৩৭০ ধারা বিলোপে সুপ্রীম কোর্টের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী হ্যাশট্যাগে ‘নয়া জম্মুকাশ্মীর’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। ‘নয়া কাশ্মীর’ নাকি তৈরি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে, এরকমই দাবি শাসকদল ও প্রচার মাধ্যমের। তবে, এই ‘নয়া কাশ্মীর’ কথাটার একটা ইতিহাস আছে। ১৯৪৩ সালে ডক্টর কানোয়ার আসরাফ শ্রীনগরে আসেন সোভিয়েত রাশিয়া ঘুরে এসে। দেখা হয় ন্যাশনাল কনফারেন্সের শেখ আবদুল্লাহ্ ও তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে, যাঁদের মধ্যে জি.এম.সাদিক, সৎপাল সাহনির মতো অনেকেই প্রগতিশীল ও বামপন্থী ছিলেন। তিনিই প্রথম প্রস্তাব করেন সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে ‘সংবিধান’ রচনা করতে। একটা সনদ তৈরি হলো, যা পরের বছর মহারাজ হরি সিং-এর কাছে পেশ করা হয়, মহারাজা ‘ইম্পেরিয়াল ওয়ার কেবিনেট’-এর মিটিং-এর পরে ফিরে এলে। এই সনদের খসড়া ও পরে চূড়ান্ত রূপদানে যাঁদের প্রধান ভূমিকা ছিল, তাঁদের অন্যতম হলেন অভিনেতা কবির বেদির বাবা-মা, বাবু পেয়ারেলাল বেদি ও তাঁর ব্রিটিশ স্ত্রী ফ্রেডা, বামপন্থী এন.এন. রায়না ও প্রেমনাথ বাজাজ ; সম্ভবতঃ টাইপ করেছিলেন ফ্রেডা তাঁর লাহোরের বাড়িতে। ‘নয়া কাশ্মীর’ সনদে রাজাকে শীর্ষ পদে রেখে ব্যাপক গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি রাখা হয় যেখানে কৃষক ভূমির অধিকার, শ্রমিক তার শ্রমের মর্যাদা এবং মহিলারা সমাজে তার প্রাপ্ত সম্মান ও অধিকার অর্জন করতে পারে। বস্তুতঃ, ন্যাশনাল কনফারেন্সের কাছে কাশ্মীরের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির কোনও অপসন ছিল না, কারণ তারা ভালো করেই জানতো এই দাবিগুলোর বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা পাকিস্তানে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং, হয় সম্পূর্ণ স্বাধীনতা না হয় ভারতভুক্তি। কাশ্মীরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহায়তায় পাখতুন হানার পরে পছন্দের অপসন আরও সীমিত হয়ে পড়ে।
কাশ্মীরের ভারতভুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য জওহরলাল নেহেরু ও বল্লভভাই প্যাটেলেরর সঙ্গে কথা বলতে যান যে প্রতিনিধিদল তার শেষ জীবিত সদস্য কমিউনিষ্ট পার্টির (CPI) কৃষাণ দেব শেঠি জানিয়েছেন, তাঁরা রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি, ভূমি সংস্কার, কৃষি ঋণ মকুব, আলাদা কারেন্সী, নিজস্ব ফ্ল্যাগ/পতাকা, এই পাঁচ শর্ত রাখেন। তার মধ্যে আলাদা কারেন্সী ছাড়া বাকিগুলোতে সহমত প্রতিষ্ঠিত হয়। কাশ্মীরের স্বতন্ত্র পতাকায় লাল পটভূমিকায় সাদা লাঙল, শ্রমিক ও কৃষকের সংহতির উদ্দেশ্যই, তার সঙ্গে লম্বালম্বিভাবে তিনটি সমান্তরাল সাদা সরলরেখা জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখের জন্য নির্দেশিত। এই সমাজতান্ত্রিক চেতনা থেকেই শ্রীনগরের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের নামকরণ হয় ‘লাল চক’, ‘রেড স্কোয়ার’-এর অনুসারে….
১৯৫০ সালে, ‘নয়া কাশ্মীর’-এর কর্মসূচি অনুযায়ী জারি হয়, Big Landed Estate Abolition Act, ব্যক্তি অধিকারে থাকা ২২• ৫ একরের উপর জমি অধিগ্রহণ করা হয় বিনা ক্ষতিপূরণে। ‘৫৩ সালের মধ্যেই ১৯২৬৫২ একর বিলি করা হয় ১৬০৯৩৯ জন কৃষকের মধ্যে। এপ্রিল ‘৫৩ এর মধ্যে ভূমিহীন ও ক্ষেতমজুরদের মধ্যে বিলি করা হয় ৮৭৫০০ একর খাস ও পতিত জমি। এক দশকের মধ্যে ৯ হাজার ভূস্বামীর কাছ থেকে অধিগ্রহণ করা হয় সাড়ে চার লক্ষ একর জমি। আর,এই সমস্ত কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন মির্জা আফজল বেগ, ন্যাশনাল কনফারেন্সের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, যিনি নিজে আবার ছিলেন এক বৃহৎ ভূস্বামী পরিবারের সন্তান। গড়ে প্রতিটি কৃষক পরিবার পায় সওয়া এক একর চাষের জমি। ৩৭০ ধারা ছাড়া ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকে এই আইন কার্যকরী করা কি আদৌ সম্ভবপর ছিল? রাজ্য বিধানসভায় পাশ হবার পরে রাজ্যপাল, রাষ্ট্রপতি আবার তারপর কোর্টের স্থগিতাদেশ…..পঃ বঙ্গ, কেরালায় এই অভিজ্ঞতার তো অভাব নেই। বর্তমানে কেরালার অচলাবস্থা তো সুপ্রীমকোর্টও সমাধানে অপারগ।
১৯৭৬ সালে Agrarian Reform Act ’76-এ জমির সর্বোচ্চ সীমা ২২•৫ একর থেকে কমিয়ে ১২•৫ একর করা হয়। বাস্তবিকপক্ষে, ভূমিসংস্কারে জম্মু কাশ্মীর ভারতবর্ষের অগ্রগণ্য রাজ্য..।
ফলতঃ, কাশ্মীরে উগ্রপন্থা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বিপর্যস্ত অর্থনীতি, এসব সত্ত্বেও দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকা মানুষের শতাংশ চিরকালই জাতীয় গড় থেকে অনেকটাই কম। ৩৭০ধারা বিলোপের সপক্ষে রাজ্যসভায় বক্তৃতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, ৩৭০ ও ৩৫ এ ধারা কাশ্মীরকে সারা দেশের থেকে পেছিয়ে রেখেছে। একে চ্যালেঞ্জ করে অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ দেখান বিবিধ নিরিখে জম্মু ও কাশ্মীর কিভাবে গুজরাট থেকে এগিয়ে, “In almost any economic and social indicator, Jammu and Kashmir is way ahead of Gujarat.” ২০১১-১২ ও ২০১৫-১৬ সালের বিভিন্ন পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তিনি দেখান, immunisation, under five mortality rate, total fertility rate, percentage of girls with eight years of schooling, underweight children, women with low BMI, average life expectancy, wages of rural labourers, rural poverty…..সব দিক থেকে কাশ্মীর, ‘গুজরাট মডেল’-এর অনেকটাই উপরে রয়েছে৷
কারণ হিসাবে তাঁর বক্তব্য, “extensive land reforms in the 1950s…….It is Article 370 that made these land reforms possible. ” তাঁর পরিষ্কার অভিমত জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক স্বাতন্ত্র্য ছাড়া ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকে জমি অধিগ্রহণ কখনোই সম্ভবপর ছিল না।
তাঁর মতে,”The basic point is that Jammu and Kashmir had it’s own Constitution, making it possible to expropriate the big landowners and redistribute their land without compensation. Under the Indian Constitution, that would not have been permitted. …….
Radical land reforms in J & K were immensely popular and laid a lasting basis for a relatively prosperous and egalitarian rural economy, with very low poverty rate by Indian standards………
Beyond land reform, government policy in J & K before 1956 (when the Constitution of J & K was ratified) was strongly influenced by Naya Kashmir, the socialist manifesto adopted by National Conference in 1944.”
সুপ্রীম কোর্টের রায়ে জম্মু কাশ্মীরের স্বতন্ত্র সংবিধান ও পতাকারও বিলুপ্তি ঘটেছে। ইদানীং কালে বারে বারে অভিযোগ উঠেছে কেন একটা রাজ্যের আলাদা পতাকা বা সংবিধান থাকবে? যদিও স্বাধীনতার পরে সমস্ত রাজ্যকেই এই অপসন দেওয়া হয়েছিল! আচ্ছা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে তো প্রত্যেকটি স্টেটে আলাদা সংবিধান আছে, নিজস্ব আলাদা আইন আছে, শুধু স্টেট নয় বিভিন্ন কাউন্টি, নগর বা মিউনিসিপালিটি এর পৃথক পতাকা আছে! তার জন্য তো সেখানে কোনও আকাশ ভেঙে পড়ে নি!! তাহলে??
বাস্তবিকপক্ষে, শুধু কাশ্মীর কেন প্রত্যেকটি রাজ্যেরই স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্ব পরিচালনার সুযোগ এবং সেই সঙ্গে বিবিধ রক্ষাকবচের অবশ্যই প্রয়োজন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পঃ বঙ্গের এই অধিকার থাকলে তো আর মাসুল সমীকরণ নীতি এত সহজে কার্যকর হতে পারতো না, এবং উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে অনেক সদর্থক ভূমিকা সম্ভবপর ছিল; আর পরবর্তী কালে ভূমিসংস্কারে আইনী পদক্ষেপ অনেক সহজ হতে পারতো!!
এক দেশ, এক আইন, এক নিয়মই যদি শিরোধার্য হয়, তাহলে আর আলাদা প্রদেশ বা রাজ্য থাকার দরকার কি, এতগুলো আইনসভারই কি প্রয়োজন?? সব কটা রাজ্যকেই বরং সরাসরি ‘কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল’-এ রূপান্তরিত করে দিন,অগ্রগমন ঘটবে অতিশয় দ্রুত গতিতে!!
কাশ্মীরে ৩৭০ ধারাকে দুর্বল করার কাজ শুরু হয়েছে ‘৬০এর দশক থেকেই। দিল্লির অঙ্গুলিহেলনে বারে বারে শাসক পরিবর্তন হয়েছে, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে, স্থানীয় শাসককুলকে ইচ্ছাকৃতভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত করা হয়েছে অথবা হতে সাহায্য করা হয়েছে….এ সমস্ত কিছুই ভীষণভাবে সত্যি!! কিন্তু ৩৭০ ধারার ক্রমদুর্বলতা সত্ত্বেও, কাশ্মীরের জমি সংক্রান্ত আইনগুলি এবং ৩৫ এ ধারার কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের বিভিন্ন রক্ষাকবচের ফলে, জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ এত হিংসা, সন্ত্রাস, হত্যা পেরিয়েও কিছুটা হলেও নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পেরেছিলো। ৩৭০ধারা বিলোপের সঙ্গে ৩৫ এ ধারাও অতীত! বস্তুতঃ, জম্মু ও কাশ্মীর আজ উন্মুক্ত, অবারিত একচেটিয়া পুঁজির লুন্ঠনের সামনে, আর এখানে জম্মুর অবস্থা কাশ্মীরের থেকেও বেশি বিপজ্জনক। ৫ই আগষ্ট, ২০১৯-এর পরে, ৩৩৪ টি state law-এর মধ্যে ১৬৭টি বাতিল হয়েছে সরাসরি; ভূমি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন বাতিল হয়েছে ১২টি, সংশোধিত হয়েছে ১৪টি। ঐ বছরেই ১৮ই সেপ্টেম্বর থেকে ২১শে অক্টোবর এর মধ্যে মাত্র চারটি মিটিংয়ে দ্রুত পাশ করিয়ে নেওয়া হয় ১৯৮টি প্রজেক্ট, যার মধ্যে অনেকগুলিই পরিবেশ সম্পৰ্কীয় সংবেদনশীল!!
‘নয়া কাশ্মীর’ ছিল শেখ আবদুল্লাহ্ ও তাঁর সহযোগীদের স্বপ্ন, আর কাশ্মীর রাজ্য হিসাবে ছিল সদ্যস্বাধীন ভারতবর্ষের কাছে এক চ্যালেঞ্জ স্বরূপ যে সংখ্যালঘু প্রধান রাজ্যও এখানে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সক্ষম! না, সে চ্যালেঞ্জ আমরা রক্ষা করতে পারিনি, আর স্বপ্নেরও অপমৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই।
এই ৩৭০ ধারার বিলোপ, সর্বোচ্চ আদালতে তার স্বীকৃতি ও সাময়িকভাবে হলেও একটা রাজ্যকে ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’-এ রূপান্তর হলো সে বিষয়ে সর্বশেষ বা চূড়ান্ত আঘাত…..!