শুনেছি ছেলেটা বা বলা ভালো লোকটা খুব ঝঞ্ঝাটিয়া। সর্বত্র কিচাইন করে বেড়ায়। এক ডাক্তার, তার বাড়ির পাশে জমি কিনে বাড়ি বানাচ্ছিল। সে বেচারি ঐ পাবলিকের ঘন ঘন হস্তক্ষেপে নাজেহাল। ড্রেন পাইপ, রেন পাইপ, স্যানিটেশন, সবেতেই নাকি সে খুব জ্বালিয়েছে। এগুলো সবই আমার শোনা কথা। আমি যদিও ছাত্রজীবন থেকেই ওকে চিনি। আমি ইলেভেন, ও সিক্স, সম্ভবতঃ।
একদিন হঠাৎই ও ক্লিনিকে এসে হাজির। সঙ্গে বৌ। তার অবস্থা সিরিয়াস। গলায় টান টান দড়ির ফাঁসটা টাইট হয়ে বসে গেছে। সিলিং ফ্যানে ঝুলে গেছলো। চটপট ঝোলানো দড়িটা কেটেই ঐ অবস্থায় ধরাধরি করে নিয়ে চলে এসেছে। দেখেতো আমার চোখ পুরো কপালে উঠে গেছে।
মেয়েটা তখনো বেঁচে আছে। শরীর পুরো নীল, আমরা যাকে Cyanosis বলি, তার মানে কার্বন ডাই অক্সাইড পয়জনিং শুরু হয়ে গেছে।
সাততাড়াতাড়ি লিগ্যাল অ্যাসপেক্ট ব্যাপারটা ভুলেই গেলাম। গলার দড়িটা কেটে মেয়েটার সাপোর্টেড পজিটিভ প্রেসার রেসপিরেশন এস্টাব্লিশ করে অক্সিজেন ওভারফ্লো করলাম। হাপর নামে একটা পুরোনো যুগের রেসপিরেটরি অ্যাপারেটাস ছিল আমার কাছে। এইসব ক্ষেত্রে রক্তে কার্বন ডাই অক্সাইড বেশি হওয়ার কারনে, রক্তে অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গিয়ে মালটিপল অর্গান কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়। ব্রেন ফাংশনিং স্টপ হয়ে যায়। সোডি বাই কার্ব, আইভি দিয়ে স্যালাইন চালিয়ে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দেওয়ার পরে, মেয়েটা বেঁচে যায়, তার চোখের রিফ্লেক্স ফিরে আসে, নর্মাল রেসপিরেশন রেস্টোর হয়ে যায়। (প্রসঙ্গতঃ, সার্জেন হওয়ার আগে, কোলকাতায় টিকে থাকার জন্য এবং পেটের দায়ে আমি কিছুদিন আমাদের কলেজ হাসপাতালে অ্যানেস্থেসিয়া ডিপার্টমেন্টেও বেশ সুনামের সঙ্গে কাজ করেছিলাম। প্রফেসর নারায়ণ বোসের অধীনে। তাই ক্রিটিক্যাল কেয়ার একটু আধটু জানতাম।)
এর পরে আমার মনে পড়ে, আরে যাঃ, এই ছেলেটাতে হেব্বি বদ বলে শুনেছি। কাজেই লিগ্যাল ঝামেলায় পড়ে কাজ নেই।
ইসকো জলদিসে সরকারী হসপিটাল ভেজো। অ্যাম্বুল্যান্স বুলাও।
যা ভাবা তাই করলাম, উইথ ফোর্স (জোরাজুরি)। উলুবেড়িয়ার হাসপাতালে সে ভর্তি হল।
আমার কপালে উঠে যাওয়া চোখ তখনো যথাস্থানে নামেনি। নামলো, তার এক-দু-দিন পরে।
মেয়েটা বেঁচে ঘরে ফিরলো। আমার অপরিচিত সরকারী ডাক্তাররা শুনেছি আমার প্রশংসা করে বলেছে, উনিই যা করার আসল কাজটা করে দিয়েছেন, তাই মেয়েটা বেঁচে গেল! একটা নতুন ডাক্তারের পক্ষে এগুলো ভালো মাইলেজ, আজকালকার ভাষায়, ভালো ফুটেজ।
তবে, ঐ অকৃতজ্ঞ লোকটা আমার সঙ্গে দেখা করেনি। একটা সেকেলে ছ্যাঁদা পয়সাও ঠেকায়নি।
বেশ কিছুদিন, তা প্রায় বছরখানেক হবে, একদিন বাইক চালিয়ে আসছি, সামনে দেখি সে। রাস্তার ধার ঘেঁষে আসছে।
আমিও, তার সোজাসুজি রাস্তার ধার ঘেঁষে গেলাম। সে আরো সরে গিয়ে একদম সাইডে, আমিও ততটাই সাইডে এসে গেছি। এবার ধাক্কাটা লেগেই যাবে। সে, পাশের পাঁচিলে ঘেঁষে গেছে। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। আমি ওর শরীরের কাছে বাইকের চাকাটা থামালাম।
আশেপাশের লোকজন যারা দেখছিল, বুঝে উঠতে পারেনি আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি নাকি ইচ্ছাকৃত কিছু ঘটাচ্ছি। তারা বুঝে ওঠার আগেই আমি ঘোষণা করলাম, এই লোকটার বৌ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছিল। সেই অবস্থায় আমার কাছে আসে। আমি প্রাইমারি ট্রিটমেন্ট দিয়েছিলাম বলে বেঁচে গেছে। নাহলে ফোরনাইন্টিএইটে জেলের ঘানি টানতো। অথচ এই মাল আমাকে একটা পয়সাও দেয়নি। একবছরে সময়ও পায়নি দেখা করার।
রাস্তার লোকজনই ওর পকেট হালটে টাকা পয়সা বার করে ফেলে।
অনেকদিন আগের ব্যাপার স্যাপার। তখন, আমিওতো ইয়ং।
___________