(এ লেখাটির একটি সংক্ষিপ্ত এবং অনেকটা ভিন্ন ভার্সন সহমন ওয়েবজিনে কয়েকদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে।)
গত ১১.০৯.২০২৩-এ প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম “Global Health’s Dirty Secret: Rich Countries Get Good Medicine, and the Poor Sometimes Get Poison”। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে – “Today, however, India stands accused of distributing death, as its regulators fail to prevent the manufacture and export of substandard medicines. But this isn’t entirely a made-in-India problem. There is a dirty secret in global health: Rich countries get quality medicines; the poor sometimes get poison.” উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শ্রী লঙ্কায় ভারতে তৈরি মেডিসিন ব্যবহার করে ১০ জনের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়েছে এবং এদেশে তৈরি কাশির সিরাপ ব্যবহারের ফলে কিডনি ফেইলিওর জনিত কারণে গাম্বিয়াতে (আফ্রিকা) ৭০ জন এবং উজবেকিস্তানে ২০ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। (WION, জুন ১৯, ২০২৩) ব্লুমবার্গ-এ (জুলাই ১১, ২০২৩) প্রকাশিত একটি ভারতের ওষুধ সম্পর্কে রিপোর্ট করছে – “Poisoned Cough Syrup Killed Kids. Authorities Cut the Investigation Short”।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর পূর্বোক্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে – “The problem lies mainly in regulatory inequities between rich and poor nations. Developed countries have well-funded regulators keeping an eye on the safety and quality of drugs. India’s output, however, is overseen by its Central Drugs Standard Control Organization, an opaque agency that has long faced allegations of mismanagement and corruption. Many developing nations don’t have the resources to properly vet imported medicines.”
সহজভাবে বুঝলে, পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমগুলোর বিশ্লেষণে ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোল অথরিটি বা ওষুধের গুণমানের পরীক্ষক এবং নিয়ামক সংস্থার ক্রিয়াকলাপ অস্বচ্ছ এবং অযোগ্য পরিচালনা ও দুর্নীতি থেকেও মুক্ত নয়। অবশ্য এই সংবাদসংস্থাগুলো আমেরিকার সবচেয়ে মান্য ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকেও রেয়াত করেনি। অর্থাৎ যে ওষুধে মানুষের জীবন বাঁচাবে তার একটি বড়ো পরিসরের গুণমান এবং নিরাপত্তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। এক্ষেত্রে নাগরিকদের কাছে ওষুধ-সংক্রান্ত তথ্য জানার অধিকার থাকা একান্ত আবশ্যক। এবং ডাক্তারেরাও এরকম এক পরিস্থিতিতে অসহায়, কারণ বইয়ে লেখা বিধান অনুযায়ী তারা ওষুধ প্রেসক্রাইব করবে। কিন্তু এর নিরাপত্তা ও গুণমান কে বিচার করবে?
পৃথিবীর সর্বত্র বর্তমান সময়ে দু’পক্ষের বিবাদ ও আন্তঃরাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন বৈষম্য এখন নিতান্ত সাধারণ ঘটনা। আমাদের বিবশ সামাজিক মানসিকতায় বেশ গা-সহা হয়ে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হোক বা মণিপুরে কুকি-মেইতেই সংঘর্ষ কিংবা আসামে অহমিয়া-বাঙালি কাটাকাটি। এর ওপরে রয়েছে নুহ্-তে বা অন্যত্র ‘ভারতের হিন্দু’ বনাম ‘বহিরাগত মুসলমান’-এর নির্মিত দাঙ্গা। তো এগুলো হল দেশ, রাজ্য বা সমাজের চিত্র। কিন্তু মেডিসিনের জগতেও পড়ায় এরকম একটি দ্বিপাক্ষিক বিবাদের জন্ম সমালগ্ন – গত ২ আগস্টে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিলের (ভারতবর্ষের ডাক্তারদের নিয়ামক সংস্থা) জারি করা এক বিজ্ঞপ্তির পরে। বিজ্ঞপ্তিতে বল হয়েছে – ভারতের সমস্ত রিজিস্টার্ড ডাক্তারকে প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক মেডিসিন লিখতে হবে। ব্র্যান্ড-নামের ওষুধ নয়। এবং যদি এর অন্যথা হয়ে তাহলে সাময়িকভাবে ডাক্তারের লাইসেন্সও প্রত্যাহার করে নেওয়া হতে পারে। যদিও ডাক্তারদের সর্ব বৃহৎ সংগঠন আইএমএ এবং অন্যান্যদের চাপে পড়ে আপাতত এ প্রস্তাব মূলতুবি রয়েছে। কবে আবার চালু হবে এখনো নিশ্চিত নয়।
কিন্তু জেনেরিক ড্রাগ বনাম ব্র্যান্ড-নামের (যে ওষুধগুলো বা একই ওষুধ আলাদা আলাদা নামে বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন দামে বিক্রী করে, যেমন জ্বরের ওষুধ ক্যালপল) ওষুধের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিলের নির্দেশিকার পরে সরকারি স্তরে এবং ডাক্তারদের সমাজে নথিবদ্ধ মান্যতা পেল।
শুরুতে আমার অবস্থান পরিষ্কার করে দিই – আমি জেনেরিক নামের ওষুধ লেখার পক্ষে (যেমন ক্যালপলের উপাদান প্যারাসিটামল), কোন ব্র্যান্ড-নামের ওষুধের পরিবর্তে। ভারতে এরকম বহুসংখ্যক ডাক্তার এবং স্বেচ্ছাসেবী, অসরকারি সংস্থা রয়েছে (যেমন পশ্চিমবাংলায় “শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ”) যারা জেনেরিক নামের ওষুধই লিখে থাকেন। কিন্তু এ ওষুধ লেখার ক্ষেত্রে ওষুধের বিজ্ঞানের বিবেচনায় আমার একটি শর্ত আছে – জেনেরিক নামের ওষুধের গুণমান, মানুষের শরীরে ওষুধ কতটা কার্যকরী হচ্ছে, কি পরিমাণ ওষুধ রক্তে মিশে যাবার পরে একটি নির্দিষ্ট সময় জুড়ে ধীরে ধীরে ‘রিলিজড’ হচ্ছে ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, ব্র্যান্ড-নামের ওষুধের সাথে তুলনায় এ ওষুধগুলোর কার্যকারিতা একইরকম থাকছে কিনা, এটাও বিবেচ্য। সাধারণত রক্তে মিশে যাবার পরে যদি ওষুধের সক্রিয় মলিক্যুলের ৯০% কার্যকরী থাকে তাহলে ওষুধটি যথেষ্ট কার্যকরী বলে ধরে নেওয়া হয়।
এখানে মাথায় রাখা দরকার, জেনেরিক ওষুধ ব্র্যান্ড-নামের ওষুধের অন্তত ৩০% বা এর চেয়েও কম দামের হতে পারে। বিভিন্ন গরীব দেশের সাধারণ জনতার জন্য (ভারতও এর মধ্যে পড়ে) এ কারণে জেনেরিক ওষুধ বাস্তবিকই স্বাগত। এবং সমগ্র পৃথিবীর ২০% জেনেরিক ওষুধ তৈরি করে ভারত যেজন্য এ দেশকে “ফার্মেসি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড” বলা হয়। বছরে প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। আবার উলটো দিকও সত্যি। সাধারণভাবে মানুষ অবগত আছেন, ব্র্যান্ড-নামের ওষুধ বিক্রী করার জন্য বিশেষ করে বড়ো ওষুধ কোম্পানিগুলো কিভাবে যাদের ভালো প্র্যাকটিস আছে সেসমস্ত ডাক্তারবাবুদের ‘খুশি’ রাখার চেষ্টা করে। জেনেরিক ওষুধের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন বা ঊপঢৌকনের জন্য যে বিপুল খরচ হয় সেটার সাশ্রয় হয়। ফলে ওষুধের দাম কম রাখা যায়। আরেকটি তথ্যও এখানে বলা দরকার, আমেরিকায় জেনেরিক ওষুধের ব্যবহার, FDA-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সালের ওদের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় ২.২ ট্রিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করেছে।
জেনেরিক ওষুধের ছোট্ট ইতিহাস
আমেরিকায় ১৮৮৮ প্রথম জেনেরিক ওষুধেষ কারখানা তৈরির পর থেকেই ওষুধের গুণমান নিয়ে বিতর্ক এর পেছু ধাওয়া করেছে। গুণমান রক্ষার জন্য আমেরিকার কংগ্রেসে ১৯০৬ সালে ‘ফেডারেল ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাক্ট” চালু হয়। এরপরে ১৯২৮ এবং ১৯৩৭ সালে আরও পরিবর্তন/সংশোধনী আসে। ১৯৩৭-এ Elixir Sulfanilamide-এর (জেনেরিক ওষুধ ছিল) ব্যবহার করার পরে ১০৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এরপরে প্রথমে ফেডারেল ফুড, ড্রাগ অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট চালু হয়। এরও অল্পদিন পরে বিশ্বের মান্য এবং অনেকাংশে নির্ভরযোগ্য স্ব-শাসিত সংস্থা ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) তৈরি হয়। FDA থেকে একটি ওষুধের বাজারে আসার জন্য লাইসেন্স পেতে অত্যন্ত কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পাস করতে হয়।
কিন্তু বিগত কয়েক বছরে FDA-এর পরিচালনা নিয়ে দুর্নীতি, অসাধুতা, অনুমোদন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে এমনকি ঘুরপথে উৎকোচ নেবার ঘটনা এবং ‘বায়োইক্যুইভ্যালেন্স’ ইত্যাদি নিয়ে নান বিতর্কের জন্ম হয়েছে। এখানে বলে নেওয়া দরকার ‘বায়োইক্যুইভ্যালেন্স’ কি। যখন একই উপাদানের দুটি বা তার বেশি সংখ্যক ওষুধের একই উপাদান থাকে এবং শরীরের অভ্যন্তরে একইরকমের প্রত্যাশিত ফলাফল দেয় তাহলে দুটি বা তার বেশি ওষুধের ‘বায়োইক্যুইভ্যালেন্স’ সমান বলে ধরে নেওয়া হয়। জেনেরিক ওষুধের ক্ষেত্রে এটা এক শক্ত মানদণ্ড। নীচের গ্রাফটি থেকে একথা পরিষ্কার হবে আশা করি।
পাঠকদের ডাক্তারি শেখার ভয়ে ভীত হবার কোন কারণ নেই! একেবারে সহজবোধ্য আরও দুটো বিষয় বলি। পারিভাষিক (ফার্মাকোলজি এবং মেডিসিনের ক্ষেত্রে) ভাষায় যাদের AUC এবং Cmax বলা হয়। এগুলোও ওষুধের কার্যকারিতা পরিমাপের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। যেসব ওষুধ বা molecule এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে সেগুলোকে নির্ভরযোগ্য ওষুধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
কিন্তু জেনেরিক ওষুধ নিয়ে ভিন্ন তথ্যও গবেষণায় উঠে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে ক্যাথেরিন এবান-এর লেখা Bottle of Lies: The Inside Story of the Generic Drug Boom। বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু উল্লেখ করা যায় যে নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রে এই পুস্তকটিকে নিয়ে আলোচনার (মে ১৩, ২০২৯) শিরোনাম ছিল “A New Book Argues That Generic Drugs Are Poisoning Us”। একই লেখিকার একই সংবাদপত্রে (মে ১১, ২০১৯) প্রকাশিত উত্তর-সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল “Americans Need Generic Drugs. But Can They Trust Them?”। আমেরিকার মানুষের স্বার্থ মাথায় রেখে ক্যাথেরিন এবান পূর্বোক্ত প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন – “Our drug supply needs one system of regulation that prioritizes both low cost and high quality: an unannounced inspection at every plant that makes drugs for the United States market. Companies or countries that refuse to comply should not be allowed to sell to American consumers. Those consumers deserve to know where their medicines are made, information they get on their cereal boxes and shirt labels.”
সময়ের পরিমাপে জেনেরিক এবং ব্র্যান্ড-নামের ওষুধ
একটি ওষুধ ল্যাবরেটরিতে আবিষ্কৃত হওয়া থেকে বাজারে বিক্রীর জন্য আসা, এ সময়ের ব্যবধান ১০ থেকে ১২ বছর। এর মাঝে পরপর ধাপগুলো এরকম – (১) গবেষণা করে একটি মলিক্যুলকে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় এটা প্রমাণিত হওয়া, (২) গিনিপিগ বা ইঁদুরের ওপরে বেশ একটি দীর্ঘসময় ধরে পরীক্ষা চালানো বিভিন্ন ধরনের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বোঝা এবং এর সমাধানের উদ্দেশ্যে, (৩) ৩টি ধাপে ছোট থেকে বড়ো সংখ্যায় ক্লিনিকাল ট্রায়াল, যেখানে রোগীদের ওপরে এর পরীক্ষা করা হয়। আর আগে ওষুধের ট্রায়ালের জন্য সম্মতি আছে (যদিও এক্ষেত্রে অনেক ব্যবাসায়িক এবং জাতিগত নোংরামি হয়) এরকম ভলান্টিয়ারদের ওপরে ওষুধের পরীক্ষা চালানো হয়, (৪) এরপরে একে পাঠানো হয় আমেরিকার ক্ষেত্রে FDA-এর কাছে, অন্যান্য দেশে স্ব স্ব ড্রাগ কন্ট্রোল অথরিটির কাছে। সেখানে, ধরে নেওয়া যেতে পারে, সবকিছু বিধিসম্মত হলে বাজারে বিপণন করার লাইসেন্স পাওয়া যায়। সবমিলিয়ে একটি ওষুধের বাজারে আসতে ১৫ বছরও লেগে যেতে পারে। খরচ হয়, ওষুধ কোম্পানির দেওয়া তথ্য বা অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে, প্রায় ২ বিলিয়ন বা ভারতীয় মুদ্রায় ১,৬৬,৩0,৫৮,00,000 টাকা। এই বিপুল টাকার খরচ তোলার জন্য একটি ওষুধের পেটেন্ট ২০ বছরের জন্য দেওয়া হয়।
যেহেতু দীর্ঘকালীন ক্লিনিকাল ট্রায়াল ব্র্যান্ড-নামের ওষুধের ক্ষেত্রে আগেই হয়ে গিয়েছে এজন্য জেনেরিক ওষুধের ক্ষেত্রে নতুন করে ক্লিনিকাল ট্রায়াল দিতে হয়না। এতে সময় বাঁচে এবং ওষুধের দাম কম হয়।
কেবলমাত্র দেখা হয় – (১) ব্র্যান্ড-নামের ওষুধের যে সক্রিয় উপাদানগুলো সেগুলো সঠিক মাত্রায় আছে কিনা, (২) একই শক্তি নিয়ে কাজ করছে কিনা, (৩) একই ডোজে, চেহারায় এবং একই পথে শরীরে প্রবেশ করে কিনা (যেমন, ইঞ্জেকশন হলে জেনেরিক ওষুধও ইঞ্জেকশন হতে হবে), (৪) একই রোগে একইভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা এবং ওষুধের প্যাকেটের গায়ে একইরকমের লেবেল থাকছে কিনা, (৫) একই রকমের শক্তি থাকছে কিনা, আবার নিরাপদ কিনা, (৬) ‘বায়োইকুভ্যালেন্স’-এর ক্ষেত্রেও একই রকম কার্যকরী কিনা, (৭) “In order to receive approval for marketing, a generic drug must meet the same batch requirements for identity, strength, purity, and quality and be therapeutically equivalent to the branded product”, এবং, সর্বোপরি, (৭) একইরকমের কঠোর ‘Good Manufacturing Practice” মেনে তৈরি হয়েছে কিনা। উল্লেখযোগ্য হল, জেনেরিক ওষুধের ক্ষেত্রেও, নিয়ম অনুযায়ী, বাজারে আসার আগে ‘বায়োইকুভ্যালেন্স’ সঠিক মাত্রায় বোঝার জন্য অন্তত ১২ জন রোগীর ওপরে ট্রায়াল দিতে হয়।
মোদ্দা কথা হল, পেটেন্ট-এর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে কিংবা স্বল্প দামে দেবার জন্য শুধু জেনেরিক ওষুধ নয়। ব্র্যান্ড-নামের ওষুধে একেক কোম্পানির একেক রকম দামের যে বিপুল পার্থক্য সেটা জেনেরিক ওষুধে থাকবেনা। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, যাহোক করে একটি জেনেরিক ওষুধ বানিয়ে বাজারে বিক্রী করলেই হল। ওপরে বলা সবকটি শর্ত পূরণ করা আবশ্যিক। কিন্তু এগুলো দেখবে কে? কেন্দ্রের এবং রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল অথরিটি সহস্র ছিদ্রযুক্ত – না আছে উপযুক্ত টেকনোলজি বা পরিকাঠামো, না আছে সদর্থক কিছু করার সদিচ্ছা। ফলে জেনেরিক ওষুধের মান কার্যত প্রশ্ন চিহ্নের মুখে। এবং একই সাথে প্রশ্নু উঠবে, জেনেরিক লেখার দায় ডাক্তারের, কিন্তু জেনেরিক ওষুধ তৈরি করার দায়িত্ব বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নয় কেন?
আমার মনে হয় একাধিক কারণ এখানে কাজ করছে – (১) দৈত্যাকৃতি যেসব মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি ভারতে ব্যবসা করে তাদের লবি করার এবং রাষ্ট্রের নীতি প্রভাবিত করার ক্ষমতা আর অর্থের জোরের দরুন তাদেরকে বাধ্য করা যাবেনা জেনেরিক ওষুধ তৈরি করতে, (২) এতদিন পর্যন্ত বিশ্বের বাজারে (বিশেষত আফ্রিকার মতো গরীব দেশগুলোতে) যে কোম্পানিগুলো জেনেরিক ওষুধ রপ্তানি করেছে, তারা এবার দেশের বাজার দখল করতে চায় এবং বিভিন্নভাবে শাসকদলের কৃপাধন্য হবার কাজটি করে চলেছে, (৩) ডাক্তাররা ‘নরম’ টার্গেট – এদের পেটালে, মারলে, মেরে ফেললেও শেষ অব্দি কিছু হবেনা এবং ডাক্তারদের সঙ্গে ক্ষমতার বৃত্তের যোগাযোগ নেই, ফলে ক্ষমতাশূণ্য, এবং (৫) এখন AYUSH-এর ডাক্তারদেরও লাইসেন্স দেবার ফলে তথাকথিত ডাক্তারদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শাসক ক্ষমতাশীন দলের প্রভাব।
ফলে শেষ অব্দি দায় নিতে হবে ডাক্তারদের – ভালো মানের জেনেরিক ওষুধ দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে নিতান্ত প্রয়োজনীয় হওয়া সত্ত্বেও।
পুনশ্চ – পূর্বোল্লেখিত ক্যাথেরিন এবান নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর (“Americans Need Generic Drugs. But Can They Trust Them?”, ১১ জুন, ২০১৯) আমন্ত্রিত প্রতিবেদনে যা লিখেছিলেন তার সারার্থ দাঁড়ায় – (১) “In some instances, deceptions and other practices have contributed to generic drugs with toxic impurities, unapproved ingredients and dangerous particulates reaching American patients. Some doctors have struggled to stabilize patients who became sicker after they were switched from a brand-name to a generic, or between generic versions. A low-cost drug is not a bargain if it doesn’t work.” (২) “Most Americans agree that our drug supply is in crisis. But the crisis they point to is that of cost: brand-name drugs that are unaffordable, because of corporate greed, and a labyrinth of deals between drug makers, drugstore chains and insurance companies.” (৩) “In February 2015, Peter Baker (one of the highest officials of the F.D.A) moved to China, where he found similar data fraud and deception in 38 of the 48 drug plants he inspected. He left the agency this March. Shaken by what he uncovered in his work for the F.D.A.” খেয়াল করতে হবে, এই প্রতিবেদনের নির্যাস হচ্ছে আমেরিকার মানুষ ঠিক ওষুধ পাচ্ছে কিনা, অন্যত্র যাই হোক না কেন।
এসব পর্যবেক্ষণের নির্যাস হচ্ছে, কেবলমাত্র জেনেরিক ওষুধ নয়, বিশ্ব জুড়ে ব্র্যান্ড-নামের ওষুধের ক্ষেত্রেও একই রকম মিথ্যাচার, জুয়াচুরি, নিষিদ্ধ উপাদান ওষুধে মেশানো হামেশাই হয়ে চলেছে। এফডিএর-এর মতো মান্য সংস্থাকেও সন্তুষ্ট করা যাচ্ছে উৎকোচ দিয়ে এবং অন্যান্য ছলাকলার আশ্রয় নিয়ে।
এরপরে একই সংবাদপত্রে (“Our Drug Supply Is Sick. How Can We Fix It?”, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১) প্রতিবেদনে বলা হল – “But in recent years, the generic drug supply has been plagued by problems. Whereas name-brand drugs can be so expensive that people can’t afford them, generics are often so cheap that companies stop making them or cut corners to turn a profit. Competition for market share at rock-bottom price points has led to chronic shortages, unpredictable price-spikes, allegations of illegal price-fixing, and substandard and even dangerous practices. Production of generics has shifted overseas, where it’s harder for the Food and Drug Administration to inspect factories.”
ওষুধের ব্যবহার নিয়ে এবং কোন ধরনের ওষুধ লেখা হবে এ ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে আলোচনা করতে হলে এসমস্ত বিষয়ই আমাদের মাথায় রাখতে। তথ্য জানার অধিকার আইনে নাগরিকদের কাছে সমস্ত তথ্য উন্মোচিত করতে হবে। “স্বচ্ছ ভারত” এবং “মেক-ইন-ইন্ডিয়া”-র স্বচ্ছতা এবং ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য এগুলো নিতান্ত জরুরী।
এটা খুব সত্য কথা দারুন লিখেছেন এটার সাথে আমিও সহমত
Informative ! Unfortunately, target readers most often fail to excercise their right to know and act accordingly! Thanks for sharing !!
খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা। আমাদের ক্রেতাদের উপকৃত করবে। পাশাপাশি লেখক যে, জেনেরিক ওষুধে ব্র্যান্ডেড ওষুধের মতো উপাদানগুলি একই মাত্রায় আছে কিনা এবং একই শক্তি আছে কিনা তা দেখার কথা বলেছেন সেটাও জরুরি। কারণ জেনেরিক ওষুধ কম কাজ করে এমন অপপ্রচার ইচ্ছে করে করানো হয়। বড় কোম্পানির ওষুধ, ব্র্যান্ডেড দোকান থেকে কেনা ওষুধ অধিক কার্যকরী এমন মিথ্যা ধারণা আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
এমন এক মূল্যবান লেখার জন্য লেখক এবং পত্রিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
রুগী ওষুধ যাচাই করবে ডাক্তার কি ওষুধ লিখেছে পড়তে পারলে তো।
The world is a pharmacy of corruption. Countries like India with a burgeoning population suffer more.One important thing is that many doctors dismiss the need to treat patients with dignity and respect their right to information about their ailments, treatment and medicine.
Others are so respectable in their ways and maintain high ethical standards.
Like everything else doctors are both victims and perpetrators or passively complicit in a capitalist system that only guns for profit.
But we need to talk and I feel comforted that an insider has raised these issues.
অসাধু ব্যবসায়ীরা অসাধু ডাক্তারদের উৎকোচায়িত করে’ যকৃৎ এবং বৃক্কের অপ্রয়োজনীয় বহু ওষুধ লেখাচ্ছে।
জ্বর বা কাশি হলেই জীবানুনাশক ওষুধ লেখার কথা গোয়েব্যল্সীয় নীত্যানুযায়ী লিখতে বাধ্য করছে।হয়তো এসব ক্ষেত্রে ক্রেতা সুরক্ষা আইনের অবদান চল্লিশ শতাংশ।
অগ্রজ জেনেরিক বা সংস্থার নামাঙ্কিত ওষুধের থেকেও অধিক ক্ষতিকর এই অদ্ভুত অশিক্ষার বৃত্ত।শতকরা আশী ভাগ মানুষ(সম্ভবতঃ শতকরা ভাগ আরও বেশী) জেনেরিক বা ব্র্যান্ডেড ওষুধ সম্পর্কে অবহিত নয়।
ব্র্যান্ডেড মেডিসিনের প্রাইস কন্ট্রোল যথাযথ হলে মনে হয় সমস্যার প্রকৃত সমাধান হত… কারন ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি এখন প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান করে।
Vell well composed,enriched by ur presentation Jayanta da.
> কেন্দ্রের এবং রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল অথরিটি সহস্র ছিদ্রযুক্ত – না আছে উপযুক্ত টেকনোলজি বা পরিকাঠামো, না আছে সদর্থক কিছু করার সদিচ্ছা।
এই অভিযোগের সমর্থনে লেখক কোন তথ্য পরিবেশন করেননি, ফলে আমরা যদি বলি সদিচ্ছা আছে না নেই ব্যাপারটি তর্কসাপেক্ষ, লেখক কিছু বলতে পারবেন না, বিশেষত যেকালে ইচ্ছা না থাকলে CDSCO র তরফে তদন্ত হত না।
আসলে ভারতে সমস্যাটি ভাগের মা গঙ্গা না পাবার মত হয়েছে, এক তো কেন্দ্রের এক রকম নিয়ম, রাজ্যের এক রকমের পদ্ধতি, যার জন্য কোথাও সমন্বয় হয় না।
কাশির সিরাপের ব্যাপারটা পর্যালোচনা করলে দেখবেন যে এরা ওষুধে এথিলিন গ্লাইকল মিশিয়েছে কিন্তু সে গ্লাইকল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের পদার্থ, যার জন্য ওষুধ হয়ত তৈরী হয়েছে, তবে সে ওষুধ শিশুর শরীরের ওজন সাপেক্ষে ভয়ঙ্কর রকমের বিষাক্ত। এখন প্রশ্ন উঠবে এইরকম ভয়ঙ্কর রকমের বিষাক্ত একটি পদার্থ দেওয়া হল কোন যুক্তিতে, তার অবধারিত উত্তর দাম কমিয়ে রাখতে হবে তো, ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের গ্লাইকল ফারমাসিউটিকাল গ্রেডের তুলনায় সস্তা, আরে বাবা, একই তো কেমিকাল যাহোক, আমরা সস্তায় ওষুধ দিই, গ্রাহক তো তাই চান।
এবার এই অনিয়ম দেখবে কে? হিমাচল প্রদেশের কর্তারা না জম্মুর কর্তারা, না কেন্দ্র? এবং কখন?
আরেকটা ব্যাপার।
পেটেন্ট কুড়ি বছর বলবৎ করার আইন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ভারত ফার্মাসিউটিকালের ক্ষেত্রে তাকে কমিয়ে পাঁচ বছরে নামিয়েছে, যার জন্য রিভারস ইন্জিনিয়ারিং করে ওষুধ সস্তায় তৈরী করে ভারতীয় ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানীগুলো বিশ্বের ফার্মাসিস্ট হয়েছে।
সব ওষুধের জেনেরিকস সম্ভব নয়, এবং বহু চিকিৎসক তাঁদের অভিজ্ঞতাপ্রসূত কারণে হয়ত নাম করা ওষুধ লেখেন, তাছাড়া বহু গ্রাহক ও pharmacist নামী ওষুধ থাকলে জেনেরিক ওষুধ কিনতে চান না, কাজেই সব দায় ডাক্তারের ঘাড়ে চাপালে চলবে কেন?
বাংলাদেশে জাতীয় ওষুধ নীতি ১৯৮২র পর থেকে দেশী ওষুধ কোম্পানিগুলো ভালো করতে থাকে। আমার জানামতে ২৮৪টি কোম্পানি দেশের চাহিদার প্রায় ৯৮% ওষুধ দেশেই তৈরি করছে।তবে ভ্যাক্সিন, ইনসুলিন এধরনের কিছু ওষুধের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের দেশের উপর নির্ভর করতে হয়। আবার র ম্যাটেরিয়াল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। মূলত ভারত এবং চীনের উপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ র ম্যাটেরিয়াল আমদানির জন্য। বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ এর মান নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেক। যদিও কয়েকটা কোম্পানি বিদেশেও ওষুধ রপ্তানি করছে কয়েক বছর ধরে। কয়েকটা কোম্পানির প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশেও ওষুধের তদারকি সংস্থা আছে, কিন্তু সীমিত লোকবল নিয়ে তারা সব ওষুধ কোম্পানিগুলোকে তদারক করতে পারে না।সরকারি তথ্যমতে এখন বাংলাদেশে ২৮৪টি ওষুধ কোম্পানি আছে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ২৫/৩০টি কোম্পানির উপর সাধারণ মানুষের আস্থা আছে। এই ২৫/৩০টি কোম্পানি নিজেদের ব্যবসায়ীক স্বার্থে ভালো মানের ওষুধ তৈরির চেষ্টা করে। সম্ভবত ২০৯টি “জীবন রক্ষাকারী ওষুধ” এর একটা সরকারি তালিকা আছে। ওই ওষুধগুলোর সরকার নির্ধারিত দামের বেশি দামে কোন কোম্পানি বিক্রি করতে পারে না। কিন্তু এই তালিকার বাইরের ওষুধগুলো আবার কোম্পানি গুলো উচ্চমূল্যে বিক্রি করে। তবে ওভারঅল সিচুয়েশন দেখলে বলা যায় ওষুধের দাম বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আছে আর নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানি কোয়ালিটি এনশিওর করে থাকে। কিন্তু দেশের একটা বড় অংশ শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে লো কোয়ালিটি ওষুধ কিনছে।
You have explained all the drawbacks of medicine maker & checker to the points like bright glass. Lot of thanks for true writing
ঠিক বলেছেন, ডঃ ভট্টাচার্য। উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে সংঘাত শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক বা জাতীয় বিশাল মুনাফালোভী কোম্পানীগুলোর সাথে জেনেরিক ঔষধ উৎপাদকদের সাথে তা আর সুস্থ্য নেই বলে আশঙ্কা করা যেতে পারে কারণ জেনেরিক ঔষধগুলির মান পরীক্ষা হচ্ছে কিনা এবং হলেও সঠিক পদ্ধতিতে হচ্ছে কিনা সন্তোষজনকভাবে জানা যাচ্ছে না। তাছাড়া সঠিক পদ্ধতিতে এত ঔষধের মান নির্ণয় করার ব্যবস্থাও আমাদের দেশে বা কোন দেশে আছে কিনা জানা নেই। এই আশঙ্কা দুদলেরই তৈরী ঔষধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাছাড়া উৎপাদিত ঔষধ যে রাজ্যে তৈরী হচ্ছে সেখানে পরীক্ষিত হচ্ছে, অন্য রাজ্যে ঢোকার সময় যদি ওগুলো পরীক্ষিত না হয় তবে মাঝপথে নিম্নমানের ঔষধ ঢুকে যেতে পারে।