আগের সাত-আটশ বছর থেকে যিশুখ্রিস্ট জন্মানোর পরের তিন চার শতক অবধি, অর্থাৎ যতদিন না অবধি রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্ম বেশ জাঁকিয়ে বসল, ততদিন অবধি এসক্লেপিয়াস-এর হাতের দণ্ডটিই নিরাময় ও সুস্বাস্থ্যের প্রতীক ছিল। তার পর ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা এসব গ্রিক দেবদেবী ও তাঁদের ঘিরে বিভিন্ন গালগল্পকে বিষবৎ পরিত্যাজ্য বলে মনে করতে থাকলেন – অবশ্য চিকিৎসাবিদ্যা ব্যাপারটিকেও প্রায় বাদ-ই দিয়ে দিয়েছিলেন, চিকিৎসার চাইতে প্রার্থনা ঢের কার্যকরী এরকমই ছিল বিশ্বাস – বাকি সবকিছুর মতো ‘’রড অফ এসক্লেপিয়াস’’-ও পরিত্যক্ত হলো। ফিরে এলো আবার ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে, রেনেসাঁসের পরেপরে। কিন্তু ডাক্তারির আরেকটি বহুলব্যবহৃত প্রতীক? ক্যাডুসিয়াস? যা কিনা হার্মেস-এর হাতে থাকত, সেই ক্যাডুসিয়াস-এর গল্পটা কী?
দেবতা হন বা যা-ই হন, হার্মেস লোক হিসেবে ভালো নন। পুরাকাহিনী অনুসারে, যেদিন জন্মেছিলেন সেদিন সন্ধেবেলায়ই হার্মেস তাঁর সৎদাদা অ্যাপোলোর কিছু পালিত পশু চুরি করে নেন – একেবারে সম্ভাবনাময় শুরু যাকে বলে! সুচতুর, বাকপটু, অতিমাত্রায় দক্ষ এবং নীতিবোধহীন – হার্মেস-কে চিনতে হলে মোটামুটি এ-ই।
দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম – এবং দ্রুত পরিভ্রমণে – দেবতারা এক স্থান থেকে অন্যত্র বার্তা পাঠাতে হার্মেস-কে ব্যবহার করতেন। আবার দুই বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে ঝুটঝামেলা থামাতেও হার্মেস-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকত। একবার নাকি দুটি সাপের মধ্যে মারপিট ঠেকাতে তিনি নিজের হাতে থাকা দণ্ডটি মাঝে গেঁথে দিয়ে দুটি সাপকে বিচ্ছিন্ন করেন – হার্মেস-এর হাতের ক্যাডুসিয়াস-এ দুটি সাপের জড়িয়ে থাকার প্রতীকের উদ্ভব এভাবে, সঙ্গে দ্রুত ভ্রমণক্ষমতার কারণে ক্যাডুসিয়াস-এর ওই দুটি ডানা।
আবারও মনে করানো যাক, লোক হিসেবে হার্মেস খুব একটা সুবিধের ছিলেন না। তএকবার তো অ্যাপোলো চটেমটে গিয়ে বলেই ফেলেছিলেন – দেবতা যখন, পুজো তো তুমি পাবেই। কিন্তু তুমি ছিঁচকে চোর, সিঁদেলচোর, গরুচোর, চিটিংবাজদের আরাধ্য দেবতা হবে। অ্যাপোলো-র কথা বৃথা হয়নি। হার্মেস মোটামুটি তেমন মানুষদেরই আরাধ্য দেবতা ছিলেন। তবু মনে করানো যাক, দেবতাদের সঙ্গে বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপ করে থাকলেও মানুষের প্রতি হার্মেস কখনোই কোনও অন্যায় করেননি, বরং এক্ষেত্রে তাঁকে বেশ পরোপকারীই বলা যায়। তাই, গোলমেলে লোকজনের পাশাপাশি আরও অনেকেই হার্মেস-এর পুজো করতেন। যেমন, বণিকসমাজ হার্মেস-এর আরাধনা করতেন, সম্ভবত ডিলমেকার হিসেবে হার্মেস-এর দক্ষতার কারণে। দ্রুত ভ্রমণক্ষমতার কারণে তিনি পরিব্রাজক-পর্যটকদের আরাধ্য ছিলেন। তো তিনি ডাক্তারির প্রতীকও হয়ে উঠলেন কী করে?
ভালো কথায় বলতে গেলে, ভুল করে। আর সত্যি কথা বলতে হলে, পুরাকাহিনী মিথ ও প্রতীকের তাৎপর্য বিষয়ে অজ্ঞানতা ও অশিক্ষার কারণে।
উনিশ শতকের শেষের দিকে মার্কিনদেশে চিকিৎসাবিদ্যার প্রতীক হিসেবে ক্যাডুসিয়াস মাথা চাড়া দেয়। লন্ডনের জন চার্চিল, প্রকাশক, সেসময় আমেরিকায় ডাক্তারি বই পাঠাতেন, তিনি অনেক বইয়ের প্রচ্ছদে ক্যাডুসিয়াস ছাপ ব্যবহার করতেন – অনেকে মনে করেন, এভাবেই মার্কিন ডাক্তারদের মনে রড অফ এসক্লেপিয়াস আর ক্যাডুসিয়াস গুলিয়ে যেতে থাকে। তবে জন চার্চিল দুটি সাপের ছবি ব্যবহার করতেন মেডিসিন ও লিটারেচর-এর প্রতীক হিসেবে – কেননা, দুটির উপযুক্ত মিশেল ছাড়া ডাক্তারির ভালো টেক্সটবই হতে পারে না (আহ্, এই কথাটা যদি এখনকার ডাক্তারি বইয়ের লেখকরা মনে রাখতেন!)। তিনি নিজে কখনোই দুটি প্রতীককে গুলিয়ে ফেলেননি, যার প্রমাণ, বইয়ের মধ্যে তিনি যথাস্থানে রড অফ এসক্লেপিয়াস-ও ব্যবহার করেছেন – কিন্তু আম-ডাক্তারের মনে দুটি প্রতীক গুলিয়ে যাওয়ার শুরু, সম্ভবত, তাঁর হাত ধরেই।
তবে এই ভুল জনপ্রিয় করার ব্যাপারে আসল কৃতিত্ব মার্কিন সেনাবাহিনীর ডাক্তার ফ্রেডেরিক রেনল্ডস-এর। ১৯০২ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর ডাক্তারদের নতুন পোশাক ও নতুন কলার ব্যাজ তৈরির সময় তিনি প্রস্তাব রাখেন, যাতে ক্যাডুসিয়াস এবং রড অফ এসক্লেপিয়াস মিলিয়ে-মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। রড অফ এসক্লেপিয়াস-এর প্রতীকী গুরুত্ব বিষয়ে তিনি যে কতখানি কম জানতেন, তার প্রমাণ – চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, cock of Asclepius.(ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন)। যা-ই হোক, তাঁর প্রস্তাব শুরুতে প্রত্যাখ্যাত হয়। তিনিও ছোড়নেওয়ালা নন – একাধিক চিঠির আদানপ্রদানের পর তাঁর প্রস্তাবটিই গৃহীত হয়।
এর পনের বছর বাদে, মার্কিন সেনার সার্জেন জেনারেল লাইব্রেরিয়ান আক্ষেপ করেছিলেন, এদেশে ইতিহাস এবং মানবিক দিকগুলোকে বড্ড অবহেলা করা হয়, নইলে ক্যাডুসিয়াস কখনও চিকিৎসাবিদ্যার প্রতীক হতে পারে! কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়েই গিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা হলেও, এখনও, সেদেশে, বেসরকারি চিকিৎসা-প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশতেই প্রতীক হিসেবে ক্যাডুসিয়াস ব্যবহৃত হয়, এমনকি অনেক সরকারি ক্ষেত্রেও তা-ই। আস্তে আস্তে বিশ্বের অন্যত্রও ক্যাডুসিয়াস-এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে – এমনকি আমাদের দেশের চিকিৎসাশিক্ষার শীর্ষ প্রতিষ্ঠান অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস ওরফে এইমস-এর লোগোতেও জ্বলজ্বল করছে ক্যাডুসিয়াস। অথচ, ডাক্তারির যে মূল স্পিরিট, তার সঙ্গে হার্মেস-এর দূরত্ব অনস্বীকার্য (যদিও বর্তমানকালের বাণিজ্যমুখী ডাক্তারি বা ‘’চিকিৎসা পরিষেবা’”-র সঙ্গে হার্মেস-এর ক্রিয়াকলাপ খুব দূরে নয়)।
তো যা-ই হোক, হার্মেস-ই বলুন বা এসক্লেপিয়াস – ক্যাডুসিয়াস বা রড অফ এসক্লেপিয়াস – কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই ধর্মীয় অনুষঙ্গ-বিরহিত প্রতীক হয়ে উঠতে পেরেছে। গ্রিসের পতন এবং রোমে খ্রিস্টধর্মের বাড়বাড়ন্তর সময় তো এমন প্রতীক সম্পূর্ণ বর্জনীয় ছিল। হাজার বছর বাদে যখন রড অফ এসক্লেপিয়াস ফিরে এলো, তা পুরনো ধর্মীয় অনুষঙ্গ ঝেড়ে ফেলেই ফিরল। সে সময় প্রটেস্ট্যান্ট-রা চিকিৎসাবিদ্যার মতো ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ে একখানা খ্রিস্টীয় প্রতীক চালু করার কথা ভাবেননি।
প্রাচীন যেকোনও চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতোই, আয়ুর্বেদেও বিস্তর দেবদেবীর উল্লেখ আছে। কিন্তু কোনও দেবতা আয়ুর্বেদে প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন, এমন শুনিনি। ডাক্তারির বৈদিক দেবতা ধরলে ধন্বন্তরি নন – সেখানে অশ্বিনীকুমারদের নাম আছে – অর্থাৎ দুই ভাই। তাঁদের গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং। অশ্বিনীকুমারদ্বয়, চিকিৎসকের যথার্থ আদর্শ অনুসরণ করেই, সবার চিকিৎসা করতেন। মানে, দেবদেবী মানুষ, সবার। বাছবিচার ছাড়াই। কিন্তু এতে দেবতাকুল ভয়ানক বিরক্ত হলেন। দেবদেবীদের চিকিৎসা যিনি করবেন, তিনি আবার তুচ্ছ মনুষ্যকুলের চিকিৎসাও করবেন – এ আবার কেমন কথা! অশ্বিনীকুমারদের ডেকে এই মর্মে কড়া বার্তা দেওয়া হলো – কিন্তু অশ্বিনীকুমারদ্বয়, আজকালকার ডাক্তাররা যেমন বিভিন্ন চাপের মুখে ভিজে বেড়াল টাইপের আচরণ করেন, সেই টাইপের নন – তাঁরা রাজি হলেন না। তখন দেবতাসমাজ থেকে অশ্বিনীকুমারদের শাস্তি দেওয়া হলো – জানানো হলেন, দেবতাদের প্রাপ্য যে যজ্ঞভাগ, এর পর থেকে অশ্বিনীকুমাররা তা আর পাবেন না।
কিন্তু অশ্বিনীকুমারদ্বয় টেঁটিয়া পাব্লিক। যজ্ঞভাগ থেকে বঞ্চিত হবেন শুনেও তাঁরা ঘাবড়ালেন না। উলটে রীতিমতো ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে জানালেন – বেশ, ভালো কথা, এর পর থেকে আমরা শুধু মানুষেরই চিকিৎসা করব, দেবদেবীরা যেন অন্য ব্যবস্থা বেছে নেন।
আহ্, এই গল্প থেকে যদি ডাক্তারবাবুরা একটু শিক্ষা নিতে পারতেন! রাজনৈতিক দাদাদিদি দেখলেই ল্যাজ নাড়া বন্ধ রেখে – ক্ষমতাবান ব্যক্তি দেখলেই যদি জিভ দিয়ে লালা ঝরা থামিয়ে – একটু নিজেদের অপরিহার্যতার উপর আস্থা রাখতে পারতেন!! বা এটুকু বলতে পারতেন, “খাঁটি ভারতীয় ঐতিহ্যশালী চিকিৎসাব্যবস্থা”-য় যাঁদের এত ভরসা, তাঁদের জন্য বাধ্যতামূলক হোক তদনুসারী বন্দোবস্ত। মানে, গ্রামেগঞ্জের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আয়ুশ ডাক্তার বসানোর পরিবর্তে প্রতিটি রাজ্যের রাজধানীতে পাঁচতারা হাসপাতাল তৈরি হোক, যেখানে এক এবং একমাত্র আয়ুশ চিকিৎসকরাই থাকুন। এবং নেতা-মন্ত্রী-এমএলএ-এমপি-দের চিকিৎসা একমাত্র সেখানেই হবে, এমন আইন করা হোক – আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত প্রতি চিকিৎসক যদি সাহস করে এই দাবিটুকু তুলতে পারতেন!
যাক গে, এসব দুরাশা অর্থহীন! অশ্বিনীকুমারদের গল্পে ফিরি। তাঁদের এমন সিদ্ধান্তে স্বর্গরাজ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ল। অগ্নি-র খিদে কমে গেছে – অগ্নিমান্দ্য যারে কয় – কিছুই খেতে চাইছেন না। এদিকে তিনি যজ্ঞের ফল গ্রহণ না করলে বাকি দেবতারা খেতে পারেন না, সিস্টেম এরকম। কিন্তু অশ্বিনীকুমাররা মর্ত্যলোকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেছেন, অগ্নি-র উপায় কোথায় তাঁদের দেখানোর! তো শেষমেশ দুঃখপ্রকাশ-টকাশ করে অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে স্বর্গে ফেরত আনা হলো।
স্বাভাবিকভাবেই, যে দেবতা মর্ত্যলোকের চিকিৎসা করার জন্য দেবলোককেও তুচ্ছ জ্ঞান করেন – অর্থাৎ ক্ষমতার কেন্দ্রটিকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেন – তাঁকে মডেল দেবতা হিসেবে তুলে ধরা বিপজ্জনক।
সুতরাং ধন্বন্তরি। যিনি কিনা পৌরাণিক চরিত্র। অনুমান করা হয়, প্রাচীন ভারতে ধন্বন্তরি নামে একাধিক চিকিৎসক ছিলেন। যেমন কাশীর ধন্বন্তরি দিবোদাস। আসলে, যেমন করে গ্রিসের অনেক চিকিৎসকই নিজেদের এসক্লেপিয়াস-এর বংশোদ্ভূত বলে দাবি করতেন, এখানেও তেমন করেই ধন্বন্তরি-র নামগ্রহণ হতো। অবশ্য গত কয়েক বছর ধরেই কারণে-অকারণে ধন্বন্তরি নামটি ভাসানো হচ্ছে – চিকিৎসার অনুষঙ্গহীন ধনতেরাস পরব-কেও ধন্বন্তরির জন্মদিন পালন হিসেবে ভাবানো চলছে। হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়ে প্রামাণ্য গবেষণা করেছে এবং করে চলেছে। গত দুহাজার বছরে আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা ধন্বন্তরি-র ছবি সাজিয়ে ধূপধুনো দিতেন, এমন জানা না থাকলেও বেশ রবি বর্মা প্রেসের দেবদেবী মূর্তির স্টাইলে ধন্বন্তরির একখানা দেবতারূপ-ও বাজারে ছাড়া হয়েছে। এসবে কেউই খুব একটা বিচলিত হচ্ছিলেন, এমন খবর নেই।
এবারে সেই দেবতা-রূপ দেশের স্বাস্থ্য-চিকিৎসার নিয়ামক সংস্থার লোগো-য় উঠে এলো। আপাতত এই বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো। বৃত্তের ব্যাস বাড়িয়ে ফেলা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত পাব্লিকের নিস্পৃহতা – আমজনতার কথা তো ছেড়েই দিচ্ছি – সেসব দেখে মনে হয়, বৃত্তটি সমাজের সব পরিসর গ্রাস করে নেওয়া অবধি কারোরই ঘুম ভাঙবে না। তা না ভাঙুক, তাতে কিছু বলার নেই – এই শীতঘুম দেখে আর বিস্মিত হই না – শুধু ঘুম ভেঙে উঠে খুব অবাক হওয়ার অভিনয় করলে সেসব দেখে বড্ড বিরক্ত লাগে।
সুন্দর লেখা। তবে শীত ঘুমের সুবিধে আছে – নিরাপদ।