মূলত তিন ধরনের মানুষকে লিভার ফাংশন টেস্ট করতে দেখি।
১. Whole body চেক আপ। (বাজারে খুব জনপ্রিয়)
২. ডাক্তারবাবুকে অনুরোধ করে প্রেসক্রিপশন লিখিয়ে নেওয়া, “একটু লিভার ফাংশন টেস্টটা লিখে দেবেন তো ডাক্তারবাবু”…সংখ্যায় সবথেকে বেশি।
৩. ডাক্তারবাবু নিজেই প্রেসক্রিপশন করেছেন লিভার ফাংশন টেস্ট।
সমস্যা হলো বিষয়টা বেশ জটিল। কখনো কখনো ডাক্তারবাবু এনজাইম একটু এদিক ওদিক হওয়াকে পাত্তা দিলেন না, আবার কখনো কখনো ডাক্তারবাবু আপনার লিভার ফাংশন টেস্টের রিপোর্ট দেখে আরো কিছু টেস্ট করাচ্ছেন।
আপনার কাছে যেহেতু ছবিটা পরিষ্কার নয় আপনি ভুল ভাবছেন। আরে অমুকের তো একটু গন্ডগোল থাকা সত্বেও কিছু করতে বলে নি, আর আমার বেলায় এত টেস্ট এরপরেও! এদের যে কি কোথায় টিকি বাঁধা কে জানে!
আসুন একটু সহজ করে দু তিনটে লিভার এনজাইম নিয়ে একটু বুঝে নেই।
লিভার এনজাইম মূলত দুটো ক্যাটাগরিতে বিভক্ত।
১. Alkaline phosphatase
২. Transaminases (AST, ALT)
যখন alkaline phosphatase বেশি থাকাটাই মূল, সেটা সাধারণত আপনার bile duct ইনজুরি বা obstruction অথবা infiltrative disease মানে ক্যান্সার বা টিবি, sarcoidosis এগুলো নির্দেশ করে।
আর যখন transaminase বেড়ে থাকে সেটা লিভার ইনজুরি মানে ভাইরাল হেপাটাইটিস, autoimmune হেপাটাইটিস, ওষুধ বা কোনো টক্সিন থেকে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বোঝায়।
এবার এটাও মাথায় রাখতে হয় alkaline phosphatase বাড়ে শুধু লিভারের জন্য নয়, হাড়ের রোগের জন্য ও বাড়তে পারে।
লিভার সংক্রান্ত হলে transaminase এনজাইমগুলোও একটু হলেও বাড়বেই, কিন্তু হাড় সংক্রান্ত কারণে বাড়লে transaminase এনজাইমগুলো নরমাল থাকবে।
আর একটি এনজাইম এখানে আলোচনায় আনছি না সেটা (GGT)। অনেকটাই alkaline phosphatase-এর মত ব্যবহার করলেও মদ এবং কিছু ওষুধ খেলে বেশি বাড়ে।
সবার ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় গাদা গুচ্ছের টেস্ট যেমন লিভার বায়োপসি, serological টেস্ট করার প্রয়োজন হয় না।
আপনার সেরকম কিছুই সমস্যা নেই, কিন্তু লিভার এনজাইম তারতম্যের জন্য ডাক্তারবাবু আপনাকে বুকের ছবি করিয়ে টিবি বা sarcoidosis রোগ শনাক্ত করতে পারেন। আবার কম বয়সী কোনো সমস্যা সেরকম কিছু নেই সেরকম মহিলার লিভার ফাংশন টেস্ট এদিক ওদিক থাকায় antimitochondrial antibody টেস্ট করে প্রাইমারি বিলিয়ারি সিরোসিস সনাক্ত করতে পারেন।
আপনি একজন কলেজ পড়ুয়া, হালকা জ্বর, গলা ব্যথা, গলার চারপাশে লিম্ফ গ্ল্যান্ডগুলো একটু ফুলেছে, আপনার লিভার এনজাইমগুলোর এদিক ওদিক কিন্তু cytomegalovirus (CMV) ইনফেকশনে হতে পারে।
আপনার পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব , অ্যান্টাসিড খেয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন, আপনার লিভার এনজাইমগুলোর মধ্যে alkaline phosphatase বেশ বেড়ে আছে, পেটের ছবি করলে গল স্টোন আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
আপনি বয়স্ক মানুষ, ডাক্তারবাবু আপনাকে শুয়ে পেট দেখে লিভার বেড়ে আছে বুঝে আপনার রক্তের হিমোগ্লোবিন, স্টুলের পরীক্ষা, লিভার ফাংশন টেস্ট করিয়ে তার কিছু তারতম্য পেয়ে আপনাকে বড় gastroenterologist-এর কাছে পাঠালেন। আপনার হয়তো কোলন ক্যান্সার, সাথে লিভারে সেই রোগ ছড়িয়ে গ্যাছে।
আপনি বয়স্ক মানুষ। আপনার জন্ডিস হয়েছে। পেটে কোনো ব্যথা নেই। বিলিরুবিন বেশ বেড়ে আছে। ডাক্তারবাবু আপনাকে পেটের ছবি করিয়ে প্যানক্রিয়াসের ক্যান্সারের কোনো গ্রোথ হচ্ছে কিনা দেখে নেবেন।
আপনার বিগত কয়েকদিন ধরে জ্বর, গা হাত ব্যাথা, বমি বমি ভাব, খিদের ইচ্ছা চলে যাওয়া, পেচ্ছাপের রঙ হলুদ, আপনার লিভার ফাংশন টেস্টে দেখা গেলো transaminase এনজাইমগুলো বেশ বেড়ে আছে। আপনার খুব সম্ভবত হেপাটাইটিস A হয়েছে। আর বাকি হেপাটাইটিসের তুলনায় এর ক্ষেত্রে সাধারণত হঠাৎ করে জ্বর, গা হাত পা ব্যথা, মাথা ব্যথা এগুলো বেশী দেখা যায়।
আপনি মহিলা, গাঁটে গাঁটে ব্যথা, পিরিয়ড হঠাৎ করে বন্ধ, আপনার লিভার ফাংশন টেস্ট করিয়ে ডাক্তারবাবু আপনাকে আবার রক্তের কিছু অ্যান্টিবডি টেস্ট করাতে পারেন, আপনাকে স্টেরয়েড, সাথে অন্যরকম কিছু ওষুধ খাওয়াতে পারেন। আপনার হয়তো autoimmune hepatitis হয়েছে।
আপনার লিভার ফাংশন টেস্ট করে ডাক্তারবাবু দেখলেন AST লেভেল ALT লেভেলের দ্বিগুণ, GGT লেভেল বেশ বেশি। আপনি বস, আর মদ খাচ্ছেন না, এখন মদ আপনাকে খাচ্ছে।
এছাড়াও chronic হেপাটাইটিস সি, ড্রাগ induced লিভার ইনজুরি, কিছু hereditary metabolic disorder, HIV পজিটিভ রুগীর ক্ষেত্রে কিছু opportunistic infection, হেপাটাইটিস বি এসব অনেক জটিল রোগেও লিভার ফাংশন গন্ডগোল হয়।
সবটাই খুব সহজ নয়। এটা হলে এটা খেলে কমে যায় ব্যাপারটা এরকম নয়। আর ডাক্তারবাবু নিজে রোগ সম্মন্ধে কনফার্ম হবার জন্য আরো কিছু টেস্ট করাচ্ছেন, এভাবেও একটু ভেবে দেখবেন ।
(আমি প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করি না। যে সংস্থায় কাজ করি সেখান থেকে নন প্র্যাক্টিসিং একটা টাকা পাই মাইনের সাথে। গত দুবছর ধরে হাসপাতালের তরফ থেকে কিছু কিছু সামাজিক কাজকর্ম যেগুলো করা হয় সেটা ব্যাহত হচ্ছে করোনা মহামারীর কারণে।
তাই নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা মাথায় রেখে এসব লেখার অবতারণা। সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের জন্য, অবশ্যই ডাক্তারবাবুদের জন্য নয়।)
অনিচ্ছাকৃত ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করে দেবেন।
সবাই ভালো থাকুন।