রাজেশ আমাদের আউটডোরে নাম লেখে। লাইন যখন বারান্দা টপকে লম্বা লম্বা পাম গাছের শেষ অবধি গেছে প্রায়, তখনই তিনি এলেন। বেনু রানী মিস্ত্রি।মেজাজ তার প্রায় রানীর মতই। লাঠি ঠুক ঠুকিয়ে এক্কেবারে সামনে এসে লাইন ফাইনের তোয়াক্কা না করে সরাসরি টিকিট চাইলেন তিনি।
একখান টিকিট দে তো। বেনু রানী মিস্ত্রি। বয়স একশ সাত।
তোমার বয়স কি সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়ে! গত সপ্তাহে যে বললে একশ পাঁচ।
তাই কইসি নাকি। অবিশ্বাসী চোখে চিন্তা করে বেনু বুড়ি। তারপর খানিকটা অনিচ্ছাকৃত দর কমানোর ভঙ্গিতে একহাত থেকে অন্য হাতে লাঠিটা নেয়।’ নে তাইলে একশ ছয় কইরা দে।’
বেনু বুড়ি সবাইকে তুই তুকারি করে। আমাকেও,’ ওই ডাক্তার,’ এবং তুই..। আজব্ধি তুমিও বলেনি কোনও দিন।
প্রতিদিন তার একই রুটিন। বুধবার হলেই আউটডোরে এসে ভিক্ষা করবে কিছুক্ষন: ডুদা পয়সা দিবি বাবা। টিকিট করুম। পাম কিনুম।
তারপর লাইনের এক্কেবারে সামনে এসে টিকিট করবে। আর আউটডোরে বসার সাথেসাথে ছোট্ট চেয়ারটায় বসবে জুত করে। আমি মরুম কবে ডাক্তারবাবু।আমার কি মরণ নাই!! মরণের ওষুধ দে আমারে…
হ্যাঁ। তোমাকে মেরে জেলে যাই, আরকি।
আমি কি কমু নাকি কাউরে। কাউরে কমু না। তরে আমি স্বর্গ থিকা আশীর্বাদ করুম। মরণের ওষুধ দে..
তুমি স্বর্গে যাবে একদম ঠিক জানো! আমি মজা করে বলি।
এইবার বুড়ির গলায় দলা পাকিয়ে ওঠে যন্ত্রণা। কি জানি? গোবিন্দ কি রাখসে কপালে!
তারপর এখানে ব্যথা,ওখানে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি একগাদা ফর্দ যার কোনোটাই কমেনি গত সাত বছরে একটুও সেগুলো শোনাবে বুড়ি।
অনেক সময় তাড়াহুড়া করলে বলবে: শুনোস না ক্যান। না শুইনা ওষুধ লেখস কি কইরা? কল দিয়া দেখ। ভালো ওষুধ দে…
পাশ থেকে সিনুদা বলবে, তুমি না মরার ওষুধ চাইছিলে! এখন ভালো ওষুধ চাও যে!
বুড়ি হাসবে। সে হাসিতে অদ্ভুত লাজুকতা। যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পরে যাওয়া হাসি। সেও জানে তার মরে যাওয়াই উচিত। এই বেচেঁ থাকা অন্যায়। তবু তার বড্ড লোভ। বাঞ্ছারামের বাগান সিনেমার বাঞ্ছা বুড়োর মতন বড্ড লোভ তার। আরেকটু বেঁচে থাকার লোভ। আরও কটা দিন ছোট ছোট অপাংক্তেয় বিষয়েও লড়াই করতে করতে কাটিয়ে দেবার লোভ। আগে আগে দেখিয়ে, দিদিমণিদের বলে কয়ে পেসারের গোনাগুনতি ওষুধ কয়েকটা বেশি চেয়ে নেয় সে। যদিও সে জানে ফি বুধবার সে আসবে। কিন্তু যদি না আসতে পারে। যদি কেউ না এনে দেয় পেসারের ওষুধ, শ্বাস টানের ডেরিফাইলিন! তাই সে ছোট ছোট লড়াই করতেই থাকে। আপাত হাস্যকর, আপাত ছ্যাচড়ামো মনে হওয়া সেইসব লড়াই নিতান্তই প্রয়োজন, আসলেই বেঁচে থাকা তার কাছে।
আর্দুইডা বড়ি বেশি দে দিদিমণি। পাম আসেনাই এইবার। বাড়ি যাওনের টাকা দিবি বাপ।
এমনিতে আউটডোরে কথাবার্তা বলাই মুস্কিল। ঝটপট শোনা আর ফটফট লেখা। এর বাইরের গল্প করা বিলাসিতা। তবু শীতকালে ভিড় একটু হালকা থাকে । গল্পের মুড চেপে ধরে আমার আড্ডাবাজ মনকে। ওষুধ লিখতে লিখতে খোঁচাই। একা একা আসো কেনো। বাড়ীতে কেউ নেই?
পোলা আছে। গ্যাজা খাইয়া মাথা আউলা হইয়া গ্যাছে। মনসার পাতিলে লাথি মারছিল। সেই থিকা পা দুইডা লুল্যা হইয়া গেছে । পোলার জন্য দুইডা বড়ি দিবি বাবা? হ্যাড় খুব ব্যাথা… সুযোগ পেয়েই বুড়ি শুরু করে তার সেই ছোট ছোট লড়াই। আরও একটু কুড়িয়ে নেওয়া। আরও একটু যোগাড় করে নেওয়া।
ওষুধ লিখতে লিখতে আমি বলতে থাকি: ওভাবে কি ওষুধ দেওয়া যায়! ওইসব মনসা টনসা ফালতু কথা। তুমি নিয়ে এস একদিন। দেখবো।
এইবার কার্যত রেগে যায় বুড়ি। হ। তরা সব বোঝোস। ঠাউর দেবতা মানস না। তর যে এত নাম, তাইলে আমার টান সাড়ে না ক্যান!
অকাট্য যুক্তিতে হার মানতেই হয়। ঠিকই তো। দু চারটে বড়ি আর মাঝে মধ্যে ইনহেলার ছাড়া কিই বা দিতে পারি আমরা! আর বেনু বুড়ি তো শুধু নয়, ভুবন বৈরাগীর চারশ পাঁচ সুগার, দিগম্বর মণ্ডলের পোস্ট টিবি লাং ডিসিস, মাঝে-মধ্যে রক্ত পড়ে, সন্ধ্যা রানীর রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এইসব সমুদ্রের মতন হা করা খিদে। একদিন দুইদিন মেটানো যায়। কিন্তু দিনের পরদিন, মাসের পর মাস, কে শুনবে সেইসব ঘ্যানঘ্যান দুঃখ সঙ্গীত!
কেউ শোনেও না। শোনা সম্ভব নয় বলেই। লেখা হয় একঘেঁয়ে প্রেসক্রিপশন। স্ট্যাম্প মারা পি সি এম, ফামটাক, আমলোডিপিনে টিক পরে ঘচাঘচ। একজন না উঠতেই চিৎকার করে ডাকি নেক্সট…
তবু কিছু কিছু নেক্সট আসে না কোনদিন। কিছু কিছু মানুষের অন্যরকম গল্পগুলি হুটহাট মনে পরে ব্যস্ত আউটডোরে। আরে সেই লোকটা তো আসে না আজকাল। খালি গায়ে যে বলতো দেখেন তো ডাক্তারবাবু গায়ে এত পোকা কেন, পোকা কেনো, আর একমাত্র সাপ্লাই মনোরোগের ওষুধ আমিট্রিপটিলিন নিয়ে যেত হপ্তায়। কিংবা সেই বুড়ি যে মাসে একবার দশখানা গ্যাসের বড়ি নিতে হেঁটে আসতো সাত মাইল। সেও তো আসে না কতদিন।
শিউলীবালা হালদারের পায়ের ঘা থেকে ম্যাগট বেরিয়েছিল একুশটা।
সুগার একুচেকে হাই।
এ পেসেন্ট রেফার করাই নিয়ম। কিন্তু রেফার করলেই বা যায় কজন! বাড়িতে বসে খারাপ হয় আরও। এ পেশেন্টকে ইনসুলিন দেওয়াই নিয়ম। কিন্তু প্রথমত ইনসুলিন কিনবে কি করে, আর যদিও বা কেনে, প্রতিদিন দুইবেলা দেবেটা কে।
তাই প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েই প্রেসক্রিপশন লেখা হয়। ওরাল ওষুধ। স্যাম্পেল লিনেজোলিড, ক্লিন্ডামাইসিন। অদ্ভুত ভাবে খুব দ্রুত সেরে ওঠে শিউলীবালা হালদার। খুঁড়িয়ে আসা পদক্ষেপে বাড়ীতে গাই বিয়নোর গল্প শোনায়। গুড়ের নাড়ু আনার প্রতিশ্রুতি দেয় রানুদিকে।
তারপর একদিন হুট করে আর আসে না। আসে না তো আসেই না। প্রথম প্রথম মনে পড়লেও মাথার ভেতরটা নতুন স্মৃতির ভিড়ে ভুলে যায় শিউলীবালা হালদার, কিংবা ভুবন মণ্ডলের ‘বিড়ি খাইলে কাশিডা উইঠ্যা যায় বাবু ‘…
চেয়ে রাখা ডাপাগ্লিফ্লোজিন পরে থাকে কয়েক সপ্তাহ। কেউ আসে। কেউ আসে না।
শুধু কোনও অলস ইমার্জেন্সীতে তাদের গল্প ওঠে অকস্মাৎ। আবার ভুলেও যায় সব্বাই।
দু হাজার বাইশ যায় । তেইশ আসে। কোনও কোনও শিউলিরা ঝড়ে যায় ।খুব ঘন কুয়াশায়…
বেনু বুড়িদের বয়স বাড়ে,কমে। লাঠি ঠুক ঠুকিয়ে আউটডোরের চেয়ারে বসতে বলে : মরণের ওষুধ দিবি বাবা। মরণের.. বলতেই থাকে।