি।
হঠাৎ করে ছেড়ে আসা চাকরিটার জন্য গভীর দুঃখ হলো। যদিও চাকরি জীবনের শেষের বেশ কিছুদিন উচ্চ মহলের চাপে চোখে সর্ষে ফুল দেখেছিলাম- তবু মনে হলো কিছু একটা ভুল করে ফেলেছি।
দরজা খুলে দাস কাকুকে ডাকলাম। বললাম, ‘ইয়ে… কাকু, এর ভিজিটটা ফেরত দিয়ে দেবেন। আর ওই বুড়িকে ভেতরে আসতে বলুন।’
দাসকাকু হাসলেন। বললেন, ‘এরপর দেরি হলে কিন্তু আমায় কিছু বলতে পারবেন না।’
বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে বাবা আসেন। ‘ডাক্তারবাবু, অনেক দূরে বিয়ে হচ্ছে। ওখানে শরীর খারাপ হলে কী করবে? এতো সর্দি কাশিতে ভোগে।’
‘কোথায় বিয়ে হচ্ছে? রায়গঞ্জ? ওখানেই ডাক্তার দেখাবে।’
মেয়েটির দুচোখ জলে ভরে ওঠে। লোকানোর চেষ্টা করে না। আমার আশ্চর্য লাগে। এখনো মানুষ ডাক্তারকে তাঁর একজন প্রিয়জন ভাবে।
আর সেই ভালোবাসা টুকুই আমি লিখে যেতে চাই। যদিও জানি আজ নয় কাল রোগীরা নেগ্লিজেন্সের কেসে আমাকে কোর্টে দৌড় করাতে পারেন। এমনকি শারীরিক নিগ্রহও করতে পারেন।
অগ্নীশ্বর অথবা হাটে-বাজারের দিন আর ফেরত আসবে না। তবু সীমিত ক্ষমতা নিয়ে আমি প্রতিদিনের সুখ- দুঃখ, হাসি- কান্নার গল্প লিখে যেতে চাই।
যেভাবে স্বাস্থ্যক্ষেত্র কর্পোরেটদের দখলে চলে যাচ্ছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ক্রমশ বীমা নির্ভর হয়ে উঠছে, মেডিকেল শিক্ষা বেসরকারি হাতে চলে যাচ্ছে- তাতে পরবর্তী প্রজন্মের চিকিৎসকরা এই অকিঞ্চিত্কর লেখা পড়েও হয়তো রূপকথা ভাববেন।
একদম ঠিক।
আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি…!! …এবং দেখব…!! আপনি লিখুন।থামবেন না।
সত্যিই এবার নিজের কথা ভাবো।