অনাদি অতীত অনন্ত রাতে কেন শুধু চেয়ে রও
শরৎ নয়। তবু ঘন নীল আকাশে দু চারটে সাদা মেঘ।একটা কালো, ঘন নয়, অল্প কালো একটা জলভরা মেঘ-দেখলেই মনে হয় এক্ষুণি টস টস করে জল হয়ে ঝরে পড়বে। এই রকম একটা সময়ে, একটা শিরীষ গাছের নিচে একটা সরকারি বেঞ্চে তিনজন বৃদ্ধ বৈকালিক আড্ডায় বসেছে। চতুর্থ জন এসেই হাসিতে ভেঙে পড়লেন। মানুষটা চিরকালই আমুদে। এখন রীতিমতো একজন আমুদে বুড়ো বলা যায়।
“কি হে মিত্তির, আজ আবার কি হলো? এ্যাত্তো হাসি কিসের?”
তো সেই মিত্তির বেঞ্চির পাশে একটা সিমেন্টের চাঙড়ের ওপর বসে বললেন “আজ একটা নতুন পাটভাঙা শার্ট প্যান্ট পরে নাতির সঙ্গে স্কুলে গেছিলাম। ঐ কিসব রেজাল্ট ফেজাল্ট দেবে বলে…. তো ওদের অঙ্ক দিদিমণি আমাকে দেখছে আর হাসছে… বেরিয়ে একটা সিগারেট কিনতে গেছি তো দোকানের ছেলেটা বলে ও দাদু আপনার পোস্টাপিস খোলা রয়েছে…,তখন বুঝলাম….”
মহান কোনও রসিকতা নয় তাই ঘোষসাহেব বললেন “আরে মিত্র এখন তো বয়স বাড়ছে এরকম কতো ভুল হবে। কখন দেখবে নিজের বৌ ভেবে পরস্ত্রী নিয়ে ঘুরছো,হে হে হে..”
মিত্র পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করেন। ঘোষসাহেব একটা তুলে নেন। এদের সবাইকারই স্বাস্থ্যের কারণে ঘরে ধূমপান বারণ তাই এই শিরীষ গাছতলায় এসে সমবেত হয়ে ঐ সব নেশা টেশা মেটান। এই রকম দু একটা কথা- নিতান্তই মামুলি কথা হয়। নিজের নিজের সন্তানের সাফল্যের গল্পের আড়ালে লুকিয়ে থাকে কতো আহত সম্মান। যে মানুষগুলো ষাঠ অবধি দাপিয়ে অফিস আর সংসার করেছে, কী ভাবে সংসার আর ভাঙা স্বাস্থ্য তাদের সব স্বাধীনতা একটু একটু করে কেড়ে নিয়েছে তার গল্প হয়। আজকাল মানুষ কতো অধৈর্য আর অমনোযোগী হয়ে গেছে সেই গল্প। কখনও রাজনীতির অদ্ভুত সমীকরণের গল্প। যখন তীব্র কংগ্রেস বিরোধী দলগুলোও কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলায়। এই সব বুড়োদের কাছে এটা ঘোরতর অবিশ্বাসযোগ্যতা মনে হয়। অথচ তরুণতর রক্ত ভাবে এভাবেই হয়। একবার এপক্ষ আরেকবার বিপক্ষ- এটাই ঠিক। ক্রমশঃ চিন্তার পার্থক্যের জন্য এই বুড়োরা নিজেদের গুটিয়ে পাটিয়ে শিরীষ গাছের তলাটুকু ছেড়ে বেরোতে চায় না। একটা আত্মবিশ্বাসের অভাব আর তুচ্ছতাবোধ এসে মনের ভেতরে বাসা বাঁধে। ওদের কাছে প্রতিদিন এক ছোক্রা চাওয়ালা আসে। ভৌমিকদা আর চৌধুরী চিনিছাড়া, ঘোষদার শুগার থাকলেও চিনি দিয়ে লিকার, আর মিত্রের জন্য হজমোলা লেবু দিয়ে লাল চা।
চাওয়ালার নাম রঞ্জিত। ও বলে “আচ্ছা ঐ ধুতি পাঞ্জাবি, চুপচাপ মতোন কাকু আসছেন না? প্রায় পাঁচ ছ দিন হয়ে গেল…”
ভৌমিকদা বলে “তাই তো, ঠিক খেয়াল করেছিস… আমরাই বরং….”
রঞ্জিত হাসে “পুরোনো কাস্টমার তো? না এলেই চোখে পড়ে…. আপনারা কেউ না এলে তো আমার চায়ের বিক্রিই কমে যাবে…”
বুড়োদের মনে কোথায় একটা পুরোনো তৃপ্তিবোধ কাজ করে। আর একটা লোককে রুজি রোজগারের জন্য তাহলে আমাদের ওপর ভরসা করতে হয়!
সন্ধ্যার মুখে ঠিক হলো আজ চিরকাল ধুতি পাঞ্জাবি পরা সুশীল বাড়ুজ্জের বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর করে দেখতে হবে। চৌধুরী বাড়ুজ্জের বৌয়ের শ্রাদ্ধ খেতে গেছিলো-ঠিকানা জানে, ও’ই পথ দেখাবে।
এককালের নিত্যযাত্রী, আপিসযাত্রী চারমূর্তি গিয়ে হাজির হলেন পঞ্চম যাত্রীর খোঁজ করতে। ঘরে তালা। ঘর অন্ধকার। হতভম্ব চারজনই সামনে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসলেন। বাড়ুজ্জে কোথায় গেল। এতদিনের সহযাত্রীদের ফেলে রেখে কোথায় যাত্রা করলো? সঙ্গে তো ছেলে আর ছেলের বৌ তো থাকতো, তারাই বা কোথায়? অবশ্য লোকটা কথা কমই বলতো, তা বলে কিচ্ছুটি বলবে না?
চায়ের ভাঁড় শেষ হওয়ার আগে একটা সস্তা সিন্থেটিক শাড়ি পরা ক্লান্ত ঘেমো মেয়ে এসে দরজার তালা খুলতে শুরু করলো।
চৌধুরী ফিসফিস করে বললো “বৌমা… একটা প্রোমোটারের অফিসে চাকরি করে….”
মিত্র অবাক হয়ে প্রশ্ন করে “তো ছেলে কোথায় থাকে?”
চৌধুরী ইতস্ততঃ উত্তর দ্যায় “একটু দূরের একটা শহরের কাপড়ের দোকানে… উইকএন্ডে আসে”
ভৌমিকদা বলে “তাহলে কী বাড়ুজ্জে…..?”
প্রশ্নটা অগ্রাহ্য করে ঘোষবাবু এগিয়ে যেতে থাকে। উনি পৌঁছনোর আগেই মেয়েটা, ক্লান্ত-অবসন্ন মেয়েটা, ঘরে ঢুকে দরজা দিয়েছে। ঘোষবাবু দরজায় ঠকঠক করতে করতেই বাকিরা দরজায় পৌঁছে গেছে।
একটা পুরোনো বাড়ি। এক চিলতে একটা জমিতে। শ্যাঁৎলাপড়া বর্ণহীন দেওয়াল, তাতে ইতস্ততঃ অশত্থ গাছের কচি পাতা-শ্রীহীন দরজা, পর্দাহীন জানালা, সবকিছুতেই একটা আন্তরিক মলিনতা প্রচ্ছন্ন। এখানে থেকেও বাড়ুজ্জের নির্বিকার অমলিন হাসিটির কথা সবার মনে পড়ে।
মেয়েটা বোধহয় কাপড় ছাড়ছিলো, কোনোক্রমে আবার সেটা শরীরে পেঁচিয়ে জিজ্ঞাষু চোখে দরজা খুললো।
“আমরা… মানে… ঐ একসঙ্গে বিকেলে আড্ডা দিতাম.. ব্যানার্জি কয়েকদিন আসছে না…. তাই”
মেয়েটা দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ায়- এটাই স্বাগত জানানো “আপনারা বাবার ঘরে বসুন… আমি একটু মুখ হাত ধুয়ে… আপনারা চা খাবেন তো?”
একটা ছোট্ট জায়গায় একটা টেবিল, দুটো চেয়ার কোনোক্রমে, মেঝেতে সোঁতা ধরছে, পা ভেজা ভেজা লাগছে, দেওয়ালের পুলটিস খসা-ভেজা ভেজা, একটা সদ্যপ্রয়াত স্ত্রীর ছবি। দুটো মাত্র ঘর। বাথরুমের দরজা আধভাঙা, রং-চটা। সুশীল বাড়ুজ্জে একটা ঘরে তক্তপোশে বসে ছিলো। এরা ঢুকতেই একটা নিষ্পাপ অমলিন হাসি দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করলো।
ভৌমিক জিজ্ঞেস করলো “কী খবর কী বাড়ুজ্জে? লাস্ট কয়েকদিন যাও নি কেন?”
বাড়ুজ্জের হাসি অপরিবর্তিত রইলো, ঘাড় কাত করে সায় দিলো।
মেয়েটি চোখে মুখে জল দিয়ে এসে বললো “আপনারা কী চিনি দিয়ে না চিনি ছাড়া? দুধ নেই কিন্তু….”
ইতিমধ্যে একটা অতিপরিচিত গন্ধ সকলের নাকে এসেছে। পেচ্ছাপের গন্ধ। পাব্লিক টয়লেটের চেনা গন্ধ।
মিত্র বলে উঠলো “না রে মা আজকে চা থাক, তুইও খেটেখুটে এলি… একটা ছুটির দিনে… তোর বর এলে না হয়….”
মেয়েটা চোয়াল চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। “কিছুই তো ঘরে নেই… বাবাও বেশ কয়েক মাস সই করতে পারছে না.. পেনশন তো নেই… পিএফের টাকা থেকে সুদ… বেশ কিছুদিন ধরে সব ভুলে যাচ্ছিল… খালি খালি পুরোনো কথা.. খাবার নিয়ে বসে থাকে… খাইয়ে না দিলে খায় না… পেচ্ছাপ পায়খানা সব করে ফ্যালে…..বলতেও পারে না… আমাদের আর্থিক অবস্থাও তো… বুঝতেই পারছেন…..”
সবাই নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে। পেচ্ছাপের গন্ধটাও সয়ে গেছে।
“সেদিন আপনাদের ওখান থেকে ফেরার সময় হারিয়ে কোথায় চলে যায়.. তিনদিন ধরে আমি আর ও খুঁজে খুঁজে…. শেষে খড়দা স্টেশন থেকে খুঁজে পাই… একমুখ হাসি নিয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে ট্রেন দেখছে…. খাওয়া নেই, দাওয়া নেই… ও চেষ্টা করছে লোকালি একটা চাকরির… তাহলে পালা করে যদি ডিউটি করা যায়… তাহলে অন্ততঃ….”
বাঁড়ুজ্জে এক মুখ উজ্জ্বল হাসি নিয়ে সবাইকার কথোপকথন শুনছে আর ঘাড় নাড়ছে।
“আমি খেয়ে বাবাকে খাওয়াতে বসবো… সেও ঘন্টা পার হয়ে যায়… খায় না…মুখে নিয়ে বসে থাকে”
বুড়োরা সকলেই ওর বিয়েতে এসেছিল। তাও প্রায় সাত আট বছর হবে।
ঘোষবাবু বললেন “আমরা…. মানে……বাঁড়ুজ্জের চিকিৎসার ব্যাপারটা যদি দেখি….. তাহলে….”
মেয়েটি চোখে চোখে তাকিয়ে বলল “কাকু এ তো আমাদের চিন্তারও বাইরে….আমি…”
মিত্র আনাড়ির মতো, অন্ধের মতো মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে কী যেন বললো, তারপর ছিটকে বেরিয়ে এলো।
রবিবারের দুপুর। আজ বাঁড়ুজ্জের ছেলের ছুটির দিন।আড্ডার চারজন ঐ স্মৃতিহীন বৃদ্ধকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে এসেছে।
সবাই সেই ডাক্তারের চেম্বারে। মস্তো বড়ো একটা ঘর।উজ্জ্বল আলো। একটা এক্সামিনেশন টেবিল। আর একটা মস্তো টেবিলের উল্টো দিকে ডাক্তার। একজন মাঝবয়সী মানুষ। হাই পাওয়ারের চশমা-কাঁচা পাকা চুল। বাঁড়ুজ্জে হাস্যমুখে ডাক্তারের সামনে বসে আছে। ওর এই অফুরন্ত হাসি বাকি সব স্বাভাবিক মানুষদের অস্বস্তিতে ফেলছে।এ্যাতো দুঃখ, এ্যাতো গ্লানি চারপাশে অথচ একটা মানুষ নির্বিকার সদাহাস্যময়।
“কী হয়েছে, আপনার কী অসুবিধে?”
ছেলে উত্তর দ্যায় “ডাক্তার বাবু, উনি তো কথা বলতে পারেন না”
“তাহলে একজন গুছিয়ে বলুন ওনার কি অসুবিধে”
বাঁড়ুজ্জের ছেলে গোপাল সবার মুখের দিকে চায়।ঘোষবাবু বলেন “তুমিই গুছিয়ে বলো”
গোপাল আরম্ভ করে “ডাক্তারবাবু, বাবা কোনও কথা বলছে না, খাচ্ছে না, কদিন আগে বিকেলে বেরিয়ে অনেক দূরে একটা স্টেশনে গিয়ে বসেছিল। তিনদিন পরে খুঁজে খুঁজে নিয়ে এসেছি… আর বাথরুম পায়খানার কন্ট্রোল নেই… ওনার কি স্ট্রোক ফ্রোক কিছু হয়েছে?”
“সম্ভবতঃ না। ওনার কবে থেকে অসুবিধে আরম্ভ হয় মানে পরিবর্তনগুলো আরম্ভ হয়?”
“অসুবিধা তো কিছু ছিলো না ডাক্তারবাবু, ক্রমশঃ চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিলো। কথা বার্তা বিশেষ কিছু বলতো না।বললেও একই কথা বারবার বলতো। বাবা লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়তো, আমার ওয়াইফ মাঝে মাঝে দেখতো হয়তো বইটা উল্টো করে ধরে আছে অথবা একই পাতা খুলে বসে আছে….. আর এখন একদম কিচ্ছু খাচ্ছে না”
মিত্র অসহায় জিজ্ঞাসা করে “ডাক্তারবাবু এটা কি ডিমেনশিয়া…?”
ডাক্তার বাবু বাঁড়ুজ্জেকে প্রশ্ন করেন “এখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নাম কি?”
একগাল হাসি নিয়ে উনি প্রতিপ্রশ্ন করেন “কি?”
“একশো থেকে সাত বিয়োগ দিলে কতো থাকে?”
“বাড়িতে কোন খবরের কাগজ রাখেন?’
সুশীল বাঁড়ুজ্জে একমুখ আলো করা হাসি নিয়ে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এরপর টুকটাক দুয়েকটা পারিবারিক আর অর্থনৈতিক প্রশ্ন করে ডাক্তার সবাইকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন
“হ্যাঁ। এনার অসুখটা ডিমেনশিয়া জাতীয়..… আসলে ডিমেনশিয়া একটা বিরাট বড়ো এলাকা। আর অ্যালঝেইমার্স বলে একটা রোগ আছে, সেটা আর একটু নির্দিষ্ট গন্ডিতে বাঁধা। এনার এটাকে অ্যালঝেইমার্স অসুখ বলা যায়।”
সবাই উৎকর্ণ হয়ে শুনতে থাকে।
“প্রথমে স্মৃতি কাকে বলে আর সেটা কোথায় থাকে সেটা একটু বোঝাই। ধরুন আপনি শুনতে পেলেন একটা পাখি ডাকছে। সেটা কি পাখি আপনি জানেন না। অথচ ওর ডাকের শব্দটা আপনার মস্তিষ্কে এনকোড হয়ে রইলো বাস্মৃতিতে ধরা রইলো। কেউ আপনাকে বললো এটা বুলবুলি। সেটাও আপনার মস্তিষ্কে এনকোড হয়ে গেল…..”
গোপাল প্রশ্ন করে “ডাক্তারবাবু এনকোড কি?”
“এনকোড হলো বিশেষ একটা সাংকেতিক পদ্ধতিতে ব্যাপারটা লিখে রাখা-কম্পিউটার যেমন লেখে বা গুপ্তচররা যে ভাবে গোপন খবর পাঠায়…একটু সামান্য জায়গায় অনেক কথা লিখে রাখা যায়। এরপর আপনি একদিন পাখিটাকে ডাকতে দেখলেন আগের কোড খুলে ছবি সমেত নতুন কোড হয়ে গেল। আর হ্যাঁ পাখির ডাক, হাতুড়ির আওয়াজ, কাঠঠোকরার শব্দ, কোনটা কি সেটা আপনার শৈশব থেকেই মস্তিষ্কে এনকোড হচ্ছে…
এবার এই সব কোডিংগুলো মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, নিও কর্টেক্স, অ্যামিগভালা, হিপ্পোক্যাম্পাস, বেসাল গ্যাংগ্লিয়া…এইসব জায়গায় ঢোকানো থাকছে। এই রোগগুলোতে এই কোডিংএর ওপর একটা ঢাকা বা আবরণ পড়ে যায়… ফলতঃ স্মৃতির ঢাকনা আর খোলে না। যেমন তালায় মরচে ধরলে আর চাবি দিয়ে খোলা যায় না, সেরকম।……
১৯০৬ সালে জার্মান চিকিৎসক অ্যালইস অ্যালঝেইমার্স প্রথম একটা অদ্ভুত অসুখের কথা খেয়াল করেন। এতে রোগীর স্মৃতিশক্তি ভীষণ কমে যায় এবং মৃত্যুর পরে ব্রেইনের ব্যবচ্ছেদ করলে দেখা যায় যে ব্রেনের নার্ভের ওপর একটা বিশেষ ধরনের আচ্ছাদন পড়ে গেছে। হ্যাঁ বিদেশে বিজ্ঞানের জন্য বহুক্ষেত্রেই শব ব্যবচ্ছেদ করা হয়। আমাদের দেশে নানা গোঁড়ামির জন্য এসবের কথা ভাবাও যায় না। এদেশে তাই বিজ্ঞানও আর এগোয় না”
“এটা কেন হয়?”
“অনেক অনেক কারণে হয়। প্রথমতঃ বয়স হলে শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতাও কমতে থাকে। আমাদের ব্রেনের স্মৃতি আসলে পেন ড্রাইভ জাতীয় কিছু। যেখানে একটা পেন ড্রাইভে পঞ্চাশ গিগাবাইট স্মৃতি ধরে রাখা যায় সেখানে মস্তিষ্কে প্রায় ২.৫ পিটাবাইট জায়গা আছে, অর্থাৎ প্রায় একশো বিলিয়ন গিগাবাইট। প্রচুর জায়গা। এই পেনড্রাইভটা….. ধরে নিন মস্তিষ্কের মধ্যে অ্যামিগডালা বলে একটা জায়গায় থাকে।এখানে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিটা অ্যামাইলয়েড বলে একটা জিনিস জমা হয়ে হয়ে একটা আচ্ছাদন তৈরি করে ফলে নার্ভের সঙ্গে নার্ভের যোগাযোগ ব্যবস্থাটাই বন্ধ করে দ্যায়। ফলে একটা নিউরনের মধ্যে জমা থাকা স্মৃতি আর বেরিয়ে এসে আমাদের কাজে লাগেনা। ফলে ক্রমশঃ সমস্ত রকমের স্মৃতিই অকেজো হয়ে আটকে থাকে ঐ নিউরন বা নার্ভকোষগুলোর মধ্যেই।….
সুতরাং সেই মানুষটি সমস্ত দৈনন্দিন কাজ কর্ম ভুলে যেতে থাকে। অবশেষে কথা বলা বা কথার মানে বুঝতে পারাও ভুলে যায়।
প্রথমে শর্ট টার্ম মেমোরি চলে যায় অর্থাৎ রিসেন্ট স্মৃতি চলে যায়। রোগী যেখানে সেখানে, অর্থহীন ভাবে পুরোনো কথা বলতে থাকে। তার ভেতরের মানুষটা প্রকাশ পায়। যে কটুভাষী সে কেবল কটু কথা বলতে থাকে। যে নরম কোমল মানুষ… যেমন এই হেরে যাওয়া মিস্টার ব্যানার্জি, এনার সবকিছুই হাসিমাখা।”
“এটা কি বয়স হলেই হবে?”
“নানানা, বিশেষ কতোগুলো ক্ষেত্রে হতে পারে…… বিশেষতঃ প্রিয় কারো মৃত্যু হলে জীবনসঙ্গী বা পুত্র, ভাই অথবা একটা অসম্ভব অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে, যেটা থেকে আপাত মুক্তি নেই.. এই রোগে রোগীর ব্যক্তিত্ব বদলে যায়, অকারণে হাসি, কান্না, ঝগড়া হতে পারে, তারপর সে সহজ কাজগুলো করতে পারবে না,জামা কাপড় পরতে ভুলে যাবে হয়তো সই করতে ভুলে যাবে…. তার পেনড্রাইভের পিটাবাইট থেকে হুহু করে মেমরি কমতে কমতে এক সময় খাওয়া দাওয়া বা শরীর চালিয়ে রাখার পদ্ধতিও ভুলে যাবে।”
এক চুমুক জল পান করে ডাক্তার বলতে থাকেন “ব্রেনের ঐ জায়গায় অনেক সময় ছোটো ছোটো ক্লট ফর্ম করে… সেটাও দায়ী”
গোপাল বাবার হাত ধরে বলে “তাহলে আমরা কি চিকিৎসা করবো?”
“প্রথম হচ্ছে ওনাকে সঙ্গ দেওয়া। একটা মিষ্টি কুকুর বা পোষ্য রাখা। যে সব সময় ওনাকে ব্যস্ত রাখবে।ভালবাসবে। গাছপালার যত্ন করা। একটা আয়া…আর যদি অ্যামাইলয়েডের আবরণ খোলার কোনও ভালো ওষুধ পাওয়া যায়, তাহলে…”
সবাই বেরিয়ে যাচ্ছিল। ডাক্তার এগিয়ে এসে গোপালের হাতটা ধরলেন “শুধু ভালবাসা এদের ভালো করে তোলে….একটু যত্ন…..জানি না কেন এই স্মৃতিহীন মানুষদের দেখলে আমার মনের ভেতরটা উতলা হয়ে ওঠে…..ভালো থাকবেন,আনন্দে থাকবেন…”
ভালো লেখা। ভালো থাকবেন।
অনবদ্য।