‘সকালে কাগজ না পড়লে বাহ্যে হবে না ঠিকঠাক’ — কথাটা বলতেন আমার ন’জ্যাঠা।
আজ কাগজওয়ালার দেরি দেখে স্মৃতিতল থেকে বহু বছর আগের সেই কথাটা ভুস করে ভেসে উঠল হঠাৎই। জ্যেঠুকে যে বয়সে এই কথাগুলো বলতে শুনেছি, সেই বয়স ছুঁয়ে, তাকে পেরিয়ে চলে এসেছি অনেকদিন। সকালের কাগজ সময়ে না পেলে আমারও মনে হয়, এতক্ষণ উঠেছি ঘুম থেকে — অথচ দাঁতটাই যেন মাজা হয়নি এখনো।
কাগজ পড়ার অভ্যেস ধরিয়েছিল বাবা। ঠিক প্রাণের আনন্দে নয়, ফেল করার ভয়ে ধরেছিলাম ইংরেজি খবরের কাগজ। কারণ ক্লাস এইটে, ইংরেজি ভাষাটিতে আমি ছিলাম মিশনারি কনভেন্ট স্কুলের পক্ষে বেমানান রকমের কাঁচা।
বাবা বলেছিল, এডিটোরিয়াল পেজ আগে পড়বি, তারপর খবরের পাতা। সে যে কোনো খবর হোক — রাজনীতি, খেলাধুলো থেকে ফিল্ম সমালোচনা, যা পাবি পড়বি। যে শব্দগুলো অপরিচিত লাগবে সঙ্গে সঙ্গে ডিকশনারি কনসাল্ট করে নিবি, নয়ত ভুলে যাবি পরে।
এইসব জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার পরে আমার অনিচ্ছুক হাতে তুলে দিয়েছিল দ্য স্টেটসম্যান।
প্রথম প্রথম একফোঁটা ভাল না লাগলেও প্রাণের দায়ে পরিচিত হতে শুরু করেছিলাম অশ্রুতপূর্ব কিছু নামের সঙ্গে — সুনন্দ কে দত্তরায়, মিনু মাসানি, সোমা এ চ্যাটার্জি। কাগজের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তাম কিশোর ভিমানির খেলার কলাম — কারণ, গাভাসকার, শাস্ত্রী, সন্দীপ পাটিল তখন কৈশোরের দিবাস্বপ্নের অনেকটা দখল করে রাখতেন।
সঙ্গে চলত আনন্দবাজার পড়া — স্টেটসম্যানের বিজাতীয় পাঠ শেষ করে ওটা পড়তে পারাটা ছিল কেতাদুরস্ত রেস্তোরাঁয় অনভ্যস্ত কাঁটাচামচে খাওয়ার পরে হাত দিয়ে মাংসভাত মেখে খাওয়ার মতো স্বচ্ছন্দ রসাস্বাদন।
সেখানেও খেলার পাতা টেনে রাখত অনেকটা মনোযোগ। আর হাঁ করে গিলতাম জমজমাট সাজপোশাকে সজ্জিত পাতাজোড়া সাদাকালো চিৎপুরী যাত্রার বিজ্ঞাপন।
১৯৮৪ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর আকস্মিক অপমৃত্যুর পরবর্তী ক’দিনের ডামাডোল থিতু হয়ে আসার পরে একদিন স্কুলে গিয়েছি।
মিডলটন রো-য়ের লোরেটো হাউসে হায়ার সেকেন্ডারির সায়েন্স সেকশনে ইংরেজির দিদিমণি ছিলেন মিসেস দাশগুপ্তা। দস্তুরমতো ব্রিটিশ ইংলিশ উচ্চারণে অভ্যস্ত, ঈষৎ পৃথুলা, গোল্ডেন রিমের চশমাশোভিতা প্রসাধনহীন, প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী এই ব্রাহ্ম মহিলাকে আমরা গোটা সায়েন্স সেকশন ভীষণ সমীহ করে চলতাম।
সেদিন ক্লাসে এসেই তিনি সময়োচিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর হত্যা এবং দিল্লির নির্বিচার শিখ নিধনের ঘটনায় গভীর মর্মবেদনা প্রকাশ করলেন।
আমরাও সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা থেকে আহরিত নানা সম্ভব অসম্ভব সমাচার পেশ করতে লাগলাম ওঁর সামনে। কে কিরকম ভাবে সেইদিন বাড়ি ফিরেছি, কোন কোন অঞ্চলে কি কি সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি, প্রধানমন্ত্রী ঠিক কি রকম করে মারা গেলেন, তার হাতে গরম খবর ইত্যাদির আদানপ্রদান আরম্ভ হয়ে গেল ইংরেজি ক্লাসে।
তারপরেই মোক্ষম প্রশ্ন করলেন মিসেস দাশগুপ্তা — এই কয়েকদিনে তোমরা কে কে কোন কোন খবরের কাগজ পড়েছ?
সমস্বরে উত্তর এলো — দ্য টেলিগ্রাফ। সারিহা, সুমিতা, আমার মতো সংখ্যালঘু কিছু মেয়ে জবাব দিয়েছিল — স্টেটসম্যান।
বাঁ দিকের ভুরুটা চশমার রিমের উপর দিয়ে তুলে অনুমোদনসূচক সুরে বলেছিলেন আমাদের শিক্ষিকা —Responsible readership is also essential, just like responsible journalism.
তখন কথাটার মানে সেভাবে বোধগম্য হয়নি। আজ ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সন্দেশখালির ‘সম্ভাব্য’ নিগৃহীতাদের মুখ ঢেকে গণপরিসরে বিচার চাইতে আসার লাইভ টেলিকাস্ট দেখতে দেখতে মিস-এর সেদিনের কথার অর্থ ভালভাবেই অনুধাবন করতে পারি।
রাইট টু ইনফরমেশন নিশ্চয় জরুরি, কিন্তু সেই ইনফরমেশন পাঠক/শ্রোতা কিভাবে আত্মস্থ করবে, তার প্রতিক্রিয়ায় কি কি ঘটিয়ে ফেলতে পারে, সংবাদদাতা হিসেবে সেইটুকু অনুমান করতে পারাও জরুরি বৈকি। সাধে কি আর প্রচারমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়!
যেদিনই আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় নিহত মানুষের সদ্যকর্তিত মুন্ড বা ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনায় মুচড়ে যাওয়া রেলকামরার জানলার বাইরে মানুষের কাটা হাতের ছবি দেখেছিলাম, সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, দুত্তোর আর খবরের কাগজ ফাগজ পড়ব না। কি হবে আমার চারপাশের আঁখো দেখা হাল জেনে? সংবাদপত্রের উপর গভীর অভিমানে মনে হয়েছিল শুধু সমাজের ক্ষত দেখাবার দায়িত্ব রয়েছে তাদের? আর তাই দেখে যে বিবমিষা জন্মায়, তা মোছার কোনো দায় নেই? সব দায় আমার নিজস্ব সহ্যশক্তির?
কিন্তু অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ থাকে না। আমিও পান্ডববর্জিত জঙ্গলে অজ্ঞাতবাসে নেই — তাই কিছুদিন পরেই প্রতিজ্ঞা ভাসিয়ে ফের হাতে তুলে নিই নিউজপেপার।
ততদিনে বীভৎস দৃশ্যকে ‘ব্লার’ করে পেশ করার সংবেদ দেখাতে শিখে গিয়েছে গণমাধ্যম। অতএব অস্বস্তি কিছু কম হয়। কিন্তু সাদা পাতায় মোটা কালো অক্ষরগুলো যে সব খবর বয়ে আনে, তা স্বস্তি দেয় না হৃদয় বা মস্তিষ্ককে।
স্টেটসম্যান আর পড়া হয় না। এই সময়, আনন্দবাজার, মাঝেমধ্যে টাইমস অফ ইন্ডিয়া আর অনলাইনে উত্তরবঙ্গ সংবাদ — এতেই আটকে থাকি আজকাল।
আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় সাধু থেকে চলিত হয়। সমস্ত কাগজের ভাষা হয়ে ওঠে সময়ের সঙ্গে তাল মেলানো, অনায়াস, আধুনিক। কিছু মেনে নিই, কিছু পারি না মানতে। পুরনো সংস্কৃতি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকে মননে, বীক্ষায় — ঠেলে সরানোর সাধ্য নেই, সাধও নেই তেমন।
এখনো চোখ বন্ধ করলে ভেসে ওঠে জ্যোতিবাবুর মুখ্যমন্ত্রিত্বের শপথগ্রহণ, মাথায় ব্যান্ডেজবাঁধা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃঢ়, নির্ভীক মুখের ক্লোজআপ, ‘পার’এ দেহাতি নাসিরুদ্দিনের অসহায় মুখের স্টিল, জোড়হাতে দাঁড়ানো গুজরাতি যুবক কুতুবুদ্দিন আনসারির মৃত্যুভয়ে ভীত জলভরা চোখ আর কৃশানুর পায়ের টাচে অনবদ্য গোলের ছবির কোলাজ।
চোখ খুলি। আমার সেসব দিন গিয়েছে। কি জানি, সংবাদমাধ্যমেরও গিয়েছে বোধহয়। ক’দিন আগে বরুণ সেনগুপ্ত-র ইমার্জেন্সির সময়ে কারাবন্দী থাকার দিনগুলির স্মৃতিকথা ‘অন্ধকারের অন্তরালে’ ধুলো ঝেড়ে, বইয়ের তাকের পিছন দিক থেকে নামিয়ে পড়ছিলাম।
পড়তে পড়তে আরো বেশি করে অনুভব করছিলাম, খবরের কাগজের সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার জাত গিয়েছে কবেই।
এখন শুধু নামজাদা সোনার দোকানের ভ্যালেন্টাইনস ডে-র অফারের চকচকে বিজ্ঞাপনের পাশে গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত, মাতৃহারা শিশুটির রক্তমাখা অসহায় মুখের ধারালো বৈপরীত্যের মধ্যে তারিফ করবার তুল্য সাংবাদিক সম্পাদনা খুঁজে পাই।
ন’জ্যাঠার মতো উচাটন হয়ে কাগজওয়ালার প্রতীক্ষা আমাকে বোধহয় আর মানায় না।
ছবি : আন্তর্জাল