“আরিব্বাস রজতদা, আজ আবার নতুন শার্ট! বউদির বাড়ি থেকে জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব এসেছে বুঝি?”, অফিসে ঢুকতে না ঢুকতে ফুট কাটে বিপিন।
রজত অবশ্য বিরক্ত হয় না। তার মনটা কদিন ধরে দারুণ ফুরফুরে থাকছে, সবকিছুই বেশ ভালো লাগছে, একটা অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে, মনে হচ্ছে এতদিন জীবনটা এমনিই কাটিয়ে ফেলেছে, কিছুই তেমন করেনি; আজকাল মাথায় দারুণ সব পরিকল্পনা আসছে, কীভাবে এই সাধারণ মধ্যবিত্ত কেরানির চাকরি ছেড়ে নিজের একটা ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান দিলেই তর তর করে সে সমাজের সিঁড়ি বেয়ে এক্কেবারে ওপরতলায় পৌঁছতে পারে সেইসব। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে টাটা-আম্বানি সবাই তো ওই ভাবেই বড়লোক হল!
গত তিন চারদিন রাত্তিরে মোটেই ঘুম আসছে না। তাই সারারাত্তির ধরে সে প্ল্যান বানিয়েছে কীভাবে ব্যাঙ্কের জমানো লাখকুড়ি টাকা তুলে ওই গড়িয়াহাটের মোড়ে একটা দোকান কিনবে সে। অ্যাপেলের জিনিসের ব্যাবসা করবে, ছোটখাটো দাঁও মেরে লাভ নেই। ক্ষমতা যখন আছেই তার, একটা ভালো করে দোকান শুরু করতে পারলেই তার কোটিপতি হওয়া কে আটকায়?
তা এইসব ভাবতে ভাবতে কখন রাত কেটে ভোর হয়ে যাচ্ছে খেয়ালই করেনি রজত। যেই দেখেছে ঘড়ির কাঁটা চার ছুঁই ছুঁই অমনি উঠে চান টান করে তৈরি হয়ে নিয়েছে। কিন্তু তার স্ত্রী বিন্দু মোটেই তার এইসব পরিকল্পনায় ভাগ নিতে চাইছে না। ভোরে ওঠার মাহাত্ম্য বোঝাতে গেলে মুখ ঝামটা খেতে হচ্ছে, সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট চাইলে পাড়ার মোড়ের দোকানে গিয়ে খেতে বলছে… যত সে তাকে তার কোটিপতি হওয়ার উপায় শোনাতে যাচ্ছে, সে খালি যেন কোনমতে তাকে থামাতে পারলেই বাঁচে। ভারি রাগ হচ্ছে বউয়ের ওপর কিন্তু চারটি এদিক ওদিক বেখাপ্পা কথা শোনানো আর কয়েক বাড়ি শুনিয়ে একটু চ্যাঁচামেচি বাদে আর কিছুই করেনি রজত।
বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে মোড়ের মাথায় পুরি-তরকারি খেয়ে প্রায় ঘণ্টাদুয়েক আগেই অফিস পৌঁছে গিয়েছে সে। এসে দারোয়ান থেকে শুরু করে সাফাইওয়ালা সবাইকে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের গল্প বলে কোটিপতি হয়ে তাদের সে কী কী দেবে তার ফিরিস্তি দিয়েছে। কয়েকজন সে মজা করছে ভেবে হাসতেই তাদের বেশ সজোরে দাবড়ে দিয়েছে। আর এই যে নতুন শার্টপ্যান্ট এগুলো সে নিজেই কিনেছে দিন দুই আগে। বিন্দু জানে না এইবারের মাইনের কুড়িহাজার টাকার বেশিরভাগটাই খরচ হয়ে গেছে এইসবে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল রজত যে বেশ একটা কেউকেটা সেটা বোঝাতে গেলে এইরকম একটু আধটু খরচ তো করতেই হবে।
অফিসের কাজে মোটেই মন বসছে না, এদিক সেদিক গিয়ে খানিক সে অন্যদের কাজ তদারকি করে, পরামর্শ দেয় কীভাবে তারা আরও ভালো কাজ করতে পারে। মাথায় তার এও চলে যে বিন্দুকে একটা হিরের সেট উপহার দিলে হয়, তালে নিশ্চই তার রাগ কমবে…
বিকেলের দিকে বসের ঘরে ডাক পরে রজতের। সে নাকি নিজের কাজ তো করছেই না বরং অন্যের কাজের ক্ষতি করছে, এই বলে বস তাকে ধমক দিতেই, দারুণ রাগ হয়ে যায় তার; দুম করে “রাখুন আপনার চাকরি, আমার অনেক চেনা-পরিচিত আছে, এই চাকরি আমার নখের যুগ্যিও নয়” বলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বেড়িয়ে আসে সে। ফেরার পথে বাজার থেকে প্রায় পাঁচকিলো আম নিয়ে ফেরে।
বিন্দুকে বলে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে ব্যবসা শুরু করবে বলে। বিন্দু ভয় পেয়ে তাকে অনেক কিছু বোঝাবার চেষ্টা করে, কোনমতে রাগ চেপে রেখে হন হন করে বেড়িয়ে যায় বাড়ি থেকে। বিন্দু জানলা দিয়ে শুনতে পায় সে বাইরে গিয়ে কার সাথে বেশ জোরে জোরে কথা বলছে ব্যাঙ্ক থেকে সব জমানো টাকা তুলে নিয়ে ব্যাবসা শুরু করার ব্যাপারে…বলছে নাকি ব্যাঙ্কে তাদের লাখ পঞ্চাশ টাকা আছে! আশ্চর্য হয়ে সে আলমারি থেকে সব কাগজ বার করে মিলিয়ে দেখে। দু- তিনটে অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে লাখ পাঁচেকের বেশী হিসেব পায় না সে।
শেষমেষ বেশ ভয় পেয়ে রজতের মাকে ফোন করে বিন্দু। তিনি অতখানি অবাক হন না ছেলের কীর্তিকলাপ শুনে, বরং খানিকটা ভয়ে আর খানিক লজ্জায় বলেন, “বাবান আবার ওইরকম শুরু করেছে?”
শাশুড়ির কাছ থেকে বিন্দু জানতে পারে যে রজত নাকি বাইপোলার ডিসঅর্ডার (Bipolar Disorder) রোগে ভোগে প্রায় বছর চারেক আগে থেকে। এইরকম ঘুম কমে যাওয়া, বেশী কথা বলা, বড় বড় পরিকল্পনা করা, অনেক বেশী খরচা করা এইরকম পরিস্থিতিকে নাকি ম্যানিয়া বলে।
এই নিয়ে রজতের এইরকম দ্বিতীয়বার হল। প্রথম বার শুরু হয়েছিল কলেজের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে। মাঝে বিয়ের ঠিক আগে আগে নাকি একবার ডিপ্রেশানও হয়েছিল, যখন সে সব ছেড়ে বাড়িতে বসে গিয়েছিল, সারাদিন মুখভার করে থাকত আর বলত তার বেঁচে থাকার কোনও কারণই নেই। একবার নাকি ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইড করার চেষ্টাও করেছিল! তারপরেই সবাই বলে যে বিয়ে করে বেঁচে থাকার রসদ পেলেই ছেলের এমন রোগ ঠিক সেরে যাবে।
অবশ্য প্রথমবার ওইরকম ম্যানিয়া হওয়ার পর রজতের কলেজের কিছু বন্ধু মিলে তাকে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার মিত্রের কাছে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিল। তিনিই ওর মা-বাবাকে ডেকে অসুখটির ব্যাপারে বিস্তারিত ভাবে বোঝান। বলেন যে এই রোগটি যাদের হয় তাদের মানসিক অবসাদ এবং প্রচণ্ড বেশী মানসিক স্ফূর্তি দুইই হওয়ার প্রবণতা সাধারণ মানুষের চাইতে বেশী থাকে। টানা কয়েক বছর ওষুধ খেলে এই বারবার ম্যানিয়া কিম্বা ডিপ্রেশান দুটোই হওয়ার সম্ভাবনা কমে, এবং এরা একেবারে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। কিন্তু বারবার এইধরনের উপসর্গ হতে থাকলে পরের দিকে ওষুধ দিয়েও একে থামিয়ে রাখা মুশকিল হতে পারে। কিন্তু যখন রজত ডাক্তারবাবুর ওষুধ খেয়ে মাসখানেকের মধ্যে পুরোপুরি আগের মতন সুস্থ হয়ে যায়, তখন আর সে মানসিক রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি আর মা বাবাও অকারণে ওষুধ খাওয়ার কোন কারণ দেখেননি।
কাজেই শেষবার অবসাদ হওয়ায় আবার করে ওষুধ শুরু করবার চাইতে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই শ্রেয় মনে করেছিলেন তাঁরা। এবং হয়েছিলও ফল তাতে। অবসাদ নিজে নিজেই কমে গিয়েছিল মাস ছয়েকে, কাজেই বিয়ের সময়ে কিংবা পরের কয়েক মাসে বরকে একটু চুপচাপ মনে হলেও তেমনভাবে আস্বাভাবিক লাগেনি কখনও বিন্দুর।
ফোনে এত কথা শুনতে শুনতে বিন্দুর প্রথমে আশ্চর্য, তারপর ভীত এবং অসহায় লাগতে থাকে। নিজের অজান্তেই এমন একটা পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পরায়। শাশুড়ির থেকে ডাক্তার মিত্রের ঠিকানা ফোননম্বর নিয়ে পরের দিন সকালের অ্যাপয়েনমেন্ট নেয় সে। রজত অনেক রাতে বাড়ি ফিরলে তাকে কোনমতে শান্ত রাখার চেষ্টা করে রাতভর । পরদিন সকালে সে নানানভাবে বুঝিয়ে নিয়ে যায় ডাক্তার মিত্রের চেম্বারে, সারাটা রাস্তা রজত তাকে বিভিন্ন খোঁটা দিয়ে যায় তাকে অকারণে পাগল ভাবার জন্য এবং কেন সে একজন কোটিপতির স্ত্রী হওয়ার যোগ্য না হওয়ার কারণেই এমন কাজ করছে এইসব বলে।
ডাক্তারবাবুর চেম্বারে বিন্দুর অনুরোধে পৌঁছে গিয়েছিলেন রজতের মা বাবা দুজনেই। প্রচণ্ড জোরাজুরি করে কোনক্রমে ভেতরে নিয়ে যাওয়া যায় রজতকে। ডাক্তারবাবু অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে দুটো ওষুধ খেতে রাজি করান এই বলে যে রাতে ঠিকঠাক ঘুম না হলে তার ব্যবসার হিসেবনিকেশ ঠিকমতন রাখতে অসুবিধে হতে পারে। পরে তিনি দরকার পরলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে এ কথাও বলে রাখেন বিন্দুকে। দায়িত্ব নিয়ে স্বামীর চিকিৎসার সমস্ত ভার বুঝে নেয় বিন্দু। প্রতিজ্ঞা করে যে করেই হোক এই মানুষটার পাশে থেকে একে সুস্থ করে তুলতেই হবে।
***************************************************
বিন্দু আর রজতের পনেরতম বিবাহবার্ষিকীতে যখন রজত একটা হিরের দুল নিয়ে হাজির হয়, বিন্দু একদিকে যারপরনাই খুশি হলেও মনে মনে একবার ঠিক ভেবে নেয় স্বামীর ঘুম গত সপ্তাহে ছয়-সাত ঘণ্টার কম হয়ে যায়নি তো? গত চোদ্দবছর একসাথে এই অসুখের সাথে বাঁচতে বাঁচতে এই ছোট ছোট জিনিসগুলো খেয়াল রাখার অভ্যেস হয়ে গেছে তার। সেই বিয়ের পর প্রথম বারের ম্যানিয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করতে লাগেনি শেষমেশ, কিন্তু সামলে উঠতে বেশ কয়েক মাস সময় লেগেছিল। তারপর থেকে এক আধবার ওষুধ বদলের পর গত বছর চোদ্দ ধরেই লাগাতার মুড স্টেবিলাইজার চলছে রজতের। তা সত্ত্বেও বার তিনেক হাল্কাভাবে অবসাদ এবং ম্যানিয়া হয়েছে কিন্তু কখনও অতখানি বাড়াবাড়ি হয়নি। এখন রজতেরও অভ্যেস হয়ে গেছে রাত্তিরে একখানা ওষুধ খেয়ে শোয়া, কারণ সে এখন নিজেও বুঝতে পারে যে আনন্দ কিংবা দুঃখ কোনটাই মাত্রারিক্ত হলে কতটা ক্ষতিকর হতে পারে।
অনুষ্ঠানের পর বিন্দুকে একা পেয়ে রজত জড়িয়ে ধরে বলে,”ভয় পেয়েছিলে না বলো দুলটা পেয়ে? চিন্তা নেই… বরটা তোমার মাঝে মধ্যে প্রেমেও পাগল হয়!” জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে একসাথে হেসে ওঠে দুজনেই, অজানা এক অনাবিল আনন্দে।
আমি একজন বাইপোলার পেশেন্ট। আমি তো জানতাম ওটাকে ম্যানিক পেজ বলে। তাহলে কি ভুল জানতাম?
mania holo oi poristhititar nam. jehetu bipolar disorder e mania ar depression dutoi episodic vabe hoy, sejonno maniar shomoytake manic phase ar depression er shomoy take depressive phase bola hoy..
সরি, ম্যানিক ফেজ
Like!! Really appreciate you sharing this blog post.Really thank you! Keep writing.
Thanks so much for the blog post.
Thank you ever so for you article post.
I love looking through a post that can make people think. Also, many thanks for permitting me to comment!