হাসপাতাল ও চিকিৎসা জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে, তার যুদ্ধ ও সংঘাতের আওতার বাইরে থাকার কথা। সে সব কথা মানবধর্ম এখন বিস্মৃত। সাম্প্রতিক গাজা তার প্রমাণ।
সদ্য একটি কার্টুনে দেখলাম এক প্যালেস্তাইনি শিশুর মুখে দুধের বোতলের বদলে পুরে দেওয়া আছে মিসাইল। কার্টুন শিল্পী উদয় দেব এই ছবিটার মধ্যে দিয়ে যা বলেছেন, তা লিখে বলে প্রকাশ করতে পারব কি না, জানি না।
তবে আমি সারা দিন সদ্যোজাত শিশুদের সঙ্গে থাকি, ওদের চিকিৎসা করি, ছাত্রদের বলি, ওরা সদ্য পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, ওদের অস্তিত্ব রক্ষাই আমাদের কাজ। এ সবের পর যখন শুনি আল-আহলি হাসপাতালে বোমা পড়েছে, গাজা শরের শতাব্দী-প্রাচীন হাসপাতালের মুমূর্ষুরাও রেহাই পেল না, তখন ঐ শহর থেকে ৫৪৮৪ কিলোমিটার দূরে বসে, বিষণ্ন, বাকরুদ্ধ বোধ করি। কারণ, আমি একজন চিকিৎসক, মানুষকে ভালোবাসাই আমার ধর্ম। আমি নিজেকে এবং সমগ্র মানবতার কাছে প্রশ্ন করতে চাই যে যারা হামাস ও ইজরায়েল-এর মধ্যে পরিকল্পিত যুদ্ধে আটকে পড়েছে, আহত হচ্ছে বা মৃত্যুর খুব সন্নিকটে পৌছে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের কী দোষ ছিল?
১৮৮২ সালে এঙ্গলিকান ডায়োসেস অফ জেরুজালেম ওই হাসপাতালটা তৈরি করেছিল। আর ১৬ অক্টোবর ইজরায়েল গাজা স্ট্রিপের ২০ টা হাসপাতালকে খালি করার হুকুম দিয়ে দিল। কেউ ভাবল না, হাসপাতাল স্থানান্তর কোনও সহজ বিষয় নয়। কেউ ভাবল না , যে সব সদ্যোজাতরা ইনকিউবেটরে আছে তাদের সরানো বা ভেন্টিলেটরে থাকা রোগীদের সরানো মুখের কথা নয়। তার উপরে, গাজা স্ট্রিপ-এর বর্তমান অবস্থায় মাত্র চার দিন সময় দিয়ে হাসপাতাল সরানোর কথা বলা কি যায়?
এ নিয়ে কেউ কোনও কথা বলছে না। দেখলাম ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ, মানে ইংলন্ডের প্রধান চার্চের মুখ্য বিশপ, এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, ‘হামাস যে ইজরায়েলিদের ওপরে আক্রমণ করেছিল তা বর্বরতার প্রকাশ, সন্দেহ নেই। কিন্তু, গাজার নাগরিকরা হামাসের কাজের জন্য দায়ী হতে পারে না। আপনারা ওই নিষ্পাপ মানুষগুলোর জন্য প্রার্থনা করুন, যারা পবিত্রভূমিতে বাস করার কারণে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন যুদ্ধে ভয়াবহ হিংসার শিকার হয়ে চলেছে।
আর্চবিশপের এই মন্তব্য শোনার পরে আর স্থির থাকতে পারিনি। আমি ভাবলাম একজন ডাক্তার হিসেবে আমার বা একজন সেবাদায়িনী নার্সের মূল ধর্ম কী? আমাদের সাদা পোশাক শান্তি ও নিরপেক্ষতার প্রতীক। কিন্তু আমরাও সেই বৃহত্তর দাবার ছকের বোড়েতে পরিণত হচ্ছি। এন্টি-সেমিটিজম, ইসলামফোবিয়া—এ সব নিয়ে বেঁচে আছি। এর বাইরে বেরিয়ে কথা বলতে পারছি না।
কিন্তু ভাবুন বিশ শতকে আমরা যখন টেকনোলজিকাল এডভান্সমেন্টের কথা বলছিলাম তখন একুশ শতকের চেহারাটা আমাদের কাছে কেমন ছিল? সময়টা আরও অনেক বেশি মানবিক হবে। অন্তত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবতার প্রতি ভয়ানক হিংসামূলক কিছু করব না। ডাক্তারি পড়ার শুরুর দিকে মানুষের ব্যথা নিয়ে কথা হত। তখন দেখতাম মেডিক্যাল সায়েন্স একটা সর্বজনীন দিক আছে, সেটা হল রোগ, কষ্ট এবং মৃত্যু, এই বিষয়গুলো মানুষের জাত-ধর্ম-বর্ণের উপরে নির্ভর করে না। তাই ডাক্তারও রোগীর চিকিৎসা করার সময় জাতি-ধর্ম-বর্ণ দেখবে না।
ফোবর্স-এর দেওয়া তথ্য বলছে, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী দুই দশক ধরে ইউএসএ ২ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়ে। ৩০০ মিলিয়ন ডলার প্রতি দিন খরচ হয়েছে আফগানিস্তানে। এই যুদ্ধটা করার খরচ ইউএসএ কোথা থেকে দিয়েছে? খুব পরিষ্কার উত্তর, নিজের দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা থেকে। শেষমেষ আফগানিস্তানের কোনও উন্নতি করতে পারেনি। দেশটাকে যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত করে, তালিবানের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে চম্পট দিয়েছে। অথচ, কোভিডের সময় সে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল কী, তা ধরা পড়েছে। হাজার হাজার লোক ওখানে কোভিডে মারা গেল, সেটাও সকলে জানে। কিন্তু ভাবুন ইউএসএ-র সাধারণ মানুষের কথা। যাদের ট্যাক্সের টাকায় ইউএসএ যুদ্ধ চালিয়ে গেল আফগানিস্তানে, সেই যুদ্ধ চালাতে গিয়ে নিজের দেশের লোককে কোভিডের সময় সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা সে ভাবে দিতে পারল না, তারা তো সরকারকে বলেনি, যে তালিবানদের খুব করে শায়েস্তা করুন, তাতে আমাদের যা ক্ষতি হয় হোক।
আরো একটা কথা মনে হয়। ইউরোপে যে ভাবে ইহুদিদের উপরে অত্যাচার চলেছে, তার কোনও তুলনা হয় না। জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার-তান্ত্রিক রাশিয়া, সর্বত্র ইহুদিরা কোণঠাসা হয়েছে, জাতি-ধর্মভিত্তিক হিংসার শিকার হয়েছে। খ্রিস্টান সমাজ লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছে। এখন ইহুদিরা লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করছে। অথচ, এই তিনটি ধর্মেরই জন্ম বাইবেল-এর ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে। এদের ধর্মের মুলটি একটি সুতোয় বাককধা। এবং এই তিনটি ধর্মের মধ্যের মারামারি আজকের নতুন নয়। ক্রুসেডের ইতিহাস আমরা জানি। ইহুদি জাতির জায়নিজম উত্থানের আগে থেকে ইহুদিদের নিয়ে ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার মুসলমান সমাজে এক ধরনের ইহুদি-বিরোধী প্রচার এবং ধারণা চালু ছিল। উনিশ শতকে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান, বিসমার্কের জার্মানি, প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়াকে এক ছাতার তলায় এনে জার্মানদের একত্র যে প্রয়াস চলেছিল, সেই সময় নাগাদ জায়নিজমও জন্ম নেয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, জায়নিজম উদ্ভবের সময় ইহুদি সমাজের বেশির ভাগ লোক এই মতবাদ সমর্থন করেনি। অটোমান রাজত্বের সময় ইহুদিরা একটূ পরিসর পেয়েছিল নিজেদের মতো করে বেড়ে ওঠার। সে সময় তারা প্যালেস্টাইনে প্যালেস্টিনিয়ানদের সঙ্গে বাস করতে পেরেছিল প্রায় কোন বিবাদ ছাড়াই। এটা উনিশ শতকের শেষ, বিশ শতকের গোড়ার এক-দেড় দশক।
তার পরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণধ্বনি বেজে উঠল। অটোমান শাসক ইংলন্ডের কাছে হেরে প্যালেস্টাইন থেকে সরে আসতে বাধ্য হল। ১৯১৭ সালে ব্যালফোর ঘোষণাপত্রে ব্রিটেন-এর বিদেশ সচিব আর্থার জেমস ব্যালফোর ইংল্যান্ডের অধিকৃত প্যালেস্টাইনকে ইউরোপিয় ইহুদিদের আবাসস্থল হিসেবে স্বীকৃতি দিল। কিন্তু ইহুদি নয় এমন লোকেদের থাকার অধিকার যে প্যালেস্টাইনে আছে, সে কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হল না।
সোভিয়েত রাশিয়াতে বসবাসকারী ইহুদিদের মধ্যে দুটি ভাগ ছিল। এক দল বলশেভিকদের সমর্থন করেছিল। অন্যরা করেনি। এদের মধ্যে যারা বলশেভিকদের সমর্থন করেছিল তারা জায়নিজমকে সমর্থন করেনি। উগ্র জাতীয়তাবাদ, রক্তক্ষয়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, তার পর যুদ্ধ শেষ হাজার হাজার যুদ্ধফেরত যুবকের দুর্দিশাগ্রস্ত জীবন এবং মানুষের সার্বিক দুর্দশা গান্ধীকে তীব্র ভাবে আন্দোলিত করেছিল। তারই মধ্যে ইহুদি-প্যালেস্টাইন সমস্যা অব্যাহত ছিল। এবং গান্ধী এই সমস্যা দেখে স্পষ্ট বলেছিলেন, যে প্যালেস্টাইন আরবদের মাতৃভূমি। ঠিক যেমন ইংলন্ড ব্রিটিশদের, ফ্রান্স ফরাসিদের, তেমনই। সহানুভূতি জানিয়েছিলেন ইহুদিদের প্রতি। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল ইহুদিরাও আসলে বিতাড়িত। তিনি স্বীকার করেছিলেন যে প্যালেস্টাইনের আরবদের গোলাবারুদ দিয়ে তাড়িয়ে ইহুদিরা একই ভুল করবে, যা ওদের সঙ্গে খ্রিস্টান দুনিয়া করেছে। প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের বাস করতে হলে অহিংস পথে আরবদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়তে হবে। মানুষ মেরে কিছু লাভ হবে না। সুতরাং, প্যালেস্টাইন দখলের লড়াই বহু দশক ধরে চলছে। আমার দুঃখ, প্রযুক্তির এই বাড়বাড়ন্তের সময়েও তাকে থামানো গেল না।
জানতে পারলাম বছর চারেক আগে এই গাজাতে রাজান-আল-নাজ্জার নামে এক তরুণী চিকিৎসক সেনার গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন। গাজার প্রতিবাদীরা গাজা-ইজরায়েল সীমান্তে প্রতিবাদ করতে গিয়ে পাল্টা আক্রমণে বিপন্ন হতে পারে, এই পরিণতি আঁচ করতে পেরে তরুণ চিকিৎসকের দল প্রতিবাদীদের পেছনে এম্বুলেন্স নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা যাতে বাদ না পড়ে। কিন্তু এক প্রতিবাদী গাজা-ইজরায়েলের সীমান্তরেখার এত কাছে চলে যান, যে তাঁকে বাঁচাতে চিকিৎসকের দল এগিয়ে যান। বার বার হাত নেড়ে শান্তি প্রস্তাব প্রদর্শন করে প্রতিবাদীকে সরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন চিকিৎসকের দল। শেষ পর্যন্ত গুলি খেয়ে ঐ তরুণী চিকিৎসক মারা যান।
আজ হাসপাতালে দেখা যাচ্ছে, রোগীকে সেবা দেওয়া নিয়ে যত লোক কথা বলে, তার চেয়ে বেশি লোক ধর্মীয় আচরণ নিয়ে বিচলিত। নর্ম্যান বেথুন, দ্বারকানাথ শান্তারাম কোটনিসের আদর্শ আর কেউ চায় না। তার পরেও আশা রাখি বিশ্বে চিকিৎসার নতুন ইতিহাস রচনা বাকি। যেখানে অর্থ, ধর্ম, জাতি নয়, মানুষের জয়গান হবে। প্যালেস্টাইনে মৃত শিশুদের হয়ে বলতে চাই, ‘শুনেছি তোমার শহরঝাঁ চকচকে রঙ্গিন/ তোমরা সকল শিক্ষিত ও অভিজাত/ আমার শহরে আছে অন্ধকার, আছে হাহাকার/ আজ চার দিকে মেশিনগান গর্জে উঠেছে/ তুমি আমাকে যে কোনও নামে ডাকো/ আমি অস্বীকার করি না/ আজ শুধু বিদায় নেব—দ্যাখো সারা আকাশ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে।’