এক
কানে হেডফোন চিপকে ‘ফ্রেন্ডস’ কিংবা ‘দা বিগ ব্যাং থিওরি’ দেখি যখন, অথবা চোখ বুজে শুনি রফি সাহাব, আখতারী কিংবা শচীন কত্তা, তখন চারপাশটায় আমার প্যারালাল ইউনিভার্স তৈরি হয়ে যায় কিয়দক্ষণিক। আমি হাসি, আমি গুনগুনাই, আমি ডুবে যাই মানবিক আমেজে। আমি ভুলে যাই বহির্বিশ্ব। আমি অগ্রাহ্য করি বাস্তবকে। আমার চারপাশ জুড়ে তখন কেবলই সুর, তাল, ছন্দ, লয়, প্রেম, বন্ধুতা।
ক্রমে সেসব ফুরিয়ে আসে। ক্রমে হেডফোন সরিয়ে, খাট থেকে নেমে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই আমি। উজ্জ্বল এক ফালি নখের মতো চাঁদ চিপকে আছে আশমানে। বাতাসে বাতাসে তীব্র সুবাস বাতাপি ফুল আর আম্র মুকুলের। পথবাতি জ্বলছে পুরসভার। খাঁ খাঁ করছে পিচ-সড়ক। জনা চারেক পথচারি মুখে গামছা আর চাদর ঢেকে দ্রুতপদে অপসৃয়মান। কুকুর শুয়ে আছে কুন্ডলী পাকিয়ে। চারিদিক জুড়ে মড়ক মড়ক স্তব্ধতা।
আমার এই প্রিয় ব্যালকনি, আমার এই পরিচিত চারিপাশ, আমার ওই বেডরুমের প্রিয় পরিজনটিকে ফেলে রেখে কালকে আরো একবার হাসপাতালে যাবো আমি। যাবো, করোনার সমস্ত সম্ভাব্য বিপদকে জেনেই। সে সময়ে হয়ত বহু চটুল পোস্ট দেওয়া চলছে সোশাল মিডিয়ায়, মিলনাত্মক কাহিনী রচনা করে চলেছেন কোনো শিল্পী, রাজনীতির মুন্ডপাত করে চলেছেন তরুণ তুর্কী ফেসবুকে।
চলুক সেসব। বহমানতার নামই তো জিন্দেগী।
এককালে যখন বয়স ছিল অল্প আর পরীক্ষা ছিল মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক, তখন এসব নিয়ে ভাবতাম খুব। আশ্চর্য, অনোখা একটা ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ক্যামেরাতে নিজেকেই নিজে দেখতে পেতাম আমি সেইদিনগুলোতে। মাথা নীচু করে পেরিয়ে যাচ্ছি জনপথ। মনের ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে ব্যাঙের রেচনতন্ত্র, বুকের ভিতর মোচড় মারছে এইচ এস, এইচ এস। সাইকেলে যাচ্ছি প্যাডেল মেরে মেরে। আর কেবলই ভাবছি— এই যে চারিপাশের প্রতিটা মানুষের এই হাস্য কলতান, এগুলো কি সত্যি? এদের বুঝি কিচ্ছু যায় আসে না আমার পাশ ফেল-এ?
এখন, এসব আর ভাবি না। এখন বড় হয়েছি আমি। কিংবা বুড়ো। বুঝতে শিখেছি, দা শো মাস্ট গো অন। সেইটেই স্বাভাবিক। কিন্তু আজ, এতদিন বাদে, আবারও অভিমান হচ্ছে ঠোঁট ফুলানো।
কেন এখনো ক্রোধ শান্ত হচ্ছে না জনতার? কেন এখনো ফিরছে না বাস্তববোধ? কেন এখনো দিকে দিকে আক্রান্ত হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মী? কেন এখনো চিকিৎসকের গায়ে থুতু দিচ্ছে রোগী? যে থুতু স্রেফ উষ্মাজাত নয়। যে থুতুর প্রতিটি কণায় জমে আছে চিকিৎসককুলের প্রতি ঘৃণা–” নে শালা তোর গায়ে করোনার জার্ম ছুঁড়ে দিলাম।”
এই সমবেত ঘৃণায় যদি জ্বলে পুড়ে মরে যাই আমি এবারে। এ-ই-বা-রে? এবারে যদি সম্পূর্ণ রূপে নিহত হয় আমার চিকিৎসক সত্ত্বা? যেটা, যেরকমটা, কখনো চাইনি আমি। চাইনি আমরা। ডেবরাতে যখন বিষ্ঠা মাখানো হলো আমাদের শরীরে, অথবা পূজা মন্ডপে অসুর নির্মাণ হলো ডাক্তারের আদলে, তখনও আমরা দাঁতে দাঁত চিপে কর্তব্য পালন করে গিছলাম দিবারাত্রি। আর আশা রেখেছিলাম– এ জাতি, এ সমাজ একদিন ঠিক বুঝবে। বুঝতে সক্ষম হবে বিভেদ নীতি।
হয়নি। আজ এই মহামারী আক্রান্ত আবহেও পারেনি বুঝে উঠতে। সমগ্র বিশ্বজুড়ে যখন প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মী নিজের জীবনকে বাজি রেখে দিনরাত লড়ে যাচ্ছে জগতের মঙ্গল কামনায়, তখনো না।
এই হিংসাত্মক আর ধ্বংসাত্মক পৃথিবীতে যদি আর ফিরে না আসি আমি? আমারও তো বেঁচে থাকতে সাধ হয় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়। আমাদেরও তো সুযোগ ছিল গ্যালারিতে বসে লড়াই দেখার । স্বেচ্ছায় সেসব ত্যাগ করে বুক চিতিয়ে রক্ষা করে চলেছি যে বিশ্বজগৎকে, সেই বিশ্ববাসীই যদি পেছন থেকে ছুরি মারে আমায় বিষাক্ত?
পারবো তো? যুদ্ধশেষে সেই বিশ্বেই ফিরতে? আমি তো…আমরা তো শহিদ হওয়ার বাসনা রাখিনি কখনো। আমরা চেয়েছিলাম বিজয়ী হতে।
হবোও। একদিন নিশ্চয়ই।
কিন্তু ততদিনে আমাদের মধ্যে থেকে অনেক আমি হারিয়ে যাবে। তলিয়ে যাবে জগৎব্যাপী ঘৃণার আবর্তে। বিস্মৃতিতে।
এরকমটা চাইনি।
তবুও, ভালো থেকো তুমি পৃথিবী। ভালো থেকো আমার স্বজন। ভালো থেকো সমগ্র চারিপাশ।
শুধু যদি পারো, ধর্ম আর বিনোদনের উর্দ্ধে উঠে সত্যটা খুঁজে নিতে শিখো।
স্বাস্থ্য, অন্ন, বাসস্থান এবং শিক্ষা।
জেনে রেখো, এ বাদে সকলই স্রেফ চুষিকাঠি। মাতৃদুগ্ধ ভুলিয়ে রাখার ছল।
ভুলো না। ভুলো না। ভুলো না।
এ কথা ভুলিও না কভু।
দুই
সারমেয়দের স্মৃতি সম্ভবত সাতদিন স্থায়ী। কালো রঙের নেড়িটাকে এক হপ্তা ধরে পর্যবেক্ষণ করে আমার অন্তত সেরকমটাই ধারণা হলো।
এর ঠিক এক সপ্তাহ আগে, এরকমই কোনো এক আউটডোর শেষের দুপুরে ব্রিটানিয়া মারি খাওয়াতে খাওয়াতে ওর গায়ে ওষুধ স্প্রে করে দিয়েছিলাম আমি। চুলকানির ওষুধ। মুখ চোখ বিকৃত করে ব্যাটা নিজেই নিজের পিঠটাকে কামড়াচ্ছিল বড্ডো। কপ কপ করে গিলে খেতে চেষ্টা করছিল ভনভনানো এঁটুলি। সেই থেকেই একটা দুটো ছোট্ট ছোট্ট দগদগে ঘা হয়েছে পিঠের লোমে। আর হবে নাই বা কেন? সারাদিন যত রাজ্যের নোংরা আর এঁটোকাঁটা ঘাঁটে। হাজার হোক, জাতে কুকুর তো!
তো তাই … এই কুকুরের ঘা সারানোর স্প্রে। রীতিমত খরিদ করে এনেছি বাজার ঢুঁড়ে। আর সেইটাই লাগিয়ে দেওয়ার মতলব করেছিলাম বিস্কুট খাওয়াতে খাওয়াতে।
এরা জোড়া। অর্থাৎ জুটি। একটা কালো, একটা পাটকিলে। বর বউ। কিম্বা প্রেমিক প্রেমিকা। ভারী লক্ষ্মীমন্ত স্বভাব এদের। চুমু টুমু খায় হরবখত। কান টান কামড়ে ধরে আলতো করে, নাকে নাক ঠেকায় মৃদু। আর কক্ষনো অন্যের ভাগের খাবার খেয়ে নেয় না কিছুতেই। অথচ সেরকম ট্রেনিং দিইনি আমি। এদের সাথে সখ্যতাই তো হলো মাস দুয়েক। এবং সেই অবধি দশ টাকার এক একখানা মারির প্যাকেট এদের হররোজের বরাদ্দ। দুটো নাগাদ আউটডোর শেষ করে রাউন্ডে যাই যখন, শুয়ে থাকে পথিমধ্যে। ঘাড় তুলে দেখে নেয় একবার। লেজ নাড়ে আলিস্যি জড়িয়ে। তারপর ঘাড় নামিয়ে আবার ঘুম। তিনটে নাগাদ ফেরত আসি যখন, ততক্ষণে উঠে বসেছে দুজনেই। থাবা গেড়ে রাখা সামনে। মারির প্যাকেট স্কুটিতেই রাখা থাকে। হাতে নিতেই মচমচ শব্দ প্লাস্টিকের। এবং সেই শব্দেই লাফালাফি শুরু করে দেয় এবার দুজনেই।
স্প্রে লাগানোর পরেরদিন থেকে সেই নিয়মে ছেদ পড়েছে। কর্তা গিন্নি দুজনেই আসেন। আদর খান। লেজও নাড়েন। তারপর মারির প্যাকেটের শব্দ শুনলেই কর্তা পালান মাথা নিচু করে। কান দুটো শরীরের সাথে মিশে আছে।
বেশি দূর যায় না অবশ্য। এই…হাত পাঁচেক। দাঁড়িয়ে থাকে মুখ ঝুলিয়ে। আমি এগোলেই, পিছিয়ে যায় আরো। বিস্কুট ছুঁড়ে দিলেও সন্তর্পনে শুঁকে দ্যাখে। চেটে নেয় জিভ বার করে বারেক। কিন্তু মুখে তোলে না কিছুতেই। নাকে বিস্কুটের গুঁড়ো সমেত করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।
আমার মনখারাপ হয়ে যায়। আমার দুপুর তিনটে পেরিয়ে সাড়ে তিনটে বেজে যায়। আমি ঘুরতে থাকি ওর পিছুপিছু। আমি ডাক দিই–” আঃ আঃ”। আর কথা বলি–” আয় না রে। আয় না। কিচ্ছু করবো না। এই যে দ্যাখ…দ্যাখ তাকিয়ে…আমার হাতে স্প্রে নেই…।”
দূরত্ব তবুও ওই পাঁচ হাত থেকে যায়। দুপুর পড়ে আসে পৌনে চারটে।
এটা, লক ডাউন পিরিয়ড। বড়ো কষ্টে, বড়ো সাধনায় খরিদ করা ব্রিটানিয়া মারির একটা প্যাকেট রোজ ভিজে যায় আমার হাতের ঘামে।
তবু … দূরত্ব কমে না।
আজ কমলো। আজ খেলো দিব্যি লেজ নেড়ে নেড়ে। অর্থাৎ, সাতদিন স্থায়ী সারমেয় স্মৃতি।
আজ মন ভালো হয়ে গেছে। খাঁ খাঁ লকডাউন পৃথিবীতে বেনেবউয়ের জোড়াটা আবার ফিরে এসেছে সদ্য। একটা কাঠ ঠোকরা, গোটা চারেক ছাতারে, কয়েকটা চড়াই এবং তুড়ুক নাচন ফিঙেও। কালোটিকে প্রাণ ভরে খাওয়াতে খাওয়াতে এসবই দেখছিলাম উন্মুখ হয়ে। গত তিন বছর এদের পাত্তা ছিল না মোটেই। ছিল না, দশ তলা সুপার স্পেশালিটি হওয়ার পর থেকে। এখন আবার ফিরে এসেছে সব।
খবরে পড়েছি সেদিনই, এগারোই মার্চ এ দুনিয়ার শেষ তিনটে সাদা জিরাফের দুটোকে মেরে দিয়েছে চোরা শিকারিরা। মা আর শাবক। ছানাটির বয়স, মেরেকেটে সাত মাস। একমাত্র সাদা পুরুষ জিরাফটি যদিও বেঁচে আছে। এ জগতে, ওদের শেষ প্রতিভূ। এ বিশ্বে তখন লক ডাউন চলছিল।
আচ্ছা, শেষ প্রতিভূ হয়ে বেঁচে থাকতে ঠিক কেমন লাগে? ফেসবুকের সবকটা সবুজ অ্যাক্টিভ স্ট্যাটাস নিভে গেলে? হাজার পোস্টেও যদি সাড়া না দেয় কেউ? কেউ যদি ভাতপাতে ভুরু কুঁচকে না বলে–” ডালটা চুমুক মেরে শেষ কর।”
পথে-ঘাটে আর ঘরে-মাঠে যদি আর দ্বিতীয় কোনো আমি না থাকে!
হাজার কাঁদলেও যদি কিছুতেই জড়িয়ে না ধরে কেউ? ধুলো মেখে রাস্তায় গড়াগড়ি খেলেও…?
ওজন স্তর নিজেই ঠিক হতে শুরু করেছে। এয়ারপোর্টের টারম্যাকে পাখির দল। উড়িষ্যার উপকূলে আট লক্ষ ডিম পাড়লো কাছিম।
এই ভালো। এবার, চলে যাওয়াই ভালো।
ওঁ অদ্যেত্যাদি ধন্বন্তরী গোত্রস্য পিতুরমুকদেবশর্ম্মণঃ পার্ব্বণবিধিক সাংবৎসরিক শ্রাদ্ধার্থং…..
তিন
তেল ভরাতে গিছলাম পেট্রল পাম্পে। আমরটা স্কুটি। হন্ডা অ্যাক্টিভা। এগারো বছরের প্রাচীন। তেল ভরতে হলে সিটটাকে উপরে তুলে ধরতে হয় ফুটখানেক। স্কুটি স্ট্যান্ড করিয়ে সেসবই করছিলাম। আশ্চর্য রকমের খাঁ খাঁ চারিধার। চারজন কর্মী। আমি একা খরিদ্দার। আর তখনই কানে এলো কথাটা– ” ডাক্তারগুলাই একা করতেসে! তাই না? আমরা তো বসে বসে হ্যান্ডেল মারতেসি! ফেসবুকে কেউ লিখছে? দেখছিস? হাম্দের নিয়ে?”
মুখ তুলে দেখি তিনজন পেট্রল পাম্প কর্মী গুলতানি মারছে চেয়ারে বসে। কোলে, টাকা রাখার ঝোলা। মুহূর্তে আমার চোখের সামনে দিয়ে পেরিয়ে গেল একগুচ্ছ মুখচ্ছবি।
পেট্রল পাম্পে আসার পথেই দেখতে পেয়েছি যাদের। দেখেছি, বেলচা দিয়ে স্তুপীকৃত আবর্জনা তুলে তুলে ছুঁড়ে ফেলছে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক্টরের ক্যারিয়ারে। দেখেছি, মুখে রুমাল বেঁধে উবু হয়ে বসে বসে পসরা আগলাচ্ছে তরি তরকারির। দেখেছি, সাইকেল ভ্যানে নিয়ে যাচ্ছে ঠংঠঙানো গ্যাস সিলিন্ডার।
গত দিন দশ পনেরো হলো ফোন করলেই একনাগাড়ে অনুযোগ শুনিয়ে যাচ্ছে আমার মা। সেই একই অনুযোগ বর্তমানে অধিকাংশ ভারতবাসীর মুখে মুখেই। ” ঘর মুছতে মুছতে আর বাসন ধুতে ধুতে কোমর খুলে গেল।”
এরা, সমাজের এই যে লোকগুলো, সাফাইকর্মী, ঠিকে ঝি , চট পেতে বসা সবজিওয়ালা কিম্বা লুঙিসমেত রিকশাওয়ালা, এদেরকে এতদিন অপাঙক্তেয় করে রেখেছিলাম আমরা। ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনি কখনো ভুলক্রমে। খুব বেশি হলে একটা বাড়তি পঞ্চাশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেছি তারিয়ে তারিয়ে। যাপন করেছি, দয়ালু নাগরিক আত্মপ্রসাদ। কিন্তু প্রশ্ন করিনি। প্রশ্ন করার কথা মাথাতেই আসেনি কোনোদিনো যে– এত তীব্র আর্থিক বৈষম্য থাকবে কেন একটা দেশে? কেন একটা দেশের অধিকাংশ মানুষের পরিচয় শুধুমাত্র ভোটাধিকারে? আজ, সেই প্রত্যেকটা মুখ আমাদের সবচাইতে নিকটজন, সর্বাধিক প্রয়োজনীয়, সব থেকে জরুরি হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে সুষ্পষ্ট ভাবে। যারা সবচাইতে জরুরি হয়েও, সবথেকে বঞ্চিত। আজ, কুয়াশা সরতে শুরু করেছে ধনতন্ত্রের। এতদিন যাদেরকে নিংড়েছি শুধু, আর উপেক্ষা করে ভাগিয়ে দিয়েছি চোখ বুজে, তারাই আজ দন্ডায়মান প্রশ্নচিহ্ন রূপে।
রিক্সা কিংবা টোটো এমনকি বাস চালানোও এ দেশে একটা লজ্জাজনক বৃত্তি। উদয়াস্ত কুকুরের মতো খেটে উপার্জন হয় অসম্মানের সামান্য অর্থ।
কাপড় কাচতে অথবা ঘর সাফ করতে একরকম আমরা ভুলেই গেছি। আমরা নিশ্চিন্তে ভরসা করে আছি ঝি/কামিনদের উপরে। যাদের মাইনে, কোথাও মাসিক তিনশো, কোথাও এক দেড় হাজার। তিনটে বাড়িতে কাজ করলে সাকুল্যে বারোশ থেকে তিন হাজার।
এই মানুষগুলো এখন আমাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
এটা চৈত্র মাসের শেষ। মাঠে মাঠে এখন গম কাটার সময়। সময় ভুট্টা ছাড়ানোর, বোরো ধানে সার দেওয়ার, পাটের বীজ বপনের।এ সময়েই বপিত হবে আউশ ধান কিংবা মুগ কলাইয়ের ডাল। লকডাউনে সেসব বন্ধ রয়েছে কি? বন্ধ থাকলে, এরপর খাবো কী সেইটে ভাববার সময় এসেছে এবারে। সময় এসেছে ক্রিকেট, সিনেমা, আর ধর্ম জিগিরের বাইরে বেরিয়ে একবার জগতটাকে উঁকি মেরে দেখবার। যে জগতটা বাস্তব। যে জগতটা ব্যতীত মানুষ নামক জাতটার অস্তিত্বটাই প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে যাবে।
একটার পর, একটার পর, একটার পর একটা একটা মুখ। তাকিয়ে আছে মুষ্টিমেয় কিছু আমাদের দিকে বুক চিতিয়ে। আর আমরা বুঝতে শিখছি একটু একটু করে ‘নূন্যতম প্রয়োজনীয়তা’ ঠিক কী আর কোন কোনগুলি।
লকডাউন শুরু হওয়ার ঠিক তিনদিনের মাথায় আমার আউটডোরে এসেছিল বারোজন মানুষ। এরা, পেশায় রাজমিস্ত্রী। নো ওয়ার্ক নো পে কড়ারে মালদা থেকে একটা ম্যাটাডোরে গাদাগাদি করে এসেছে আরো জনা কুড়ি সহকর্মী সহ। এখন, ফিরতে পারছে না বাড়িতে। এখন… টিঁকতে পারছে না এখানেও। লোকজন দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে করোনা রোগের ভয়ে। ওরা তাই এসেছে সার্টিফিকেট নিতে। ফিটনেস সার্টিফিকেট। সেসবই পরীক্ষা করতে করতে একটা চমৎকার বিষয় মাথায় এলো।
ভাগ্যিস করোনা হয়েছে। অন্তত এই লোকগুলোর অস্তিত্বটুকু তো চোখে পড়লো ‘সুসভ্য’ জনগণের। বুঝতে তো শিখলো, এদেরকে বাদ দিয়ে ছদ্ম নিরাপত্তায় থাকা যাবে না। আমি রোগ এড়িয়ে চলতে পারবো না কখনোই যদি আমার ড্রাইভার, আমার পরিচারিকা, আমার মিস্ত্রী এবং আমার বাড়ির সামনে মাটিতে বসে থাকা ভিক্ষুকটি রোগগ্রস্ত হয়। এই ভয়টাও জরুরি ছিল এ দুনিয়াতে।
গত পরশুই রাউন্ড শেষ করে যখন বেরিয়ে আসছি আমি, আজিজুল পাকড়াও করেছিল আমাকে।
–” ছুটি দিবে না গ?”
–” লক ডাউন চলছে আজিজুল। যাতায়াত বন্ধ। আর তাছাড়া তোমার এক্স ডি আর টিবি হয়েছে। এত জলদি বাড়ি গিয়ে করবেটাই বা কী
— ফসল তুলার সময় যে। ট্রাক্টর ভাড়া…কত কাজ। সারা বচ্ছর নাহলে কি খাবো? গরীব মানুষ আমরা ছার…
— সে একটা ব্যবস্থা করা যাবে তখন। এখানে থাকো না ক’টা দিন। ‘বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো’ করবে না একদম
— আল্লা মালিক! আল্লায় জানে কী হবে। কিন্তু ধান না কাটলে, তোমরা কী খাবে গ ডাক্তারসাব?
চার
গত মঙ্গলবার নাইট এমারজেন্সি ডিউটি করতে হাসপাতালে ঢুকছি যখন, রাত তখন পৌনে নটা প্রায়। খাঁ খাঁ করছে প্রকান্ড সুপার স্পেশালিটি চত্ত্বর। তীব্র ব্লিচিংয়ের গন্ধে মড়ক মড়ক গাম্ভীর্য। সিকিউরিটি গার্ডরা দাঁড়িয়ে আছে আতঙ্কিত চোখ মুখে। আমায় দেখে হাসলো– নাইট নাকি? স্যার?
সেসব কুশল বিনিময় সেরে, চেয়ারে বসতে বসতে রাত ন’টা। অন্যান্য দিন এসময় লবিটা থিকথিক করে রোগীর কাতরোক্তি আর পেশেন্ট পার্টির কলরব সহযোগে। মৃদু বাক বিতন্ডা, তীব্র মোবাইলের রিংটোন, ধাতব ট্রলির ঘড়ঘড়। আজ, সবটাই বেবাক ফাঁকা। কে যেন অদৃশ্য অক্ষরে বাতাসে বাতাসে লিখে দিয়েছে– ভয়।
প্রথম রোগীটি এলো মিনিট পঁয়তাল্লিশের মাথায়। দ্বিতীয়টিও তার পিছু পিছুই। তারপর…আবার সব শুনশান। চেয়ারে বসে বসে ভ্যাবলার মতো ভেবে যাচ্ছিলাম আকাশ পাতাল। পাঁইচারিও করলাম খানিক বাদে বাদেই। তবুও…সময় আর কাটে না। এরকমটাতে অভ্যস্ত নই আমি গত পনেরো বছর। এমার্জেন্সি ডিউটি হয় ঝড়ের মত। শ্বাস ফেলবার ফুরসত অব্দি থাকে না। বড্ডো বিরক্তিকর লাগছিল সবটা তাই।
সহসা, সামান্য শোরগোলে বুঝলাম তৃতীয় পেশেন্টটি আসছে। এলোও। কালি মাখা ফুলপ্যান্ট আর ফুল শার্ট পরা একটা নেড়ামুন্ডি কিশোর। তার পিছন পিছন একজন সুবেশ ভদ্রলোক। ভদ্রলোকটি নরম গলায় ভরসা জোগাচ্ছেন ছেলেটিকে– চল্ না। চল্… কিচ্ছু হবে না। আয়… খেতে দেবে তো। আয়..। ছেলেটি ইতস্তত করে এসে বসলো সামনের টুলে।
কিছু কিছু বেশভূষা এমন হয়, যেগুলো দেখলেই টের পাওয়া যায় মানুষটির পেছনের অর্ধেক গল্পখানি। এ ছেলেটিরও তাই। কালিঝুলির দাগ সুস্পষ্ট ভাবে বলে দিচ্ছিল– ছেলেটা মোটর মেকানিক। আর ফ্যালফ্যালানো চোখ দুটো একসাথে বুঝিয়ে দিচ্ছিল ক্ষুধা, লজ্জা, ভয়, আড়ষ্টতা।
— রাস্তায় পড়েছিল…বুঝলেন ! খেয়ে টেয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি, কে একটা ধূলার মধ্যে শুয়ে আছে রোডের ধারে। তো টর্চলাইট জ্বেলে দেখি– এ। নাম টাম কিছুই তো বলতে পারে না। মেন্টালি একটু ইয়ে মনে হয়। ভাত ডাল দিলাম। উঠোনে বসে খেলো। হাসলোও। তারপর আবার রাস্তায় নেমে শুয়ে পড়লো। …বোঝেন! কী করি আমি ? এদিকে কেউ বেরোচ্ছে না। সবাই জান্লা দিয়ে দেখছে। করোনার ভয়, বোঝেনই তো। কিন্তু তাই বলে একটা ছেলে…। এভাবে…। একটা টোটোওয়ালাকে হাতে পায়ে ধরে তারপর এখানে নিয়ে এলাম। একটু যদি দয়া করে আপনি এখন…। আর কোথায়ই বা যাবো বলুন..।
দয়া করার কিছুই নেই। ভদ্রলোকের শেষ কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এরকম রোগী প্রায়শই ভর্তি হয়ে চলেছে প্রতিটা সরকারি হাসপাতালে। একটা টেম্পুরারি মাথা গোঁজার ঠিকানা। লোকজন ধরে নিয়ে এসে ভর্তি করে দেয়। কাঁধ জড়িয়ে ফটো টটো তোলে। তারপর হাওয়া হয়ে যায়। আগামী বেশ কয়েকটা দিন তারপর এদের ঠিকানা– সরকারি হাসপাতাল। সরকার খেতে দেয়। জামা কাপড় এনে দেয় স্বাস্থ্যকর্মীরা। এবং শেষমেশ সুস্থ হয়ে পথে বেরিয়ে পড়ে এরা আবার। কিম্বা মাসের পর মাস ধরে আঁকড়ে থাকে হাসপাতালেরই একটা বেড। বন্ধু হয়ে যায় সিস্টার দিদিদের। এবং একসময় মারা যায়। সমগ্র ওয়ার্ড জুড়ে সেদিন সক্কলের মন খারাপ।
এদেরকে আর কেউ পুঁছেও না। খুব জোর হলে সংবাদ পত্রে খবর বের হয়– হাসপাতালের বেডে নোংরা জামা পরে ধুঁকছে মানবতা। এবং এদেরকে বেসরকারি নার্সিংহোমের গেট থেকেই ভাগিয়ে দেওয়া হয় দূর দূর করে।
একবার, আমার তখন বয়স বেশ অল্প। খেপ খাটছি কোলকাতার একটা নামজাদা নার্সিংহোমে। ঘন্টায় ষাট টাকা মাইনে। দিব্যি চলে যায় তাতেই ব্যাচেলার লাইফ। উইকএন্ডে সিনেমা আর ইটিং আউটও। ওই তখনকারই একটা দিনের ঘটনা। সেদিন ‘চব্বিশ ঘন্টা’ শিফট চলছে আমার। হঠাৎ, বেশকিছু লোকজন একটি যুবককে চ্যাংদোলা করে নিয়ে এলো। ছেলেটির সমগ্র শরীরে ভেজা ভেজা বালি কাদা লেপ্টে আছে। চোখ, বিস্ফারিত।
সমবেত হইচই থেকে যতদূর বুঝলাম, ছেলেটিকে কেউ চেনে না এ পাড়ায়। ইলেকট্রিক খাম্বার ওপরে উঠে কিসব কাজ করছিল। তারপর ‘ শট’ খেয়ে নীচে পড়ে গেছে। এরা ধরে নিয়ে এসেছে তারপর এইখানে।
দ্রুত ‘ আই সি ইউ’ তে তুলেছিলাম যুবকটিকে। আধা ঘন্টার কসরতের পর সে ছেলে বেঁচে ফিরলো। জনতা ততক্ষণ অপেক্ষা করেছিল বাইরে। ‘বেঁচে গেছে’ শুনে তৃপ্ত মুখে চলে গেল। বলে গেল– আপনারাই ভগবান।
তখন বয়স আমার অল্প। দুনিয়ার দিকদারির বেশিরভাগই শিখে উঠতে পারিনি ভালো ভাবে। এক আকাশ জোড়া খুশি নিয়ে রেস্টরুমে ফেরত এলাম। পাতা ওল্টাচ্ছিলাম গল্পের বইয়ের।
খুব বেশি হলে মিনিট কুড়ি পেরিয়েছে, ধড়াম করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এলেন বস। নার্সিংহোমের মালিক। কাছাকাছিই একটা হাউজিং কমপ্লেক্সের সাততলায় থাকেন। এ নার্সিংহোমের রিশেপশনিস্ট হলো ওনার শ্যালিকা, টেকনিশিয়ান খুড়তুতো ভাই, লিফটম্যান দেশওয়ালি বেরাদর। ভদ্রলোকের স্ত্রী অত্যন্ত অভব্যের মতো বিসদৃশ সাজগোজ করে রাত নটায় কাউন্টারে বসে বসে টাকার হিসাব করেন। অত্যন্ত অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করেন স্টাফদের। নার্সিংহোমটি, এদের পারিবারিক ব্যবসা।
বস ভদ্রলোকের মুখটা দেখলাম গনগন করছে রাগে। হাতের এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফেরত আসছিল আবার। সেটাকেই ফটাস করে থামিয়ে চিৎকার করে উঠলেন বাঘের মতো—” ইউ…মোরন… ইউ ইডিয়ট! তুমি কি পাগল নাকি ভাই? শট খাওয়া পেশেন্টকে ভর্তি করলে কাকে জিগ্যেস করে? হ্যাঁ? কাকে? কে বিল দেবে? তুমি? …”
আমি বড়ই বোকা ছিলাম। এরপরেও বলতে গিছলাম– একটা লোক মরে যাচ্ছে… তাকেও…বিল..!
ভদ্রলোক অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন– এটা ওনার ব্যবসা। সরকারি হাসপাতালের কাবাড়িখানা নয়। ভবিষ্যতে এ বিষয়টি যেন মাথায় রাখি আমি। তারপর বেরিয়ে গিছলেন চিৎকার করতে করতে–” আই সি ইউ এর দেড় ঘন্টার চার্জ… ডি-ফিবের ভাড়া… সিস্টার, সি-স্টা-র, এটাকে এখনই জেনারেলে ঘাড় ধরে বের করে দিন… আমি পার্টি অফিসে ফোন করে একে ভাগাবো তারপর…।
ঠিক ওইদিন, ওই মুহূর্তে নার্সিংহোমটি ছেড়ে দিই আমি। অত্যন্ত বোকার মতো কাজ হয়েছিল যদিও। পেটে কিল মেরে ঘুরে বেড়ানোর কোনো অর্থ হয় না। অজস্র নার্সিংহোম এই একই নিয়ম মেনে চলে। ঠিক যেমন চলে বেসরকারি ইস্কুল। দুনিয়ার যত গরীব দুঃখী এবং ডিফারেন্টলি এবেইল্ড চাইল্ড, সব্বাই এসে ভর্তি হয় সরকারি ইস্কুলে। বেসরকারি সবকিছুই একটি বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ। তাতে, শিক্ষিত জনগণের খুব একটা হেলদোল হয় না যখন, আমিই বা কেন খালি পেটে বিপ্লব করি? আমি কি যীশুখ্রীষ্ট না রবিন হুড। কিন্তু ওই যে! রক্ত গরম যৌবন! চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম এক ঝটকাতে। এখন হলে, হয়ত পারতাম না আর।
তো মোটমাট কথা সেদিন থেকেই আমি জানি যে, এসব রোগীদের সরকারি হাসপাতাল ব্যতীত যাওয়ার কোথাও নেই। আর শুধু কি এরা? পক্স বা মিজলসের মতো সংক্রামক রোগীদেরও ভর্তি নিতে চায় না সহজে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সেসব আমার জানা হয়ে গেছে গত পনেরো বছরে। সেদিন ওই কালোঝুলো ন্যাড়ামুন্ডি ছেলেটাকে এমার্জেন্সিতে তাই ভর্তি নিয়ে নিলাম দ্রুত।
সঙ্গের ভদ্রলোকটি সত্যিই ভালো মানুষ। ছবি তোলাতুলির ধারপাশ দিয়েও গেলেন না। পরিবর্তে ‘ থ্যাঙ্ক ইউ.. আপনারা সত্যিই ভগবান” বলে দাঁড়িয়ে রইলেন এক পাশে।
ওয়ার্ড বয়ের সাথে ছেলেটিকে ওয়ার্ডে পাঠাতে গিয়ে অবশ্য বেগ পেতে হলো কিঞ্চিৎ। ছেলেটি কিছুতেই রুম ছেড়ে বেরোবে না। গুটি সুটি মেরে বসে আছে চুপ করে। শেষমেশ আমিই উঠে এলাম–” যা বাবু… যা। ভাত দেবে। ভা-ত। খাবি না? ভাত ডাল তরকারি? যা..।”
এসব কথায় কাজ দিল। ছেলেটি উঠে দাঁড়ালো। ওয়ার্ড বয়ের সাথে সাথে এগোলো খানিকটা। তারপর হঠাৎ ফেরত এলো আমার কাছে। জামা তুলে, প্যান্টের মধ্যে থেকে কিসব বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল ধীরে ধীরে। যেন গুপ্তধন দিচ্ছে। চোখের ভাষা পরিস্কার– সামলে রাখো। সামলে রেখে দাও তোমার কাছে।
একটি রেঞ্চ, একটি প্লাস। ছেলেটির এ জীবনের একমাত্র সম্পদ। সম্ভবত জিম্মা রাখতে চেয়েছিল আমার কাছে। নিলাম না। হেসে বললাম–” যা, রেখে দে সঙ্গে করে। কাজ করবি না ছুটির পর?”
এই প্রথম ছেলেটি হাসলো। ‘গোগ্গা’ টাইপের একটা শব্দ করে চলে গেল গটমট।
আমি চেয়ারে এসে বসলাম। আর ভদ্রলোক চলে গেলেন খুশি খুশি মুখে–” বাঁচালেন ডাক্তারবাবু… এদের তো করোনা হওয়ার চান্স ম্যাক্সিমাম। বাড়ির সামনে এভাবে পড়ে থাকলে..। আজ যদি কাছাকাছি সরকারি হাসপাতাল না থাকতো…।”
যাক। ‘এদের’ তাহলে চোখে পড়তে শুরু করেছে এবার সকলের। চোখে পড়তে শুরু করেছে–” সরকারি সংস্থা’র প্রয়োজনীয়তা।
পাঁচ
আন্ট মে বলেছিলেন স্পাইডারম্যানকে। বা বলা ভালো পিটার পার্কারকে। যে পিটার পার্কার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আর কখনো স্পাইডারম্যান হয়ে জগতকে রক্ষা করবে না কিছুতেই। মে নামক পক্ককেশ এক খুড়ীমা চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন সেদিন তার সেই পিটার নামের ভাইপোটিকে–” এভরি বডি লাভস আ হিরো। হিরোকে… সব্বাই ভালোবাসে। সব্বাই চায় একজন মহান, কর্তব্যনিষ্ঠ, নীতিপরায়ণ মানুষকে, যে মানুষ সমস্ত রকম জাগতিক আঘাত সহ্য করেও হাসিমুখে গোটা পৃথিবীকে রক্ষা করে যাবে। ”
বলেছিলেন–“পিটার… এ জগৎ বড়ো নিষ্ঠুর। এ জগতের কোনো মানুষই অপরের কথা ভাবে না। কিন্তু যারা ভাবে, যারা সমস্ত টিটকারি, সমস্ত উপহাস আর সমস্ত ঘৃণাকে সহ্য করেও দুর্যোগের রাতে জগতবাসীকে বলে–আর একটু…আর কিছুক্ষণ…তারপরই ঝড় থেমে যাবে…আছি আমি ততক্ষণ তোমাদের পাশে… তারাই হলো হিরো। সক্কলে তাদেরকে ভালোবাসে। আর ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা স্বপ্ন দ্যাখে–বড় হয়ে আমি ঠিক ওইরকমটি হব।”
আজ, এই দুঃস্বপ্নের দুনিয়াতে দাঁড়িয়ে, এসব জ্ঞানগর্ভ কথাকে আমার নিছক ফিল্মি ডায়ালগ বলে মনে হয়। মনে হয় গলা তুলে চিৎকার করে বলি–” এভরিবডি লাভস আ হিরো। বাট নো বডি ওয়ান্টস টু বিকাম ওয়ান। হাততালি দিয়ে ফাঁসির মঞ্চে কিংবা জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে এগিয়ে দেয় সব্বাই হিরোকে। তারপর নিজ নিজ গৃহে ফিরে এসে তাস খেলে। আড্ডা মারে। ধর্মীয় ঘৃণা বকবকায়। এবং সুযোগ পেলেই ফণা তোলে বিষাক্ত– হিরো ব্যাটা কর্তব্যে ফাঁকি দিয়েছে।
গত বুধবার, পয়লা এপ্রিল, মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর নামক শহরের টাটপট্টি বাখল অঞ্চলে পাঁচজন স্বাস্থ্যকর্মীকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। লাঠি সোঁটা নিয়ে তেড়ে গেছে হিংস্রভাবে। কেন? কোন অপরাধে? কারণ ওই স্বাস্থ্যকর্মীরা সেখানে গিছলেন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের স্ক্রিনিং করতে। গিছলেন, যেন এ রোগ ছড়িয়ে না পড়ে কিছুতেই অন্যদের মধ্যে।
এ সবের পরেও, ঠিক তার পরেরদিন ওইখানে ওই স্বাস্থ্যকর্মীরাই ফেরত গেছেন করোনা স্ক্রীন করতে।
দেশজুড়ে অসংখ্য মানুষ হাততালি দিয়েছেন তাতে। এবং এসবে এখন আর আমি আশার আলো খুঁজে পাই না এতটুকু। এসব গা বাঁচানো হাততালি আর বুকে লুকিয়ে রাখা চিকিৎসক-বিদ্বেষ দেখে দেখে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আশা হারিয়ে ফেলেছি এটা ভেবে নিতেও যে, করোনা পরবর্তীতে চেতনা ফিরবে বিশ্ববাসীর। ধর্মের উর্দ্ধে উঠে, বিনোদনের উর্দ্ধে উঠে, সীমান্ত যুদ্ধের উর্দ্ধে উঠে সোচ্চার এবং সচেষ্ট হয়ে উঠবে স্বাস্থ্যের দাবীতে।
নাহঃ। এসব নাটুকে ভরসার কথা আমার আসে না আর।
এখন আমার ভালো লাগে স্রেফ এটুকু শুনতে যে, এদেশে এখনো শিশুরা ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দ্যাখে। হিরোর মত হয়ে উঠতে চায় নিজেরাও একদিন।
ওই শিশুদের ওপরেই ভরসাটুকু টিঁকে আছে আমার স্রেফ। আজও।
ওই শিশুরাই হয়ত সত্যিকারের সুদিন নিয়ে আসবে এ দুনিয়াতে। পৃথিবীতে হিরোর প্রয়োজন ফুরোবে যেদিন। যেদিন… মানুষ হতে শিখবে সকলে।