আমি এখন নিউটাউনে। কেন?
রহস্যটা খুলে বলি।
বড় পুত্র শ্রীমান জয় যে হাউসিং কমপ্লেক্সে থাকে, সেখানে আবাসিকদের টেবল টেনিস প্রতিযোগিতা হবে। পিতৃগর্বে গর্বিত পুত্র তাতে আমার নাম দিয়েছে।
টেবল টেনিস? আমি?
আজ্ঞে হ্যাঁ! চেয়ারে সামলে বসুন। ধরে বসুন। পড়ে যাবেন না। মোবাইল যেন হাত অবশ হয়ে পড়ে না যায়। ঠিকই শুনেছেন।
ম্যাজিশিয়ান যেমন আস্তিন থেকে বার করে গোপন তাস, কৃতবিদ্য ছেলে তার প্রতিবেশীদের অবাক করে আস্তিন থেকে বার করে দিয়েছে ষাটোর্ধ গ্রুপের এক বিরল প্রতিযোগী। সেই গ্রুপে মোট প্রতিযোগী এখন তিন আর একে চার।
আসলে ব্যাপারটাকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখা যেতে পারে। অন্য আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত উচ্চাকাঙ্খী বাবার মত ছোটোবেলায় ওকে হাজার কমপিটিশনে নামাতাম। । ওর ভালো লাগা না লাগা, ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা করত না ওর ফ্যাসিস্ট বাবা। হয় তো হাওয়া ঘুরে গেছে। ছেলে বদলা নিচ্ছে সেই তুমুল অন্যায়ের।
অথবা হয় তো ও সত্যিই গর্বিত। ওর বাবা যে কলেজ জীবনে টেবল টেনিস খেলত এই খবর ও শুনেছে ছেলে বেলায়। কিন্তু এই খবরের ভেতরের খবর অথবা ঠিক করে বললে খবরের আগের ইতিহাস, হায়, পুত্রটি জানত না।
বাবাটির খেলাধূলার সেই ইতিহাস কোনওদিনই উজ্জ্বল নয়। প্রি-হায়ার সেকেন্ডারি কোনও খেলাতে এগোয়ইনি সে কখনও। এইবার শহরের কলেজে পড়তে এলো মফসসলের সদ্য যুবক হবে হবে সেই ছেলেটি।
স্বাস্থ্যে অনুজ্জ্বল। অথচ রক্তে বয়সোপযোগী হরমোনের বন্যা বইছে। এই হরমোনাধিক্য কী কেন ও তার ফলাফল বোঝানোটা একটু ইয়ে। সেই হবু যুবক তখন যেন তেন প্রকারেণ লোকের চোখে পড়ার জন্য মনে মনে খুব উন্মুখ।
ফুটবল ক্রিকেট প্রথম শুরুর জন্য বয়স উত্তীর্ণ । আর স্বাস্থ্যও (পড়ুন দম,স্ট্যামিনা ইত্যাদি) উপযুক্ত নয়। কাজেই সে বেছে নিল, টেবল টেনিসের মত একটা ক্ষেত্র। যেটা তার ধারণামতে অপেক্ষাকৃত কম পরিশ্রমসাধ্য, বয়স বেড়ে গেলেও শুরু করা যায় এমন একটা খেলা।
ধারণাটা ভুল ছিল বলাই বাহুল্য। আর সে সেটা কিছুদিন বাদেই বুঝেও গেছিল। এই খেলাও যথেষ্ট পরিশ্রম সাধ্য। শুধু তাই নয় কলা ও কুশলতা, কৌশল আর শারীরিক নমনীয়তাও খুব দরকার। আর তাই এই টেবল টেনিসেও শিশুকাল থেকেই নিবিড় প্রশিক্ষণ দরকার। কিন্তু পল্লবগ্রাহীতা যার স্বভাব, তাকে আটকাবে কে?
দেরি করে শুরু করা এক সিউডো-একলব্যর সাধনা শুরু হল। প্রশিক্ষণ ছাড়াই। তার সাধ ছিল, সাধ্য ছিল না, সাধনা তার চাইতেও কম ছিল বলাই বাহুল্য।
তাই টেবল টেনিসের কলেজ কমপিটিশনেও কোনওদিন ফার্স্ট রাউন্ড না পেরোনো ছেলেটা (যে পরবর্তী কালে আর ছেলে নয়… লোক, লোকত্ব পেরিয়ে প্রৌঢ়, প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে ফিনিশিং রোপের দিকে পা বাড়ানো সিনিয়র সিটিজেন) নিজের সন্তানের কাছে চিহ্নিত হয়ে রইল টেবল টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে।
এহ বাহ্য, প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পর আমার হাতে উঠবে টেবল টেনিসের ব্যাট। অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের মত শুঁকে দেখব পিংপং বল থেকে কর্পুরের গন্ধ বেরোয় কি না। সেই পঁয়তাল্লিশ বছর আগে সত্যিকারের বড় খেলোয়াড়েরা যেমনটি করত!
একেবারেই প্র্যাকটিশ না করে পঁয়তাল্লিশ বছর পর নামলে নিষ্প্রাণ টেবল টেনিসের বোর্ড আর সরঞ্জামও হো হো করে হেসে উঠবে। তাই নিউ টাউনে ছেলের কাছে এসেছি, সত্যি প্রতিযোগিতার আগে মিথ্যে প্র্যাকটিশ করতে। অন্তত দিন তিনেক ব্যাট হাতে প্র্যাকটিশ করে যাতে মূল প্রতিযোগিতার দিনে যথাযথ লোক হাসাতে পারি।
এই নিষ্প্রাণ জবানবন্দীর শেষটুকু বলি।
এই জোর করে সাজতে চাওয়া টেবল টেনিস খেলোয়াড়ের শুরু করার সময়টা। সন ১৯৬৯। ছেলের চারপাশের সময় তখন টালমাটাল। (অবশ্য সময় সব সময়েই তাই। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ কাটতেই চায় না, তারাপদ বলেছিলেন)। এখন যেমন বাজারে চিনা প্রোডাক্টের খুব রমরমা, তখন বাংলার দেওয়ালে দেওয়ালে চিন। চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।
অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণই যেখানে আমার টেবল টেনিসের বৃত্তে প্রবেশের মুখ্য উদ্দীপক, সেখানে চিনা খেলোয়াড়দের অনুসরণ করাই বিধেয়। সেই চিনের খেলোয়াড়রা তখন টেবল টেনিসের দুনিয়া কাঁপাচ্ছে। তারা র্যাকেট ধরে অন্য রকম ভাবে।
সারা বিশ্ব ধরে সোজাসাপটা শেক হ্যান্ড গ্রিপে। চিনারা তখন বেশির ভাগই পেন হোল্ড গ্রিপ। উলটো করে র্যাকেট ধরার গ্রিপ। বেশ অন্যরকম, লোকের চোখে পড়ার মত ব্যাপারটা।
কাজেই প্রশিক্ষণ বিহীন আমিও শুরু করলাম পেন হোল্ড গ্রিপে র্যাকেট ধরা দিয়ে। খেলতে পারি না পারি অন্যরা জানুক আমার জাত আলাদা! বিপ্লব হোক না হোক জীবনের দেওয়ালে লেখা হোক চিনের গ্রিপ আমার গ্রিপ।
এই ইতিহাস কথনের দার্শনিক সত্যিটা হল, পেন হোল্ড গ্রিপে সর্বক্ষেত্রেই আমি ব্যর্থ।
ঠিক মত কলম ধরা হয়ে উঠল না সারা জীবনেও। অথচ ধরতে চেয়েছিলাম একলব্য আমি। আপনারা সাক্ষী!