জোহানেস ফিবিগার। ১৯২৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন, কেননা তিনি গবেষণার মাধ্যমে ইঁদুরের শরীরে একধরনের কৃমির উপস্থিতিকে ক্যানসারের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। কৃমি-জাতীয় পরজীবি যে ক্যানসারের মতো মারণরোগ ঘটাতে পারে, নোবেল কমিটি এমন পর্যবেক্ষণকে যুগান্তকারী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
খুব বেশিদিন বাদে নয়, বেশ তাড়াতাড়িই প্রমাণ হয়েছিল, ফিবিগার-এর গবেষণালব্ধ পর্যবেক্ষণ ছিল ভুল। অতএব, নোবেল পুরস্কারটি, অন্তত সে দফা, অপাত্রে দান হয়েছিল।
ফিবিগার-এর সময়ই জাপানি এক গবেষক, ইয়ামাগিউয়া কাতসুসোবুরো, তিনিও খুঁজছিলেন ক্যানসারের কারণ। শেষমেশ তিনি কোল টার-কে চিহ্নিত করেছিলেন ক্যানসারের অন্যতম কারণ হিসেবে। ফিবিগার-এর সঙ্গে একই সময়ই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর গবেষণাপত্রও। কিন্তু নোবেল কমিটির মনে ধরেনি। কাতসুসোবুরো নোবেল পুরস্কার পাননি। যদিও পরবর্তী সময় সাক্ষী, তিনি ছিলেন অভ্রান্ত।
আন্তনিও ইগাস মনিজ। পর্তুগীজ মনোরোগবিশেষজ্ঞ। সিটি স্ক্যান এমআরআই আবিষ্কারের ঢের আগেই তিনি মস্তিষ্কের রক্তনালীতে ইঞ্জেকশন দিয়ে মস্তিষ্কের ছবি দেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই পথ ধরেই আসে ক্যারোটিড অ্যাঞ্জিওগ্রাম। দু’বার মনোনয়ন পেলেও, এই আবিষ্কারকে নোবেল কমিটি পুরস্কারের যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করেনি। ইগাস মনিজ অবশ্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ফ্রন্টাল লোবোটমি নামক অপারেশন-এর আবিষ্কর্তা হিসেবে। তাঁর আগে দুই বিজ্ঞানী দেখেছিলেন, শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব বাদ দিলে শিম্পাঞ্জিরা ভারি বাধ্য হয়ে ওঠে। সুতরাং, ইগাস মনিজ-ও মানলেন, মনোরোগীদেরও ফ্রন্টাল লোব বাদ দেওয়া গেলে তাঁরা দিব্যি ‘স্বাভাবিক মানুষ’-এর মতো আচরণ করবেন। শুরুর দিকে এমন অপারেশনে মৃত্যু-টিত্যু ঘটলেও শিগগিরই এমন অপারেশনে সাফল্য এলো। নোবেল কমিটি, ১৯৪৯ সালে, ঘোষণা করলেন, মনোরোগের ইতিহাসে এ যাবৎ যা যা চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়েছে, ফ্রন্টাল লোবোটমি-ই তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। নোবেল এলো আন্তনিও ইগাস মনিজ-এর ঘরে।
বছরকয়েকের মধ্যেই দেখা গেল, ফ্রন্টাল লোবোটমি-তে রোগীর প্রাণের ঝুঁকি আছে তো বটেই, যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরাও ভালো নেই। তাঁদের ব্যক্তিত্বে বিভিন্নরকম পরিবর্তন ঘটছে। যা অস্বাভাবিক এবং গোলমেলে।
আস্তে আস্তে নোবেল কমিটি সাবধানী হতে থাকলেন। প্রত্যক্ষ গবেষণালব্ধ প্রমাণ এবং সময়ের সঙ্গে পাকা তথ্য ছাড়া নোবেল পুরস্কার দিতে সাহস পেলেন না। ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘে ভয় অস্বাভাবিক নয়। বেশ কিছু বড় আবিষ্কার পুরস্কারের বাইরে রয়ে গেল, কেননা প্রত্যক্ষ প্রমাণ ও ম্যাচিওর ডেটা আসার আগেই বিজ্ঞানী পরপারে চলে গেছেন (আর নোবেল পুরস্কার মরণোত্তর দেওয়া হয় না)। তবু, তাড়াহুড়ো করে হাত পোড়ানোর চাইতে, এই ব্যবস্থা ভালো বই খারাপ নয়, তাই না?
এ বছরে অবশ্য নোবেল কমিটি বেশ চটজলদি সিদ্ধান্ত নিলেন। কোভিড-ভ্যাক্সিন – এমআরএনএ ভ্যাক্সিন – সেই আবিষ্কারের জন্য এ বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো। এমআরএনএ ভ্যাক্সিন যে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অতি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। যেহেতু ভাইরাস রোগীর শরীরে ঢুকে রোগীর শরীরের মালমশলা ব্যবহার করে নিজের নিউক্লিক অ্যাসিড (জেনেটিক উপাদান)-এর পরিমাণ বাড়াতে থাকে – যাকে বংশবৃদ্ধিও বলা যায় – সেই উৎপাদনের বার্তাটি বহন করে এমআরএনএ – সেহেতু এমআরএনএ টিকা পদ্ধতির মাধ্যমে অনেক রোগের টিকা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কাজেই, আবিষ্কারটি যুগান্তকারী অবশ্যই।
আবার, এই টিকা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। অনেক প্রশ্নই অবান্তর যদিও, তবু কিছু সংশয় উড়িয়ে দেওয়ার মতো হয়ত নয়। আমি অ্যান্টিভ্যাক্সার গোত্রে নই, টিকা নিজেও নিয়েছি, বাড়ির লোককেও দিইয়েছি (যদিও সে টিকা এমআরএনএ টিকা নয়)। তবু, কোভিড-এমআরএনএ ভ্যাক্সিনের জন্য এত তাড়াতাড়ি নোবেল পুরস্কার একটু অবাকই করল।