আমার জীবন কাহিনিতে ফিরি। আগেও এই কাহিনি ‘গেঁজেল’ শিরোনামে এই ফেসবুকেই প্রকাশিত। সেটিই কিঞ্চিৎ পরিমার্জনা ও সংযোজনার পর পুনঃপ্রকাশ করলাম।
আজ্ঞে হ্যাঁ, এই আমার মানে নিজের সম্বন্ধেই বলছি। হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি…।
হাজার বছর না হলেও বছর আটষট্টি তো বটেই।
ছোটোবেলায় যে বিভিন্ন গ্রামে বাস করেছি মা বাবার বদলির চাকরির সুবাদে, প্রত্যেকটি ছিল কাপালিক-তান্ত্রিক সাধক-ফকির অধ্যুষিত। আমার নিজের ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিল পারিবারিক বন্ধন না মানা এঁদের যাপনের প্রতি।
বেশ পেছন পাকা ছিলাম বলে অসীম আগ্রহ ছিল ভৈরবীগর্বিত একাধিক সাধকের জীবনযাপন প্রণালীর বিষয়ে। সেই আমিষগন্ধ মাখা চর্চার মধ্যেই ছিল এই গাঁজা ব্যাপারটি। পাঁচ-ছ জন কখনও বা তারও বেশি সাধক গোল হয়ে বসতেন। হাত থেকে হাতে বদল হত ছিলিম। সবাই যে সমান মাপের… ইয়ে ক্যালির সাধক ছিলেন, তা নয়। তবে হাতের তালু-ধৃত ছিলিমে সুতীব্র টান দিয়ে, নিঃশ্বাস ত্যাগ না করে কে কতক্ষণ থাকতে পারেন তার একটা প্রতিযোগিতা চলত নবীন সাধকদের মধ্যে।
পুরোনো ভেটের্যান যাঁরা, তাঁদের ছিলিমে টানের তেজে দপ করে আগুন জ্বলে উঠত ছিলিম শীর্ষে। অন্যরা ঈর্ষা আর বিস্ময় মেশানো দৃষ্টিতে তাকাত এই সিদ্ধিলাভ করা তপস্বীদের মুখপানে। তাঁরা আমাকে মনে হয় শক্তিশালী পাপী পিতার সন্তান বলে এই ব্যাপারে অনধিকারী জ্ঞান করতেন। বিস্ময়ে অভিভূত বালকের দিকে কখনও ছিলিম এগিয়ে দেননি।
সেই অমৃতের স্বাদ নিতে আমারও অনীহা ছিল। আমার ওই শক্তিশালী পাপী পিতা, আমার গর্হিত পুস্তক পাঠ, অঙ্কে শূন্য পাওয়া, ইস্কুল পালানো সমেত বহু অনাচার সহ্য করতেন, অবশ্যই প্রহার-তিরস্কার দিয়ে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে। কিন্তু যদি গাঁজা বা কারণবারির কারণে ধরা পড়ি তবে বাড়ি থেকে বিতারণ কেউ রুখতে পারবে না এই জ্ঞান আমার বিলক্ষণ ছিল। আমি জানতাম আমার জলের মত মিথ্যে বলার ক্ষমতা নেশাচ্ছন্ন হলে বিলুপ্ত হবে। আর বিতারণের আগে ওই যাকে বলে এক ঘাও মাটিতে পড়বে না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি অংশ নাই নিতাম, তবে যেতাম কেন ওই সব আখড়ায়। এখন মনে হয়, অ্যাক্টিভ না হোক প্যাসিভ স্মোকিংএর কোনো একটা ব্যাপার ঘটত। সাধকদের ফুসফুস-নির্গত উচ্ছিষ্ট ধোঁয়াশা’র লোভেই যেতাম বোধহয়। ভাগ্য একান্ত ভালো, তেমন কোনও পিডোফিলিকের পাল্লায় পড়িনি। অবশ্য একেবারেই পড়িনি তা নয়। সে গল্প পরে কখনও বলা যাবে। গাঁজার কথায় ফিরি।
মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের ঠিকানায় ২১৭ বিপিন বিহারি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের মার্কা থাকলেও সেই বড় রাস্তায় পৌঁছাতে হত এক শুঁড়িপথ সরু গলি বেয়ে। সেই গলিতে, কে জানে আমাদের জন্যই কিনা পরপর তিনখানা ঘুপচি দোকান সাজানো ছিল। বাংলা মদ, গাঁজা আর আফিমের। বাংলা ধেনো, কালীমার্কা বা চোলাই কিনতে স্রেফ গোঁফ বেরোনো সদ্য অ্যাডাল্ট মুখচ্ছবিই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু গাঁজা বা আফিমের জন্য রেশন-কার্ড টাইপের লাইসেন্স লাগত।
ততদিনে ছাত্র রাজনীতির খাদ্য হয়ে পড়েছি। আমার সেই দাদারা এই ব্যাপারে ঘোর অনাগ্রহী ছিলেন বলে লাইসেন্স করানোর সুলুক জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়েছি। তবে শুনেছিলাম একতলার অন্তত গোটা তিনেক ঘরে চর্চা ছিল। তার একটা ঘরের বাসিন্দারা তুরীয় অবস্থায় বাঁশি বাজাতেন। সে রকম বাঁশিও পরবর্তী কালে আর দেখলাম না। অবিকল ভোজপুরী দারোয়ানদের হাতে থাকা বা লাঠিখেলার লাঠির সাইজের সেই সব বাঁশি। অবশ্য বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকুই বা আমি জানি। পরে জেনেছি, তিনতলা হোস্টেলের বহু ঘরেই এই স্বর্গীয় উদ্ভিদের চর্চা ছিল।
অন্য মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে নাকি তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রশান্ত শূর ছাদে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন টবে গাঁজার চাষ হচ্ছিল।
আমাদের হোস্টেলে আমরা সেই প্রতিভা অন্তত আমাদের সময়ে দেখাতে পারিনি। আমাদের দৌড় ছিল বিড়ি, সিগারেট আর বড় জোর পালে পার্বনে ধেনোর সাথে গোল্ড-স্পট মিশিয়ে হুইস্কি-প্রহেলিকা।
এই প্রসঙ্গে বলি এক তামাক সেই হোস্টেল জীবনে যা ক্ষতি করেছে অন্য কোনও কিছুই ততটা করেনি।
আগের পর্বে বলেছি আমার সহপাঠী গৌর শেষ যখন হোস্টেল ছাড়ি, তামাক-লব্ধ সব কটা সামগ্রী নিচ্ছে তো বটেই, খুব আক্ষেপও করছে তামাকের কোনও ইঞ্জেকশন নেই কেন? যাই হোক, এর কয়েকবছরের মধ্যেই ইঞ্জেক্টেবল নেশার মহামারি দেখা দেবে… তামাকজাত নয় যদিও।
ছাত্র জীবনের পরে হাউসস্টাফশিপ। ইডেনরুফ। স্বাধীনতার এক উজ্জ্বল স্টেশন। একদিন শেষ দুপুরে রাউন্ড দিয়ে ফিরে দেখি ইডেন রুফে ওঠার কাঠের সিঁড়িতে বসে আছে আট দশ জন সাহেব-মেম। ধুলিমাখা ছেঁড়া অবিন্যস্ত পোষাক তাঁদের।
তদন্তে বেরোলো আমাদের কয়েক বছরের বড় ধ্রুবদার গেস্ট এরা। আমাদের নিম্নবিত্তদের যেমন ছুটি কাটাতে দীপুদা মানে দীঘা-পুরী-দার্জিলিং অতি বিত্তবান ধ্রুবদা ছুটি কাটাতে যায় আমেরিকা-ইউরোপ।
সেখানে গিয়ে সে দেশের বন্ধু যারা ইদানিং হিপি হয়ে গেছে, তারাই হানা দিয়েছে। ধ্রুবদা হোস্টেলে নেই।
আমাদের আশু, আমার কো হাউসস্টাফ ইতিমধ্যেই বেশ জমিয়ে সিঁড়িতে বসেই আড্ডা দিচ্ছে হিপি ও হিপিনিদের মাঝে বসে।
সন্ধ্যের রাউন্ডে বেরোব। আশুকে ডাকতে বলল, ‘গুরু, আজকে আমাকে ছেড়ে দে। শালা, হিপিদিদি ঘুরে এসেছে পুরো হিমালয়ের উঁচু উঁচু চূড়ো থেকে। সাথে একদম অরিজিনাল হিমালয়ান মাল। একটুস খানি ভিক্ষে করে জোগাড় করেছি। হেভি দয়ালু মাইরি দিদিটা।’ বলে কৌটো খুলে দেখাল। ঘাসপাতা আর ছাগলের নাদির মত দেখতে কী একটা। ওটা নাকি চরস।
একলা রাউন্ডে মেজাজ এল না ঠিক। ওয়ার্ডও শান্ত। পোস্ট রাউন্ড চায়ের আড্ডাটাও আশু বিহনে বাতিল। সহপাঠিনী প্রেমিকার গাইনি অনকল। সেখানে দাঁত ফোটানো যাবে না। কাজেই হাউসস্টাফ কোয়ার্টার আদতে যেটা হোস্টেলই, সেই ইডেন রুফে ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি, মেসের ছেলে সুফল এসে ফিসফিস করে বলল, ‘একটু আশুবাবুর ঘরে চট করে আসুন দাদা। আশুদা সন্ধ্যে থেকে কেমন জানি করছেন!’ ওর উদ্বেগ অবহেলা করা গেল না। আশুর ঘরে গিয়ে দেখি একমুখ হাসি নিয়ে ছেলে বসে আছে। এভরিথিং আন্ডার কন্ট্রোল।
উদ্বেগের আভাস মাত্র নেই। এক গাল হেসে বলল, – ‘আয় আয় অরুণাচল। বড় ভালো কাটছে সন্ধেবেলাটা। তোর জন্য মন কেমন করছিল। বুইলি, অ্যাক্কেবারে অজ্জিনাল নীলকণ্ঠভোগ জিনিস। হিমালয়ের খাঁজে জন্মানো চামকি জিনিস। শালা, ওই সাহেবগুলো এই চিজ কোথায় পাবে ওদের দেশে। আল্পসে তো খালি বরফই বরফ। হিমালয়ান বরফের সঙ্গে ট্রপিক্যাল সূর্য পাঞ্চ করলে তবে না অমৃত ফলবে। কোথায় ফালতু আল্পস আর কোথায় অলমাইটি হিমালয়া।’ বিশাল লেকচারের পর হাত বাড়িয়ে একটা গামছা টেনে নিতে হাত বাড়াল।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, ‘গামছাটা দেব? মুখ মুছবি?’
চকচকে মুখ আশু আমার দৃষ্টি ফেরাল ওর পায়ের দিকে।
দেখি ডান পা-টা লোহার খাটের ছত্রির সঙ্গে আর একটা গামছা দিয়ে আগেই বাঁধা। গদগদ গলায় বন্ধু জানাল, – ডান পাটা আগেই বেঁধিচি। বাঁ পা-টাও বেঁধে ফেলি খাটে। আমার বুইলি তো কড়া জান। শুধু সন্ধের পর থেকে মনে হচ্ছে উড়ে যাচ্ছি। তাই একটু বেঁধে রাখছি নিজেকে। সাবধানের মার নেই।’
সত্যিই সাবধানের মার নেই। মারেরও সাবধান নেই।
এই করতে করতে ডাক্তার হয়ে ইয়ে ডাক্তার সেজে সমাজে হানা দিয়েছি। গেঁজেল, মাতাল পাতাখোরদের চিকিৎসা করতে হবে সারা জীবন। তাই আর সারা জীবনে ছোঁয়া হল না বোধহয়।
না, ভুলে গেছিলাম। একবার, মাত্র একবারই পেয়েছিলাম সেই অমৃতের স্বাদ। ইউনিভার্সিটির সঙ্গে এক কেসে জড়িয়েছি। আমার কো-কন্টেসট্যান্ট প্রতাপ। আহা বড় ভালো বন্ধু, ভালো ছেলেও। দিলীপদা সেদিন বলল প্রতাপ নাকি নেই। খুব কষ্ট হল। যাক, ঘটনায় ফিরি।
হাইকোর্টে যাঁরা গেছেন তাঁরা তো জানেনই, যাঁরা যাননি তাঁদেরও জানাই, কেস চলাকালীন প্রতিটি দিনই হতাশার। গিয়ে শোনা যাবে হয় অপোনেন্ট উকিল নতুন ডেট নিচ্ছেন নয় লিস্টে নাম থাকা সত্ত্বেও সময়াভাবে আজ উঠবে না।
সেই রকম এক হতাশ দিনে প্রতাপ আর আমি স্ট্রান্ড রোড ধরে হেঁটে যাচ্ছি বাবুঘাটের দিকে। হঠাৎ প্রতাপ সড়াত করে নেমে গেল গঙ্গাতীরবর্তী এক ঝুপড়ি দোকানে। ফিরে এল খানিক বাদে। মুখে বিজয়ীর হাসি। প্রতাপের চেহারা ছিল লম্বা চওড়া। ওকে দেখেই সেই ভিনপ্রদেশী ঝুপড়িওয়ালা ঠাউরেছে সাদা পোষাকের পুলিশ। ওর কোন দেশোয়ালি পেডলার বন্ধু, পুলিশ সাহেবকে দেখে আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছিল। তাকে ডেকে এনে, একেবারে ফার্স্ট ক্লাস গাঁজা, আবার নাকি দামও নিতে চায়নি। প্রতাপই চেপেচুপে দাম দিয়ে এসেছে। ডাক্তারে-ওষুধে খরচা না করলে যেমন অসুখ সারে না, তেমনই নাকি নেশাও। খরচ না হলে নেশা জমবে না।
তার পরে পুণ্য জাহ্নবী তীরের বেঞ্চে বসে সিগারেটের তামাক বার করে গাঁজা পাঞ্চ করে আবার সিগারেটে পুরে তৈরি করল অভিজ্ঞ প্রতাপ। ওর ঝুলোঝুলিতে বাধ্য হয়ে আমিও জীবনে সেই প্রথমবার কৌমার্য হারালাম।
বেসিক্যালি তো আমি পাপীই। এবং শাস্তিও পেলাম যথাযথভাবে। কিছুক্ষণ বাদে, প্রতাপ তখন আমাকে শেখাচ্ছে কী ভাবে বুকে ধোঁয়া নিয়ে না কেশে দম বন্ধ করে রাখতে হয়। ঠিক তখন, আমার আর ওরও মুখের জ্বলন্ত সাদা কাঠি ফুটফাট করে ফাটতে লাগলো। যথেষ্ট জোরে, মিনি অ্যাটম বোম যেন বা। আমার ঠোঁটের ওপর ঝুলে পড়া সাধের গোঁফ পুড়ে গন্ধ বেরোচ্ছে।
আহত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ততোধিক আহত প্রতাপ প্রবল ক্ষোভে বলে উঠল, – ‘দেশটা কী যাচ্ছেতাই ডেসপারেট হয়ে গ্যাছে দেখলি? হতভাগারা পুলিশকে অবধি নিমতলা শ্মশানের গাঁজা দিচ্ছে। শালা বীজ-ভর্তি…’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল বন্ধুর নথভাঙা প্রতাপ। সেই এপিসোডের পর থেকে আজ অবধি গাঁজাহীন ব্রহ্মচর্য চলছে আমার।
একে বারেই কী গাঁজাহীন?
না বোধ হয়। বাংলা নিউজ চ্যানেলে আর সোশ্যাল মিডিয়ায় যে গাঁজা পরিবেশন আর ছিলিমের টান ও মৌতাত, তাতে যে বুঁদ হয়ে থাকি রোজই!
নিশ্চিতই আমি এখন পুরোপুরি গেঁজেল হয়ে গেছি!