স্যারের চেম্বারে আমি লিস্ট ধরে নাম ডাকছিলাম..
– চার নম্বরে সমীর বর্মন। পাঁচে মহম্মদ বদরুদ্দীন। পরপর চলে আসবেন..
পাঁচ নম্বর আসতে তিন বছরের বদরুদ্দীনকে কোলে নিয়ে বাচ্চার মা-বাবা ডা.ঘোষের চেম্বারে এলেন।
স্যার তাঁর চিরপরিচিত ঢংয়ে পেনটা টেবিলে রেখে, হাতদুটো পরস্পরের সাথে জোড় পাকিয়ে হাফ নমস্কারের ভঙ্গিতে উৎসুক দৃষ্টিতে বাচ্চার দিকে তাকালেন।
– স্যার, বাচ্চার পাদলা পাইখানা আর জ্বর। আজ দু’দিন হয়্যা গ্যাল। পাইখানায় রক্তের ছিটা আছে।
– হুঁ.. পেচ্ছাব কেমন করছে?
– কিচ্ছু খাচ্ছে নি ত স্যার। পেচ্ছাব পুর্যা হলুদ।
– শুনুন, বাচ্চার রক্ত-আমাশা হয়েছে। শরীর থেকে অনেক জল বেরিয়ে গেছে। ওষুধ আর ও.আর.এস. লিখে দিলাম। সন্ধ্যেবেলা আবার একবার আনুন। সেরকম বুঝলে ভর্তি করতে হতে পারে।
চিন্তিত মুখে বাচ্চার বাবা-মা বেরিয়ে গেলেন।
সন্ধ্যেবেলা বাচ্চা অনেকটা সুস্থ!! বাবা-মার মুখেও স্বস্তির ছাপ।
– ঠিক আছে। ওষুধ যেমন বলেছি চলুক। আর অন্য কোনও অসুবিধে নেই তো?
– না। বলত্যা নাই, বাচ্চার মোর সেরকম বোড়ো কুনো রোগ হয়নি।
– আচ্ছা, টিকাগুলো সব পেয়েছে তো?
হঠাৎ, মুখগুলো সংকোচে গুটিয়ে যায়।
নিশ্চুপ দেখে ডা.ঘোষ সব বুঝে যান।
– টিকা দেননি কেন? পোলিও কার্ড দেখি..
বাচ্চার মা ততোধিক সংকোচে কার্ডটা বাড়িয়ে দেন।
– এ কী!! সব টিকা-ই তো পেয়েছে দেখছি। তাহলে পায়নি বলছেন কেন?
– না ডাক্তারবাবু। টিকা দিবাইনি। হেলতের দিদিমণিরা এমনি ভর্যা দিছ্যা।
– ‘এমনি ভর্যা দিছ্যা’ মানে? টিকা না দিয়ে কার্ড ভর্তি করার তো কথা নয়..দাঁড়ান, বি.এম.ও.এইচ-কে ব্যাপারটা জানাতে হবে..
বি.এম.ও.এইচ আর টিকা দেখভালের দিদিমণিকে ব্যাপারটা দেখতে বলে ডা.ঘোষ আবার পেশেন্ট দেখায় মন দিলেন। একাজ-সেকাজে ব্যাপারটা ভুলেও গেলেন।
সপ্তাহ খানেক বাদে টিকা-দিদিমণির সাথে দেখা।
– ওই কেসটা কী হয়েছিলো জানেন ড.ঘোষ?
– কোনটা বলুন তো..
– ওই যে, টিকা নেয়নি অথচ কার্ড ভর্তি..
– ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। কী ওটা? আমি তো বুঝতেই পারলাম না।
– ওদের মৌলবী বলে দিয়েছে টিকা নেওয়া হারাম। ওদের বাড়ির ছেলেরা কেউ টিকা নেয়নি। বাচ্চাদের দিতেও দেয় না। বাচ্চার মা লুকিয়ে সেন্টার থেকে টিকা দিইয়েছে বাচ্চাকে। তাই চেম্বারে বরের সামনে ভয়ে টিকা দেওয়ার কথা বলতে পারেনি।
– হ্যাঁঃ!!!
– হ্যাঁ, এরকমই ব্যাপার।
– এবার ওর বাড়ির লোকজন বাচ্চার মা’র ওপর ঝামেলা করবে তো..
– আপনি চিন্তা করবেন না। তার ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। ওর বাড়ির সবাইকে ডেকে টিকা-র ব্যাপারগুলো বুঝিয়েছি। প্রথমে গাঁইগুঁই করছিলো। বলছিলো, ‘আমাদের ধর্মে বারণ আছে।’ তারপর বোঝানোর পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে। আপনার চেম্বারে দ্যাখা করতে বলে দিয়েছি।
– বাঃ!! দারুণ একটা কাজ করেছেন। আরও একটা ফ্যামিলি টিকার ব্যাপারে আগ্রহী হ’লে তার চেয়ে ভালো কিছু হয়না।
ঠিক চারদিন বাদে বাচ্চার মা-বাবা সহ বদরুদ্দীনের পুনরাগমন। এখন বাচ্চা একদম চনমনে।
– মোর ঘরের লোকের ভয়ে সেদিন আপনাকে মিত্যা বলছি স্যার। অরা অনেককিছু বলছল কিন্তু আমি জানতি টিকা দিবা ভাল। মোর এক মামাত দাদার টিকা না লিয়্যা পলিও হোয়েইছল। আমি লুকিয়্যা বাচ্চাকে টিকা দিছি। সেদিন ঘরে পোচুর অশান্তি হছ্যা। পরে দিদিমণিরা বুঝাইত্যা এর্যা একটু শান্ত হছ্যা।
– আপনি সাহস নিয়ে যেরকম একটা কাজ করেছেন, আমার চেয়ে বয়সে ছোটো না হ’লে আপনার পা ছুঁয়ে একটা প্রণাম করতাম। আজ যে পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল হয়েছে, পোলিও প্রায় নির্মূল, সংক্রামক রোগগুলি অনেক নিয়ন্ত্রণে.. তাতে আপনাদের অবদানও কম নয়।
তারপর, বাচ্চার বাবার দিকে ঘুরে বললেন..
– দু হাজার কুড়ি সাল তো হ’ল। সময়টা অনেক এগিয়েছে। এবার একটু ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস গুলো থেকে বেরিয়ে আসুন। আজ বাচ্চার মা সাহস করে টিকাগুলো না দিলে আপনার বাচ্চারই ক্ষতি হ’তে পারতো।
– হ্যা স্যার। আমরা সব বুজছি। আর করব নি। ঘর্যা আরও দুটা বাচ্চা আছে। তাদেরকেও টিকা দিয়্যা দিব।
…
আরও একটা যুদ্ধ জেতা হ’ল। সব যুদ্ধজয়ে রক্ত ঝরে না।
মুসলিম সমাজে তাদের ধর্ম বিরাট বড় অন্তরায় ফলে তাদের ভেতরে প্রতিবন্ধীর আধিক্য৷
ধর্মের ভয়েই শুধু না পোলিও খাওয়ালে বাচ্চা হবে না এমন অবান্তর গুজবও শুনেছি।পুরো একটা বস্তি টীকার বিরুদ্ধে ছিলো।
এখন অনেকটা ভালো।