লক ডাউন যত বাড়ছে, ততই একটা একটা করে পরিচিত মুখ হারিয়ে যাচ্ছে আউটডোর থেকে। অথচ, রোগীপত্তর যে খুব কম হচ্ছে এমনটিও নয়। দিব্যি আসছে লোকজন এখনো কোমরের ব্যথা কিংবা হাতের চুলকানি দেখাতে। প্রেসার, সুগার, সর্দিকাশির কিংবা ‘বাত-বেদ্না’র বড়ি। দিব্যি আসছে সদলে। এবং তাতে খুব একটা দোষেরও তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না আমি।
ফেসবুকের বাইরেও একটা সত্যিকারের জগৎ আছে। বরং সেই জগৎটাই অনেক বেশি সত্য। যাদের কাছে, করোনা হলো বাঘের মতো। সার্কাসের পালানো বাঘ। মাইকিং করে বলে গেছে সরকার থেকে– এলাকাবাসীর জন্য একটি জরুরি ঘোষণা। গতকাল রাত্রে সার্কাসের খাঁচা ভেঙে একটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার পালিয়েছে। সকলকে অনুরোধ করা হচ্ছে, আপনারা বাড়ির বাইরে বেরোবেন না।
ঘোষণা শোনামাত্র এলাকা জুড়ে ত্রাস। সদর দরজায় খিল। টালির ঘরে বাঁশের বাড়তি ঠেকনা। গোয়াল ঘরের সামনে কাঁটাঝোপের ছাউনি। পথঘাট শুনশান। খাঁ খাঁ চারিধার।
ক্রমে দিন পেরোলো এক দুই তিন। হপ্তাও পেরোলো ধীরে। এবং টান পড়লো জমানো সামান্যতে। এবং ছটফটিয়ে উঠলো পাড়া বেড়ানো বুড়ো। এবং উশখুশালো ঠেক মারা নওজওয়ান। আর খিল খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো, কেউ এক পা তো কেউ তিন পা।
কই! বাঘ তো কোথাও নেই। ওই তো বিশুর দাদা নদীর ধার থেকে মাছ মেরে আনলো টাটকা। এই তো ছোটো বাপি বলছে– বিড়ি খাবা নাকি অমূল্যদা? ঘরে বসি বসি… কতদিন আর পারা যায় বলো ?
আর তাই এ বাড়ির অমূল্য, ও বাড়ির বিশুর দাদা আর সে বাড়ির ছোটো বাপি আরেকটু সাহস করে এগিয়ে পৌঁছে গেল পাট ক্ষেতের ধারে। সেখানে বুকসমান মস্ত মস্ত পাটের জঙ্গল। সেখানে… হাওয়া বইছে ভয় ধরানো। ঢেউ তুলছে সন্দেহজনক। তিনজনের দল আরেকটু এগোলো তবুও শনৈঃ শনৈঃ। তারপর আরো একটু
–” অ্যা হে হে হে! পোকা ধরসে গ ফস্লে। দ্যাখছো!… অ্যাহ! চলো চলো অমূল্যদা ইস্পেরে ম্যাশিন নিয়া আসি। ভুখা মরবো নাকি..”
ক্রমে, ফসলে স্প্রে হলো সাবধানী। এবং সেই খবর স্প্রে হলো এখানে ওখানে সেখানে। ক্রমে দোর খুললো অন্যান্য বাড়ির। ক্রমে দোর খুললো অনেকের।
নাঃ। কই! বাঘ তো নাই! মরতেসে না তো কেউ। ওই তালমা গেরামের দিকে একজনকে মারছে শুনছি। এদিকে তেমন তো কিছু…।
তো এই হলো গিয়ে এ দেশে মোটের ওপরে করোনা কাহিনী। কাজেকাজেই ভিড়ভাট্টা তেমন একটা কম হওয়ার কথা নয় এখানে। হচ্ছেও না। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে তবুও কিছু কিছু মুখ। আউটডোর থেকে।
একটা বুড়ো আসতো হপ্তায় তিনদিন। ভিখারি ঠিক না। অনেকটা যদিও ওরকমই। কট্সউলের চেক চেক জামা। আর খাঁকি প্যান্ট। জামাটা সম্ভবত সাদা ছিল এককালে। এখন তিলচিটে রোঁয়া রোঁয়া। প্যান্টটা কোমরের কাছে দড়ি দিয়ে বাঁধা কষে। দেখাও যেত সে দড়ি দিব্যি। জামার নীচের দিকের বোতামগুলোই নেই যে। তাই নাভির নীচে সাদা লোমের দাগ, চিপকে থাকা ময়লা, হুক বিহীন প্যান্ট, আর বকলসের ঘরে নারকেল দড়ি… সবই দেখা যেত পরিষ্কার। লোকটা, সেই সমস্তকিছু বাঁ হাতের মুঠোতে খামচে ধরে লজ্জাবস্ত্র সামলাতে সামলাতে বলতো ঘড়ঘড়ে গলাতে–পায়খানা হয় না। পায়খানা হয় না।
ব্যাস এটুকুই। এ বাদে আর দ্বিতীয় কোনো অভিযোগ আমি তার শুনিনি কোনোদিন। চলে যেত খুশি মনে এক পাতা ভিটামিন বা কৃমির বড়ি পেলেই। আর তিনদিন পরে ফেরৎ এসে বলতো– পায়খানা হয় না।
লোকটা আর আসছে না।
আরেকজন ছিল ঘোষক। অর্কেষ্ট্রা পার্টির। খাটো ঝুলের হাফ হাতা জামা। মোটা কাপড়ের প্যান্ট। হাওয়াই চপ্পল।সস্তা গ্রাম্য অর্কেষ্ট্রার রদ্দি ঝকঝকে জামা পরা ঘোষকরা, ব্যক্তিগত রোজকার জীবনে যেমন হয় আর কি! ফেকলু মাল এক্কেবারে।
চপ্পলদুটো সর্বদা দরজার বাইরে খুলে ঢুকতো লোকটা। নমস্কার করতো সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আর হাত জোড় করে। তারপর… টুলে বসতো সসম্ভ্রমে। পকেট থেকে একটা বিচ্ছিরি মোটা কাচের চশমা বের করে পরতে পরতে, আরেক পকেট থেকে আউটডোরের পুরোনো টিকিট বের করে এগিয়ে দিত ধীরে ধীরে। মাথা, আরেকবার ঝুঁকতো তখন। যেন নৈবিদ্য দিচ্ছে ঠাকুরকে। এবং বলতো আশ্চর্য ব্যারিটনে
— মঞ্চের সামনে তখন শুধু আলো আর আলো। দর্শকেরা বসে আছেন আসনে। মা জননীরা, বড়দাভাইরা, সোনা মানিক লক্ষ্মী ফুটফুটে বালক বালিকারা। অনুষ্ঠান শুরু হবে এক্ষুণি। মাস্টার সাউন্ড চেক করছেন ক্যাসিওতে। আর আমি দাঁড়িয়ে আছি মাইক হাতে। আর কে? হ্যাঁ? আ-র কে? আর কে আছে আমার সাথে? আছে আমার বাম পাশে আমার রাধাগোবিন্দ আর আমার ডান পাশে… স্যার আপনি। আপনার এই যে অদ্ভুত সুন্দর মুখের হাসি। … রাধাগোবিন্দ আর ডাক্তারবাবু…আছেন আমায় আগলে ধরে। আমায় কে মারবে স্যার? আমার আর কী হবে! আমি হাসতে হাসতে বেঁচে থাকব আপনাদের আশীর্বাদে অবিরাম।
প্রথম প্রথম এসব শুনে হেবি ঘাবড়ে যেতাম আমি। লোকটার কণ্ঠস্বরটা ভারী অদ্ভুত রকমের। চেহারার সাথে এক্কেবারে সাযুজ্য বিহীন। কেঁচোর মত মাথা ঝোঁকানো একটা লোক, হঠাৎ করেই বৃক্ষ হয়ে উঠতো স্রেফ কথা বলতে শুরু করলে। বিনয়ের কথা বলে যেত অনলস স্পর্ধাতে। বলে যেত অনর্গল, অবিরল, একটানা। ঘাবড়ে তো যাবোই। তারপর ক্রমে বুঝতে শিখলাম ধীরে ধীরে। বুঝতে শিখলাম মঞ্চের পিছনের গল্পটা।
লোকটা প্রেশারের রোগী। অ্যামলোডিপিন খায় হাসপাতাল থেকে। নিয়ে যায় প্রত্যেকবারে দু তিন পাতা মতো। তারপর বেপাত্তা হয়ে যায় টানা তিন চার মাস। হাজির হয় হঠাৎ আবার একটা আচমকা দুপুরে। অর্থাৎ, ওষুধ খায়নি মাস দুয়েক।
এসব রোগীদের আমি বকাবকি করি মারাত্মক রকম। এতটাই মারাত্মক যে একবার ‘শিডিউলড ডেট ফেল’ করে দেখাতে আসা এক বুড়ি টুল উল্টে পড়ে যাচ্ছিল আমি প্রেসার মাপতে এগিয়ে যেতেই। চটজলদি ধরে টরে বসিয়ে বলেছিলাম– কী হলো রে বাবা! মাথামুথা ঘুরতেসে নাকি? মা?
তো বুড়ি বলেছিল লজ্জা লজ্জা মুখে– না না…। আমি ভাবলাম মারতে আসতেছ হামারে। টেইম মত আসিতে পারি নাই ত…।
শুনে আমি যুগপৎ লজ্জিত এবং গর্বিত হয়েছিলাম ঠোঁট টিপে।
মোটের ওপর এ বিষয়ে আমি এতটাই কুখ্যাত আর কুবিদিত। অর্কেষ্ট্রা পার্টির মক্কেল সে সব জানতো হাড়ে হাড়ে। আর তাই এইসব নাটক। আর তাই এইসব তেল মারা কথাবার্তা।
ক্ষেপেই গিছলাম সত্যিটা বুঝতে পেরেছিলাম যেদিনকে। বলেছিলাম— দেখবো না যাও। যত্তোসব ফালতু গুলবাজ পাবলিক। প্রেসারের ওষুধ খাও আর বন্ধ করে দাও… মরে যাবে এভাবে তুমি একদিন। ভাটের গল্প শোনাতে এসেছে অর্কেষ্ট্রার। যাও যাও… দেখবো না।
ভদ্রলোক একটিও প্রতিবাদ করেননি। শুধু, সমস্ত গালমন্দ মিটে যাওয়ার পর পুনরায় নৈবিদ্যর মতো করে তুলে ধরেছিলেন প্রেসক্রিপশনখানি।
আমি থেমে গিছলাম। সেইদিন থেকেই এ লোকটাকে আর একটুও বকাবকি করতে পারি না আমি। কুড়ি টাকায় একপাতা পাওয়া যায় এ ওষুধ স্বচ্ছন্দে। অথচ সেটুকুও কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। ঝকমকে জামা পরে থাকা একটা লোক, যে লোকটা মঞ্চে বাঘের মত দাপিয়ে বেড়ায় এদিক সেদিকে আর ফাংশন ফুরোলেই ভাড়ার জামা খুলে রেখে, ফুটো গেঞ্জি বুকে খামচে রেখে খুচরো হিসেব করে, সেই লোকটার জন্য আমার মনখারাপ হয়ে গিছলো বেয়াক্কেলে রকম।
আমি তাই গল্প করতাম তাই উল্টে।
— কোথায় গিছলে এবারে? হ্যাঁ? অর্কেষ্ট্রা নিয়ে?
— অনেকদূর স্যার। ধূপগুড়ি গেলাম। আলুর মহাজন সব। অসম্ভব খাতির করেছে। মাংস ভাত। পানীয় জল। তারপর আলিপুর, রাঙাপানি, হয়ে বিহার। বারসোই। মস্ত পরিভ্রমণ শেষ করে, কালকেই বাসায় ফিরেছি। আর ফিরে কি ফিরেই মনে পড়লো সদা হাস্যমুখ আপনার কথা…
দু টাকার ওষুধের জন্য যে রকম তেলতেলে ব্যবহার করতো লোকটা, ওর ছেলে মেয়ে দেখতে পেলে নিশ্চয়ই লজ্জা পেত খুব। কাঁদত একলা হয়ে। যেভাবে আমিও কেঁদেছিলাম আমার বাবাকে অফিসে পতাকা তুলতে দেয়নি বলে। অথচ, আমি জানতাম বাবা আমার বাঘ। সবখানের।
তো, সেই লোকটাও আসে না এখন আর। হয়ে তো গেল তিন মাসের মতো। এতদিনে এসে যাওয়ার কথা ছিল এখানে। কে জানে… হয়তো আটকে আছে কোনো ক্যাম্পে। কিংবা বারসোইয়ের কোনো অনামা জনপদে।
কিংবা ওই বুড়ো বুড়ির জুটিটা।
মলিন কাপড়, মলিন ধুতি। একজন কাঁধে আরেকজনের ভর দেওয়া। আসতো দুজনে মিলে সেই ডেঙ্গুয়াঝাড় পেরিয়েও আরো ওপার থেকে। এক এক পিঠে নয় নয় করে হলেও কিলোমিটার তিনেকের ধাক্কা। বুড়ির কাঁধে হাত রাখা বুড়ো। লাঠি ঠুকঠুক। হাঁফানি। প্রেসার। সেইসব দেখেটেখে বুড়োর হাতে প্রেসক্রিপশন ধরাতাম যেই, ওমনি কালচে দাঁত বের করে অনাবিল হাসত বোকার মত। হাত নেড়ে কাছে ডাকত বুড়িকে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলত বড় অনুনয়ের সুরে– অ্যাকেও একবার দেখি দ্যান কনে। হামার আর কেউ নাই রে বাপ। হামার…আর কেহ নাই।
লজ্জা লজ্জা মুখ করে বুড়ি এসে বসত তখন। এক ঝলক তাকিয়ে দেখে নিত বুড়োর দিকে। সেই তাকানোতে ষোড়ষবংশীয়া ব্রীড়া। সেই দৃষ্টিক্ষেপে, প্রেম এক যুগের।
এরাও আসছে না সেই লকডাউন লমহাঁর শুরুয়াৎ থেকেই। আর এইসবই আমার চোখে পড়তে শুরু করেছে ইদানীং। লক্ষ্য করতে শুরু করেছি বেশ কিছু অভ্যস্ত মুখের অস্বস্তিকর অনুপস্থিতি। বস্তুত, এসব লোকের সাথে জড়িয়ে মড়িয়ে থাকার একটা অনুভূতি আছে আশ্চর্য রকমের।
অনেকটা…কলঘরের দেওয়ালে জমে থাকা শ্যাওলার মত। অপাঙক্তেয়, অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু সবুজ। যে সবুজে হাত বুলিয়ে ক্ষণিক তীষ্ঠ হতে ভারী আরাম। যে সবুজ, শিকড়ের মত সুপরিচিত।
কেউ একজন বলেছিল আমাকে একদা। বলেছিল– এত জড়িয়ে পড়ো না সব্য। এত আটকে থাকতে নেই এক স্থানে।
আমাকে কেউ একদা ডেকেছিল এ হাসপাতালের ‘বাঞ্ছারাম’ বলেও। ভুল কিছু বলেনি। বাগান ছেড়ে সত্যিই নড়তে পারি না কিছুতে। ভয় হয়, আমার অনুপস্থিতিতে বুঝি পাল্টে যাবে সবটা। আর সেই ভয় নিয়েই খরস্রোতা নদীবক্ষে স্থবির নুড়ি হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। আর আমায় ক্রমে ক্রমে জড়িয়ে ধরছে সবুজ সংক্রমণ।
সে সংক্রমণ কোনোদিনও কাটিয়ে উঠতে পারব কিনা আমার জানা নেই। জানা নেই এই মহামারী কবে আর কিভাবে থামবে। শুধু…ইদানিং বারে বারে সমস্ত বিজ্ঞানমনস্কতাকে তফাতে সরিয়ে রেখে, অসহায় শিশুর মত প্রার্থনা করতে ইচ্ছে হয় অনির্দিষ্টের প্রতি। ইচ্ছে হয় বলি—
ঠিক করে দাও প্রভু দ্রুত। ঠিক হয়ে যায় যেন আগামী কাল ঘুম ভাঙলেই সবকিছু । আর আউটডোরে পৌঁছেই যেন দেখতে পাই ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে মায়া লেগে থাকা কয়েকটা শ্যাওলা।
অনুভূতি কখনো কমে না, ক্রমশঃ গভীর হয়। অসাধারণ লেখা।
ডাক্তার বাবুরা নমস্য গল্পকার। খুব নিবিড় চিনে নেন জীবন যেমন সাধক।
Eto Bhalo lekhen , shudhu lekhai uchit Apnar
কি আর বলব, ভালো থাকুন, আপনার শ্যাওলারা ফিরে আসুক, ক্যালেন্ডার এর পাতা পাল্টানোর আগেই…. Dr Tarakranjan GUPTA