লগ্ন গোধূলি। আকাশ জুড়ে ঘন মেঘের দল ঝুঁকে পড়ে একদৃষ্টে আমাদের বুড়ো হাতুড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। লম্বা লম্বা সব গাছেরা মেঘের রংয়ে রং মিলিয়ে মাথা তুলে মেঘেদের সাথে কোলাকুলি করছে। আর হাতুড়ে মন দিয়ে একটা কেঁচোকে দেখছেন। সেটা ওনার আজ কাল পরশু (এর ফুল তিনদিনে তিনটে রংয়ে বদলে যায় তারপর ঝরে পড়ে) গাছটার মাটি খুঁড়ে শিকড়ে বাতাস আর পুষ্টির ব্যবস্থা করছে।
ছোটবেলায় এই কেঁচো দিয়েই ওনার প্রথম মাছ ধরা। কৈ খলসে– সরপুঁটি– ঝিলের পাড়ে বসে বসে। বঁড়শিতে কেঁচো গেঁথে প্রতীক্ষার প্রহর। এদিকে ঘন মেঘে আঁধার হয়ে এলো। রবিদাদা কবে কোন কালে বলেছিলো “আঁধার এলো বলে তাইতো ঘরে উঠল আলো জ্বলে”, আজও রাত্রি আসার আগেই অন্ধকার হাজির তাই দূর দূর বাড়ির জানালায় আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। এমন সময় বাগানের জং পড়া গেটে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে এক দম্পতি ঢুকলেন। বছর পঞ্চাশেক বয়স।
ভদ্রলোক ঋজু। মহিলাও ঐ বয়সী- বেঁকে বেঁকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে লিংপিং লিংপিং হাঁটছেন। মহিলা হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন “হাতুড়েবাবু গো বাতে বড়ো কষ্ট পাচ্ছি…”
হাতুড়ে কিঞ্চিৎ আনমনে সুদূর অতীত থেকে ব্যথাতুর মহিলার দিকে ফিরলেন। “আমবাত?”
ভদ্রলোক দুহাত নেড়ে বললেন “না না হাতুড়েবাবু … আমবাত তো অ্যালার্জি হয় … এটা আসল বাত”
হাতুড়ে সন্ধ্যায় অদ্ভুত গোলাপি কালো আকাশের দিকে তাকিয়েই বললেন “তো বাৎ পুরা কর্ দিজিয়ে।”
মহিলা সন্ধ্যাকাশের বক্ষভেদী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “হাঁটুতে অস্টিওআর্থ্রাইটিস… অনেক ওষুধ ক্যালসিয়াম ভিটামিন ডি সব খেয়েছি…. একটুও কমে নি।”
হাতুড়ে আকাশ থেকে চোখ না সরিয়ে উদাসী উত্তর দ্যান “তো অর্থোপেডিক সার্জন দ্যাখান। আমি কী করবো? আমি হাতুড়ে কিন্তু হাঁটুড়ে তো নৈ।”
ভদ্রলোক শ্যাওলা পড়া বারান্দায় বসে’ রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন “অনেক দেখিয়েছি .. অনেক পরীক্ষা … এক্স রে , কিচ্ছু কমে নি ….”
ভদ্রমহিলা পাটভাঙা তাঁতের শাড়িতে নাক মোছেন। অবসর নেওয়া হাতুড়ে একটু উৎসাহ পান। ওনার এ্যাক জ্যাঠমশাই সদৃশ বোনের কথায় আজকাল মদ্যপান করছেন না। ফলতঃ উদ্যমহীন দিন কাটে। মনে হচ্ছে এই কেসটায় একটু উত্তেজনার রসদ আছে । উনি নিজেই খাবলা মেরে এক্স-রে প্লেটটা নিয়ে সৌদামিনীর আলোয় দ্যাখেন হাঁটুতে সেরকম কিছু অস্টিওআর্থ্রাইটিস নেই। মজাদারু ব্যাপার তো? অথচ ভদ্রমহিলা রীতিমতো চলচ্ছক্তিহীন জবুথবু।
সামনে বিজলী তারে একটা কালপ্যাঁচা বিশ্রী সুরে সন্ধ্যাবন্দনা আরম্ভ করলো। হাতুড়ে ভদ্রমহিলার হাত ধরে ওনাকে বারান্দায় বসালেন “তারপর? বলুন আপনার কি কি অসুবিধে হচ্ছে …”
এক ঝলক বাতাস এসে ওনার ঘেমো টাকে ঠান্ডা পরশ দিয়ে গেল। ভদ্রমহিলা ঘ্যানঘেনিয়ে বলতে থাকেন “হাঁটুতে বড্ড ব্যথা। হাঁটতে চলতে পারি না” বলতেই থাকেন।
ওনার একঘেয়ে কথা শুনে হাতুড়ের ওনাকে হাতুড়ির একঘায়ে চিৎপাৎ করে দিতে ইচ্ছে হয়। তবু ভেজা হাওয়ার মতো ঠান্ডা গলায় উনি বলেন “আদ্যোপ্রান্ত ভেবে চিন্তে, গুছিয়ে নিয়ে, কতদিন ধরে – কোথায় কোথায় ব্যথা সব গুছিয়ে গাছিয়ে বলুন দিকি”।
ভদ্রমহিলা ঘন ঘন চোখে আঁচল ঘসতে ঘসতে বলে চলেন “তা প্রায় দু তিন বছর হবে। দুবার হাঁটু থেকে জল বার করতে হয়েছে এখন হাঁটু মুড়তেও পারি না – হাঁটতেও পারি না”
“কখন ব্যথাটা সব থেকে বেশী হয়?”
“সব সময়েই ব্যথা গো হাতুড়েবাবু (ফোঁপানি) হাঁটতে পারি না।”
এই সময় আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গুড়গুড় করে ‘এ আর রহমান’এর ড্রাম বেজে ওঠে। ভদ্রলোক হাল ধরেন “না হাতুড়েবাবু, ও ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছে না। ওর সব থেকে বেশী ব্যথা হয় সকাল বেলায়। হাতের আঙ্গুল মুঠো করতে পারে না। আমি বসে বসে গরম সেঁক দিই …. প্রায়ই ব্যথার ওষুধ…”
উত্তেজনায় হাতুড়ের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে “সকালে ব্যথা হয় … দুহাতের আঙ্গুলেই?” উনি জানালার পাশে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরান।
ভদ্রমহিলা বলেন “হ্যাঁ। কিন্তু হাঁটু…”
“হ্যাং ইয়োর হাঁটু” এক বুক ধোঁয়া টানেন বুড়ো হাতুড়ে। ওনার বুকের ধোঁয়া উড়ে উড়ে মেঘের সন্ধ্যারাগে মিশে যায়। জ্বলজ্বলে চোখে বলেন “আঙ্গুলগুলো সোজা করে ধরুন– হাতের পাতা নিচের দিকে করে…”
ভদ্রমহিলা হাত বাড়িয়ে ধরে থাকেন। হাতুড়ে ওনার কুসুম কোমল আঙ্গুলে হাত দিয়ে বলেন “এই তো পেয়েছি– সোয়ান নেক ডিফর্মিটি, গাঁটে গরম গরম ভাব” উনি দেওয়ালে হ্যালান দিয়ে সিগারেট টানতে টানতে বলেন “কৈ? রক্তের রিপোর্ট গুলো দিন দেখি …..”
মোটা চশমার ভেতর থেকে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বিদ্যাসাগরের মতো ভঙ্গিতে হাতুড়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। “ইউরিক অ্যাসিড নর্ম্যাল, রক্তের ইএসআর বেশী, এক্স রে’তে অতি অল্প অস্টিওআর্থ্রোটিক চেঞ্জ রয়েছে …. হুম…. বটে বটে … দেখুন আমাদের দেশে রোগীর তুলনায় ডাক্তার বহুৎ কম– কাজেই কেউই আপনাকে বেশী সময় দিতে পারবেন না… ছোটোখাটো অসুবিধেগুলোও অল্পের মধ্যে বলে ফেলতে হয় … কি বুঝলেন?”
ভদ্রলোক বললেন “এটা কি রোগ – ও কি আর ভালো হবে?”
“রোগটা সম্ভবতঃ রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস …. আরও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করা উচিত .. কিন্তু আপনারা তো এমআরআই পর্যন্ত করে ফেলেছেন …. হাঁটুর জলের পরীক্ষা বোধহয় হয়নি তাই না? একটু আন্দাজিফিকেশনে চিকিৎসা করি?”
ভদ্রমহিলার চিৎকারে প্যাঁচাটা পালিয়ে যায়, ব্যাঙেদের ঘ্যাঁঙোরঘ্যাঁঙ থেমে যায়
“ইঞ্জেকশন? আমার পিসেমশাইয়ের কাকার এই রোগ হয়েছিলো– পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন নিতে হতো … আ-হা-মি মরে যাবো….”
ওনার চিৎকারে চমকিত হাতুড়ের ঠোঁট থেকে সিগারেটটা টুপ করে ভেজা মেঝেতে পড়েই নিভে গেল। হাতুড়ে করুণ নয়নে সেটার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে বললেন “ওনার ছিলো রিউম্যাটিক ডিজিজ – আর এটা রিউম্যাটয়েড – দুটো আলাদা আলাদা রোগ.. বুইলেন?”
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলেন “দুটোই তো বাত। তাহলে আলাদা কিসে ?”
হাতুড়ে ব্যাজার মুখে পড়ে থাকা সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে আরেকটা বার করে ধরান
“বাংলা শব্দ ভান্ডার এ বিষয়ে বড়ই দরিদ্র । ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে গাঁটে গাঁটে ব্যথা হয়- আমরা বলি গাউট – আপনি বাংলায় বলেন বাত। ইনফেকশনের পরে স্ট্রেপ্টোকক্কাস জীবাণুর বিষ থেকে যেটা হয় তার নাম রিউম্যাটিক ডিজিজ – এটায় শেষপর্বে এসে হার্টের ভাল্ভ খারাপ হয়ে যায় – বাংলায় এটাকেও বলে বাত– হাড় ক্ষয়ে যে ব্যথা হয় তাকেও বাংলায় বাত বলে, আমরা বলি অস্টিওআর্থ্রোসিস। সব কটায় আলাদা আলাদা চিকিৎসা আছে … এছাড়া এসএলই, অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডি…”
ভদ্রমহিলা বললেন “দূর দূর ছাড়ুন তো মশয় আপনার বিদঘুটে যতসব। আমার ঐ ম্যাট না কি য্যানো আর্থ্রাইটিস বললেন ওটা কি ধরণের অসুখ? সারবে কি করে?”
ওনার জীবনসঙ্গীর অনুসন্ধিৎসা জেগে উঠেছে “এ্যাতো রকম বাত? এতো মশাই এ্যাকেবারে সাত কান্ড মহাভারত! বাপরে বাপ! তাই আজকাল এ্যাতো রকম পরীক্ষা টরীক্ষা এ্যাতো সব…”
টিপটাপ শব্দে বৃষ্টি এসে পৃথিবীকে সন্ধ্যাস্নান করায়। সিগারেটের ধোঁয়া বৃষ্টিধারা বেয়ে বেয়ে অনন্তে মিলিয়ে যায়।
“ম্যাডাম সবজি কাটাতে গিয়ে আপনার কোনদিন হাত কেটেছে?”
বাইরের ঝাপসা হয়ে আসা গাছপালার দিকে তাকিয়ে মহিলা উত্তর দ্যান “কত্তোবার কেটেছে”
“রান্না করতে গিয়ে ছ্যাঁকা খেয়েছেন?”
মধ্যবয়সিনী হঠাৎ কিশোরী হয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরার চেষ্টা করেন “হ্যাঁ প্রায়ই খাই”
“তখন কি আপনাকে ওষুধ টষুধ খেতে হয়? নাকি এমনি এমনি সেরে যায়?”
ভদ্রমহিলা আড়নয়নে চেয়ে বলেন “ এমনি এমনিই সারে মশয়। এসবের জন্য আমার ডাক্তার বদ্যির দরকার হয় না।”
হাতুড়ে সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে বলেন
“এটাই আপনার ইম্যুনিটি – অর্থাৎ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এটাই আবার রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে উল্টো পাল্টা কাজকর্ম করে। আপনার জয়েন্টে যে জলীয় লুব্রিকেন্ট পদার্থটা থাকে– ভুল করে আপনার ইম্যুনিটি তাকেই মেরে ফ্যালে। তাই প্রতিটি গাঁটে ব্যথা হয়– নাড়তে কষ্ট হয়। অনেক সময় এই রোগটা শরীরের অন্যান্য লুব্রিকেন্টদেরও নষ্ট করে দ্যায় …অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস, এসএলই এরা সব এরকমই রোগ।”
ভদ্রমহিলার চোখেও বর্ষা নামে “এ রোগ সারবে না হাতুড়েবাবু?”
এই মায়াবী সন্ধ্যায় হাতুড়ে আর কতো নিষ্ঠুর কথা বলবেন? বলেন “নিয়মিত ওষুধ খেলে স্বাভাবিক জীবন কাটানো যাবে– আবার হাঁটা চলা ঘোরা ফেরা ….. ”
ভদ্রমহিলা চোখ মুছে জীবনসঙ্গীর হাত ধরে ওষুধের দোকানের দিকে হাঁটা শুরু করেন।
(বাতচিত পর্ব খতম)
খুব সুন্দর শিক্ষামূলক লেখা।ভালো থাকবেন।
ধন্যবাদ । আপনাদের তুষ্টি আমাদের পুষ্টি ।