হরিদ্বারে এসে কোনও অচেনা সন্ন্যাসী, যে তত বিখ্যাত নয়, বিখ্যাত হতেও চায় না, তাকে খুঁজে পাওয়া আর খড়ের গাদায় ছুঁচ খুঁজে পাওয়া একই ব্যাপার। সেই অসাধ্য সাধনও করে ফেললাম।
ওর নামটা কী হতে পারে আসলে আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল। এখনকার নামটা।
কলকাতায় ওর হদিশ দিয়েছিল কলাবাগানের রাজু শেখ। সবে জেল থেকে বেরিয়েছে। মেডিকেল থেকে অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের তামার তার চুরি করে ধরা পড়েছিল তিন বছর আগে।
ওদের আড্ডায় বসে যখন আমার সমস্যাটা বলেছিলাম, সবাই পাঁচু ওস্তাদের কথা বলেছিল।
সবাই জানে না। কিন্তু চোরদের সঙ্গে মেলামেশা করে এ’টুকু জেনেছি যে চুরি, যে কোনও চুরিই গুরুমুখী বিদ্যা। পাঁচু ওস্তাদ ছিলেন ও লাইনের মহাগুরু। গত বছর রক্ত কাশিতে মারা গেছেন। ধর্ম নির্বিশেষে কলকাতার চোরেরা তাঁর নাম শুনলেই কপালে হাত ঠেকায়। নানান গুহ্য বিদ্যায় দখল ছিল তাঁর। দেহ সঙ্কোচন, উল্লম্ব পতন, গণ সম্মোহন, আরও নানান বিদ্যা।
জিজ্ঞেস করতে বিশদ বর্ণনা পেলাম। যে গরাদের ফাঁক দিয়ে তিন বছরের শিশুও গলতে পারবে না তার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায় দেহ সঙ্কোচন বিদ্যার জোরে। পাঁচতলার ব্যালকনি থেকে লাফিয়ে মাটিতে পড়ে অক্ষত দেহে লুকিয়ে পড়া যায় উল্লম্ব পতনটি শিখলে। পাঁচু ওস্তাদের কাছে ট্রেনিং নিয়ে শিখেছেও কেউ কেউ।
কিন্তু সেরা যে বিদ্যেটি, আঁধারে দেখা, সেটা শেখা ভারি কঠিন আর সময় সাধ্য। এমন কাউকেই পাওয়া গেল না যে গুরুজির কাছ থেকে সেটি শিখতে পেরেছে। নানা ধ্যান তপস্যার ব্যাপার সেটি। প্রায় হতাশ হয়ে যখন ফিরব ভাবছি, রাজু হাতের ইশারায় ডাকল আমাকে। পেটে কিছু বিদ্যেও আছে রাজুর।
মমতাভরে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে বিরু, তোর পিএইচডিটা এখনও হয়নি?”
মাথা নাড়লাম। রাজু বলল, “তোর সমস্যাটা শুনলাম। একজনই তোকে হেল্প করতে পারত।”
পরম আশায় জিজ্ঞেস করলাম,” সে কি জানে ওই বিদ্যে? কোথায় থাকে সে?”
“আরে ওই দিবুর জন্যেই তো ধরা পড়লাম এই তামাচুরির কেসটায়!”
“সে কি! তোকে ধরিয়ে দিল? ও কি পুলিশের খোচর হয়ে গেছল?”
“না না, ও সে’রম আদমিই না, খোদা কসম! ধরা তো পড়লাম দিব্যেন্দু মানে দিবু তার ঠিক আগেই কলকাতা ছেড়ে চলে গেল বলে। ওই মেডিকেলের বড় বাড়িটার পেছন দিকের আঁধারটায় দিবু সঙ্গে থাকলে কিছুতেই ধরা পড়তাম না। পাঁচু ওস্তাদের কাছে পাক্কা দশ বরস শিখেছিল। আঁধারে দেখতে পেত ও। বিলকুল বিল্লি জ্যায়সা।”
“দিবুর অ্যাড্রেসটা দে রাজু, খুব দরকার!”
“আরে, জানলে তো দেব! পাঁচু ওস্তাদ কাউকে শেখাবার আগে খুব সাবধান করে দিত, এই বিদ্যে শিখতে গেলে ওই ধ্যান তপস্যায় মন আউলে যায়, দিওয়ানা হয়ে যায়। আমরা পাঁচ ধান্দায় থাকি। ও সব শুনে ভয়ে আর এগোইনি কেউই। শুধু ওই এক দিবু। খেটে খুটে শিখল। দু’চারটে অপারেশন করলও। তার পরেই সন্ন্যাসী হবে বলে হরিদ্বার চলে গেল।”
★
ঘটনার শুরু মাস দুয়েক আগে।
আমাকে সমর মামা ডেকে পাঠিয়েছেন। ভয়ে ভয়ে দেখা করে বেশ অবাক হলাম। বুঝলাম মামা রিটায়ার করার পর বেশ পালটে গেছেন। নইলে আগে দেখা হলে যে রাগী মামা আমাকে পাত্তা দিতেন না মোটে, সদাই মিলিটারি মেজাজ, কথা বলতেন না মোটে, তিনিই এ’বার খুব আগ্রহে বললেন,”কে ও? বিরূপাক্ষ এলি? আয় আয়, তোর জন্যেই বসে আছি গত হপ্তা থেকে।”
আমার এই মামাটি মিলিটারিতে খুব উঁচু পোস্টে ছিলেন। কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছেন? সব সময় এমন কড়া মেজাজে থাকতেন জিজ্ঞেস করতেই পারিনি, কোনওদিন। দেখাও হত ক্বচিৎ। শুধু জানতাম মস্ত পোস্ট। মস্ত দায়িত্ব। বেশ কয়েকবছর আগে শুনেছিলাম তিনি কর্নেল। রিটায়ারের আগে নিশ্চয়ই আরও উঁচুতে গেছিলেন।
মনের প্রশ্নটা মামা যেন পড়তে পারলেন- তুই কি ইন্ডিয়ান আর্মিতে অফিসারদের হায়ারার্কিটা জানিস?
একটু একটু জানতাম।
মামা খোলসা করে বললেন, “একদম চাকরিতে ঢোকার সময় লেফটেন্যান্ট। বানান জানিস তো?”
মামা যে আমাকে কী ভাবেন, ভেবে পাই না। হতে পারে আমি সমাজবিজ্ঞানের মত পাতি সাবজেক্টের। এই পাতি কথাটা আমার বাবার। তিনি ভাবেন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার আর বিজ্ঞানীরা ছাড়া অন্যরা সবাই ওই পাতি।
মামাকে লেফটেন্যান্ট বানানটা গম্ভীর ভাবে জানালাম। সেই যে, মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়ে। মানে এলআইই ইউ টিইএন এএনটি।
মামা শুনে বললেন, “ঠিক। তারপরে ক্যাপ্টেন, মেজর, লেফটেন্যান্ট কর্নেল, কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার। তারও পরে মেজর জেনারেল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল এই সব নানান স্টেজ। আমি চাকরির একেবারে শেষে ব্রিগেডিয়ার অবধি উঠেছিলাম। আর তার বছরখানেক বাদেই রিটায়ার্ড হলাম।”
চিরকালের মেজাজি মামা, হঠাৎ কেন এত সব বলছেন, ভেবে একটু অবাকই লাগছিল। এতকালের মানে ছোটো বেলা থেকে জমে থাকা প্রশ্নটা করেই ফেললাম, “মামা, আপনি কোথায় যুদ্ধ করেছেন?”
আমাকে অবাক করে মামা বললেন, সেই “কার্গিল যুদ্ধের পর সরাসরি যুদ্ধ-বিগ্রহের সঙ্গে আমার আর কোনও যোগ ছিল না। আমি যেখানে ছিলাম সে’খানে আমাদের যুদ্ধ ছিল অন্যরকম”।
ভাবলাম, হবেও বা। উঁচুতে উঠে গেলে, আর সরাসরি যুদ্ধে যেতে হয় না। এ তো আর কুরুক্ষেত্রের যুগ না যে সেনাপতিকে নিজেকেই রথে, ঘোড়ায় বা হাতিতে চেপে যুদ্ধ করতে হবে!
মামাকে সে কথা বলতে, মামা বললেন, “না ব্যাপার ঠিক তা’ নয়। আমাকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কাজ দেওয়া হয়েছিল।”
“সরিয়ে নিয়ে মানে? কোথায়?”
মামা, কেমন যেন গলা নামিয়ে, প্রায় ফিসফিস করে বললেন,”বিরু, তোকে যা বলব, কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও না জানে। আমাকে চাকরির শেষ কয়েকটা বছরে পাঠানো হল মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স বলে একটা দপ্তরে। নাম শুনেই বুঝছিস, তাদের কাজটা গোয়েন্দাগিরি গোছের। ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স বলে আরও এক দপ্তর রয়েছে। অত তোকে বুঝতে হবে না। সবটা মিলে মিশে ভারি গোপন সব কাজ হয় সে’খানে। সবই দেশের নিরাপত্তার বিষয়ে। আমিও পুরোপুরি সবটা জানি না। তো এদেরই একটা ট্রেনিং দেবার জায়গা রয়েছে পুনেতে।
সাবিত্রীবাই ফুলে পুনে ইউনিভার্সিটি। সে’খানে নানা কোর্স রয়েছে। এরই একটা কোর্সের টিচার মানে ফ্যাকাল্টি ছিলাম আমি। আর সেখান থেকেই রিটায়ার করলাম। রিটায়ারমেন্টের পরও এরা আমাকে নানান ব্যাপারে ডাকে। পরামর্শ চায়। সাহায্য চায়।
তোকে ডেকেছি এদেরই একটা কাজের ব্যাপারে।”
আমি? মিলিটারিকে সাহায্য করব? মানে কি যুদ্ধে যেতে হবে? হাইটে পাঁচ ফুট সাড়ে চার। চেহারা সিলিন্ড্রিকাল। ওজন পঁচাত্তর কিলো। পুরোপুরি আনফিট।
বলেই ফেললাম,” মামা, আমি মানে যু… যু….”
মামা বাধা দিলেন। আসলে অন্তস্থ য আর বর্গীয় জএর তফাত বোঝা যায়নি।
বললেন,” আরে ভয় পাচ্ছিস কেন? জুজু নয়। দেশের নিরাপত্তার ব্যাপারে একটু হেল্প। সমস্তটা খুলে বলি, শোন। আমার চেনা জানাদের মধ্যে একমাত্র তুইই ফিট।
তোর বাবা, মানে মেজ জামাইবাবু তোর ওপর ভারি বিরক্ত, জানিস তো? কী সব ফালতু ব্যাপারে রিসার্চ করছিস নাকি ভিখিরি চোর ছ্যাঁচোড়দের নিয়ে। তুই নাকি এই সব সাবঅলটার্নদের ব্যাপার স্যাপার জানতে চোরদের সঙ্গে বেশ মেলামেশাও করছিস। মানে, ওই জামাইবাবুই বললেন। চোরদের সঙ্গে মিশে ভালো ভাবে জানবি বলে ওদের কোন ডেরায় রাত্রিবাস করে নাকি ধরাও পড়েছিলি একবার। তারপর তোর বাবা থানায় গিয়ে তোর মাস্টার্সের মার্কশিট আর ইউনিভার্সিটির কাগজপত্র দেখিয়ে তোকে মুচলেকা দিয়ে এনেছিল!”
ও বাবা, মামা দেখি অনেক খবর জোগাড় করেছেন! অবাক হবার কিছু নেই। আমার বাবা যে আমার এই রকম যে কোনও হতমান হবার খবরেই উল্লসিত হন এটা আমি জানি। যেদিন থেকে আমি পিওর সায়েন্স না পড়ে সোশ্যাল সায়েন্স পড়ব বলে জানিয়েছিলাম, বাবা সে’দিন থেকেই ক্ষমাহীন। সোশিওলজিতে এমএতে ফার্স্ট ক্লাস পাবার পরও যখন আমি চাকরির চেষ্টাটি মাত্র না করে রিসার্চে ঢুকলাম তাঁর হতাশা আরও বেড়েছে। রিসার্চের বিষয় খটোমটো। তস্করবৃত্তির ইমপ্লিকেশন আর সোশিয়োলজির ইন্টারঅ্যাকশন।
আমার রিসার্চ গাইডের আবার এই সাব অল্টার্নদের সোশিয়োলজি নিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহী। তাই আমার জীবনে এতসব কাণ্ড ঘটেছে। একবার পরিচিত ভিখিরিদের রাত্রি বাসের সিমেন্ট পাইপে দিনকয়েক থেকে সত্যিকারের ভিক্ষে করতে হয়েছিল। আজেবাজে জল খেয়ে সে কি ডায়রিয়া। স্যালাইন, ইঞ্জেকশন, একগাদা খরচা।
কিন্তু মামা আমার কাছে চাইছেনটা কী?
মামা এবার আস্তে আস্তে বিস্তারিত হলেন। – তুই ইনফ্রারেড ভিশন বলে কিছু জানিস? আইআর ভিশন।
সায়েন্সের ছাত্র না হলেও আমি ইনফ্রারেডটা জানি। তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের যে বর্ণালী সেটা অনেক বড় আর বিস্তারিত। সব চেয়ে ছোটো তরঙ্গ দৈর্ঘ গামা রে তারপরে এক্স-রে, আলট্রাভায়োলেট পেরিয়ে আমাদের দৃশ্য আলোর জগৎ, মানে আমাদের চোখ যা দেখতে পায়, সেই বেনীআসহকলা মানে ইংরেজির ভিবজিওর। তরঙ্গ দৈর্ঘ বাড়তে বাড়তে এ’বার ঢোকে ইনফ্রারেড রশ্মিতে। সেই এলাকার পরে মাইক্রোওয়েভ। একেবারে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের হল রেডিওওয়েভ। মানে টিভি রেডিও এইসব। ভাসা ভাসা মনে পড়ল। কিন্তু আইআর ভিশন ব্যাপারটা সত্যিই জানি না।
মামার কাছে অজ্ঞানতাটা কবুল করতেই তিনি বললেন,”আহা, জানিস না, এতে লজ্জার কিছু নেই। এটা তো ওই কী বলে, তোর কাপ অফ টি নয়! প্রকৃতিতে অনেক প্রাণী রয়েছে যাদের বেনীআসহকলা দেখার ক্ষমতার সঙ্গে ওই ইনফ্রারেডও দেখার ক্ষমতা রয়েছে। তাকেই বলে আই আর ভিশন।
কেউ কেউ আবার আলো দেখতেই পায় না। তাদের যত দেখা ওই ইনফ্রারেড দিয়ে। ধর মাটির ভেতরে সেঁধিয়ে থাকা কেঁচো। তারা যেখানে থাকে সেখানে তো আলোই নেই। সেই আলোহীন জগতে তারা আমাদের মত চোখ দিয়ে করবে কী? ওরা দেখে মানে অনুভব করতে পারে শুধু ওই ইনফ্রারেড। মশাও তাই। অন্ধকারে শিকার চেনে ইনফ্রারেড আর কার্বন ডাই-অক্সাইড দিয়ে।
তো যা বলছিলাম। আইআর ভিশন এই ব্যাপারটা। পিট ভাইপার বলে সাপেদের একটা শ্রেণী আছে। পাইথন, র্যাটল স্নেক, এরা সব এই শ্রেণীর। এদের ওপরের চোয়াল আর নীচের চোয়াল বরাবর কিছু ইনফ্রারেড তরঙ্গ বোঝার অঙ্গ রয়েছে। চোখ নয় কিন্তু। এ’গুলো দিয়েই ওরা তাপ দেখতে পায়।
ওঃ বলা হয়নি, মানুষ সমেত সমস্ত স্তন্যপায়ী আর অন্য উষ্ণরক্তের প্রাণীরা নিজেদের রক্তের ওই উষ্ণতার কারণে নিজেরাই ইনফ্রারেড বিকিরণ করে। নিজেদের শরীর থেকেই তাপ বের হয় বলে এদের শরীরে ওই অঙ্গটই মানে ইনফ্রারেড তরঙ্গ ধরার যন্ত্র নেই।
এই নেই বলাটা বুঝলি বিরু, ভুল হল। আছে কিন্তু অ্যাক্টিভ নয়। নইলে তাপ তো আমরা অনুভব করতেই পারি। এই ২০২১-এর ফিজিওলজির নোবেল প্রাইজটাই তো হল কী ভাবে তাপের অনুভব কী হয় সেই রিসেপ্টর আবিষ্কারের ওপর।
সমর মামার এই সব কথা শুনে সত্যি বলতে কী, একটু ঘাবড়েই যাচ্ছি। আমার সঙ্গে প্রতিরক্ষা দপ্তরের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স আর এই সব কড়া কড়া সাইন্টিফিক ব্যাপারের যোগ কোথায়?
মামাকে জিজ্ঞেস করলাম- কিন্তু মামা, এই সব কঠিন ব্যাপারে আমি তোমাকে মানে তোমার মিলিটারি ডিপার্টমেন্টকে কী সাহায্য করব?
এ’বার মামার জটিল ঝোলার থেকে জটিলতর এক বেড়াল বেরোল। “বিরু, শোন, রাত্রে দেখার জন্য একরকমের নাইট ভিশন গগলস পাওয়া যায়। এই দেশে সেটা একমাত্র বিশেষ লোকেরাই ব্যবহার করতে পারে। মিলিটারি আরও নানা রকম সরকারি গোয়েন্দারা।”
কড়া এই বৈজ্ঞানিক লেকচার এতক্ষণ শুনে কড়া অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খাওয়ার পর যেমন মাথা ভোঁ ভোঁ করে আমারও তেমনটি করছিল।
বক্তৃতায় নাকি খিদেয় ঘুরছিল মাথাটা?
দিদা আমাকে ডাকলেন, “ভোম্বল, না খেয়ে যাস নে যেন।” অন্যরা বিরু বললেও আমি দিদার ভোম্বল।
আর আমায় পায় কে? একলাফে দিদার কাছে। পেছন থেকে মামার প্রবল আক্ষেপ ঝরে পড়ল। “আঃ, মা, কী যে করো! ঠিক আছে বিরু, খাবার পরে বাকিটা।”
মুখে লুচি ছোলার ডাল নিয়ে উত্তর দেওয়া মুশকিল। আমি চেঁচিয়ে বলি, “আজ না মামা, এট্টু হজম করে নিই, কাল বরঞ্চ আবার।”
মামা বুঝতেই পারেন না কী হজমের কথা বলছি, লুচি না বিজ্ঞান। খেয়ে দেয়ে কেটে পড়লাম।
পরের দিন ইচ্ছে করে ভুলে যাবার তালে ছিলাম। উপায় পেলাম না। মামা বাবাকে ফোন করেছেন তিন বার। আমি যেন তাঁর সরকারি কাজে বাধা না দিই। সেটা নাকি সরকারি কাজে বাধার সামিল। আচ্ছা “সরকারি কাজ”এ সাহায্য না করা মানে কি সেই কাজে বাধা দেওয়া? কে জানে বাপু!
কাজেই পরদিন সকালে আবার মামাবাড়ি গেলাম। যেতেই মামা জানালেন, “শোন, তোর দিদার দেওয়া পরোটা ছোলার ডাল সাঁটানোর পরই গতকালের মত কেটে পড়বি না কিন্তু। আজ দুপুরে তোর জন্যেই কচি পাঁঠার ঝোল দিয়ে ভাত। দুপুরে খেয়ে নিয়ে আবার বসব। তোকে তোর কাজটা বোঝাতে হবে তো!”
মামার গলায় খোসামোদের সুর স্পষ্ট। কিন্তু আমি কেন?
জামাইকে যদি আদর করে বাবাজীবন বলা যায় তবে বদলে যাওয়া মামাকে অবশ্যই মামাজীবন বলা যায়। গুছিয়ে বসতেই মামাজীবন আবার শুরু করলেন- “গতকালের বলা এই যে নাইট-ভিসন যন্ত্রগুলো, বেশ কয়েকরকমের হয়, বুঝলি তো? আর এ’গুলো সর্বসাধারণের জন্য খোলা বাজারে পাওয়াও যায় না।”
“নাইট-ভিশন মানে কি টর্চের মতন আলো জ্বেলে টেলে?”
“দূর বোকা। আলো জ্বাললে তো খেলা শেষ। চুপিসারে রাতের অন্ধকারে যা ঘটছে অন্ধকার ভেদ করে তা’ দেখাটাই তো উদ্দেশ্য। আর সেই জন্যেই তো সবার জন্য অ্যাভেইলেবল না। পাহারাদারের হাতে যা থাকবে দুষ্কৃতির হাতে তা থাকলে হবে?
তোকে যা বলছিলাম। নানান টেকনোলজি আছে। একরকম নাইট-ভিশন টেকনোলজি হল গিয়ে ইমেজ এনহ্যান্সমেন্ট। মানে যে সামান্য আলো আসছে, যা আমাদের চোখ ধরতে পারে না এমন খুবই ক্ষীণ মাত্রার দৃশ্য আলো আর বর্ডার লাইনের ইনফ্রারেড যাকে বলে নিয়ার-ইনফ্রারেড, সেগুলোকে কুড়িয়ে কাছিয়ে জোগাড় করে যন্ত্রে বাড়িয়ে দেখার ব্যবস্থা। এগুলো কিন্তু রিফ্লেকটেড তরঙ্গ।
আর দ্বিতীয় টেকনোলজিটা হল থার্মাল ইমেজিং। মানে যে তাপতরঙ্গ উৎসারিত হয় কিছু থেকে, তফাতটা বুঝলি তো, প্রতিফলিত হয় না কিন্তু, উৎসারিত হয়। সেই তাপরশ্মিকে সংহত করে দেখার ব্যবস্থা করা হয় এই থার্মাল ইমেজিংএ।”
“মামা, এ তো পুরো রবীন্দ্র সঙ্গীত গো” হাল্কা রসিকতা করার চেষ্টা করি আমি।
মামা সেই পুরোনো মিলিটারি মেজাজে ভুরু কোঁচকালেন, “মানে?”
আমি সামাল দেবার চেষ্টায় তাড়াতাড়ি বলি,”না, মানে ওই যে রবীন্দ্রনাথের গানে আছে না, অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো…”
মামা কিন্তু রাগলেন না, “ওরে, কবিরা যে সত্যদ্রষ্টা হন! যাক গে, গুলিয়ে দিস না। দ্যাখ এই যন্ত্রগুলি যা বলছিলাম রাত্রে দেখার যন্ত্রই। ভজকট। আর সত্যি বলতে কী বেশ ঝামেলার, আবার ভারি ও। কোনওটা গগলসের মত কোনওটা আবার ক্যামেরা বা বীক্ষণ যন্ত্রের মত।
এ’বারে ভেবে দ্যাখ, যদি যন্ত্র ব্যবহার না করে মানুষ নিজেই যদি ওই পিট ভাইপার বা কেঁচোর মত ইনফ্রারেড ‘দেখতে’ পেত তা’হলে কী সুবিধেই না হত।”
“কিন্তু মামা, তুমিই না কাল বললে উষ্ণ রক্তের প্রাণীরা নিজেরাই ইনফ্রারেড ছড়ায় বলে তারা ও’সব পারে না?”
“কিন্তু আমি তো এটাও বলেছিলাম যে তাপ বোঝার রিসেপ্টর আছে উষ্ণরক্তের প্রাণীদেরও। তো এই রিসেপ্টরগুলোকে যদি কোনওভাবে ট্রেইনিং দিয়ে উন্নত করে ইনফ্রারেড অনুভব করানো যায়? যেমন পারে পিট ভাইপারের পিটএ থাকা সেলগুলো, তখন? তখন তো আমরা অন্ধকারেও দেখতে পাব। ঠিক কি না?
তুই হয় তো জানিস, হয় তো জানিস না আমাদের মগজে পিনিয়াল গ্ল্যান্ড বলে যে বস্তুটা আছে, যার নাম আজ্ঞাচক্র সেটিকে যোগাসন করে জাগ্রত মানে অ্যাক্টিভেট করা যায়। আর তাকে দিয়ে তখন নানান কাজও করানো যায়। ঠিক আছে তোর যদি এই যোগটোগে বিশ্বাস না থাকে ধরে নে এক্সারসাইজ, একধরণের প্রক্রিয়া।
সেই রকমই ইনফ্রারেড রিসেপ্টর কেও বিশেষ প্রক্রিয়ায় অ্যাক্টিভেট করা যায়। আমরা পুরোনো পুঁথির থেকে আন্দাজ পেয়েছি ব্যাপারটা। একে বলে ‘খগম বিদ্যা’।
খগম জানিস তো? আরে ওই যে এক মুনির ছেলে ছিল না, যে সাপ ইয়ে করতে পারত মানে নিজেই সাপ হয়ে যেতে পারত। সত্যজিতের কী একটা গল্পেও আছে নাকি। তো সেই বিদ্যা আর কিছুই না। আসলে সাপের মত ইনফ্রারেড ভিশন অর্জন করে অন্ধকারে দেখতে পারত সেকালের কিছু মুণি ঋষি।”
অবাক হলাম বটে। “কিন্তু এই গুহ্য বিদ্যার সঙ্গে আমার কী যোগাযোগ, মামা?” জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম।
“আছে রে আছে। পরবর্তী কালে মানে সেই আদ্যিকালের পর এই বিদ্যা সে’কালের মুণি ঋষিদের মতই প্রায় লুপ্ত হয়ে যাবার উপক্রম। কিন্তু কিছু মানুষ, যারা বংশানুক্রমিক ভাবে চোর তারা খুব গোপনে এই বিদ্যার চর্চা করত। কেন বুঝতেই পারছিস। নিছকই পেশাগত কারণে।
এই রাত্রে দেখার ক্ষমতাওয়ালা একজনকেও আমরা খুঁজে পাইনি। কিন্তু খুব দরকার। খবর আছে এই কলকাতাতেই একজন সেই বিদ্যের অধিকারী রয়েছে। খুব গুণী চোর সে। তোর তো চোরেদের সঙ্গে ওঠাবসা। এই মানুষটাকে খুঁজে দিতে হবে তোকে। যাতে আমাদের মিলিটারির একটা টিমকে ট্রেইনিং দিয়ে রাতের অন্ধকারে দেখার মত তৈরি করে দিতে পারে সে।”
মামার মনে আমার জন্য উপচে পড়া ভালোবাসার কারণ এতক্ষণে বোঝা গেল। যা হোক কচি পাঁঠার ঝোল, ঝিরিঝিরি আলুভাজা, সোনামুগ ডাল আর গরম ভাতের কম্বিনেশনও ফেলনা নয় কিছু।
দুপুরের খাওয়ার পর মামা আর এক প্রস্থ লেকচার দিলেন। এ’বার আর বিজ্ঞানটিজ্ঞান না। প্ল্যান অফ অ্যাকশন। সেই খগম বিদ্যা জানা চোরকে, থুড়ি মানুষটিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করাতে হবে যাতে সে ডিফেন্স ইনটেলিজেন্সের ওই কলেজে তার ওই বিদ্যে শিখিয়ে দেয় ডিফেন্সের কিছু লোককে। সেই যারা দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এসপিওনেজ, কাউন্টার এসপিওনেজ, স্পায়িং এই সব প্রবল ঝুঁকির কাজ করে, সীমান্তে, কখনও সীমান্ত পেরিয়েও।
“বুঝলি বিরু, খরচ আর সময় কোনও ব্যাপার না। তোকে কাজটা তুলে দিতেই হবে।”
★
শুরুতেই যা বলেছিলাম।
হ্যাঁ, হরিদ্বার।
টিকিট ফিকিট, থাকার ব্যবস্থা সব মামাই করে দিয়েছিলেন। হরিদ্বারে এসে অবধি ছানবিন করেই যাচ্ছি। মাঝে অবশ্য সরকারের পয়সায় কিঞ্চিৎ সাইট সিইং ও করে এলাম, হরিদ্বার তো বটেই আশেপাশের হৃষিকেশ লছমনঝুলা, এই সবও। এমন সময় হদিশ দিল দাদাবৌদির হোটেলে খেতে আসা এক নবীন ব্রহ্মচারী। সে সোদপুরের বাড়ি থেকে পালিয়ে সন্ন্যাসী হবে বলে এসেছিল। খাওয়াদাওয়া পোষাচ্ছে না বলে এখান থেকে ফের সোদপুরের দিকে পালাবে ভাবছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সেই বলল, “ও আপনি বোধ হয় চোট্টা মহারাজকে খুঁজছেন। উনি আগে জেলখাটা চোর ছিলেন। ভারি সাত্ত্বিক মানুষ। খগমানন্দ মহারাজ।”
মাথার মধ্যে চিড়িক দিয়ে উঠল ওই খগমটুকু শুনে। আস্তানাটা জিজ্ঞেস করে একটু হতাশ হলাম। সে এদিকের কোনও আখড়ায় থাকে না। প্রকৃতই সাধু। থাকে যেখানে জায়গাটা হরিদ্বার থেকে বেশ দূরে। জঙ্গলের মধ্যে তার ডেরা। বেশ কষ্ট করে যেতে হয়। তো সে’খানেই পৌঁছোলাম।
বয়েস বেশি না। বেশ দেখতে। আমার মুখে সব শুনে আমাকে যে দূর দূর করল তা’ না। কিন্তু যা’ বলল, সে’টি হ্যাঁ কিম্বা না, বুঝতে পারলাম না।
একবার বোঝাল, “বুঝলে, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যই হওয়া উচিত, তমসো মা জ্যোতির্গময়… “
অন্য একবার বলল “দেশের নিরাপত্তা খুব দামী।”
আবার অন্য এক সময় বলল, “লোকে গুপ্তবিদ্যার জন্য তপস্যা করে, শান্তির জন্য করে না!”
রাত্রে চলাফেরার জন্য টর্চ বা অন্য আলো লাগত না তার। সব নাকি দিনের বেলার মত স্পষ্ট দেখতে পেত।
দু’তিনদিন থাকার পর একদিন সকালে উঠে দেখি, পাখিটি ফুরুৎ।
একটা চিরকুটে লেখা, “বিরূপাক্ষ ভাইটি, চললাম। তুমি খুঁজে পেয়েছ মানেই বুঝে গেছি সরকার আমার হদিশ পেয়ে গেছে। রক্ষা পাব না। বহতা নদী আর রমতা সাধুর গন্তব্য অনন্তের দিকে। তাকে সংসারে ডেকো না।”
রাতের ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে সেই খগম চলে গেছে হিমালয়ের আরও দুর্গম অজানায়, অনন্ত আলোর সন্ধানে।